রাষ্ট্রের স্বৈরাচারের সামনে আজও একরোখা জাফর পানাহি
Jafar Panahi: তাঁর ‘ইট অয়াজ জাস্ট অ্যান অ্যাকসিডেন্ট’ সম্প্রতি কান ফিল্ম ফেস্টিভালের শ্রেষ্ঠ সম্মানে ভূষিত হয়েছে। তিরিশ বছর আগে, এক নিষ্পাপ শিশুগল্প নিয়ে পানাহি তৈরি করেছিলেন তাঁর প্রথম ছবি ‘দ্য হোয়াইট বেলুন’।
নানা ভাবে তাঁর ওপর নজরদারি করে রাষ্ট্র। তবু তিনি তাঁর কাজে অচল। তাঁর কাজ কী? সিনেমা বানানো। সেই সিনেমার মধ্যে দিয়ে নিজের শৈল্পিক ও রাজনৈতিক বক্তব্যকে প্রকাশ করা। যে-কোনো আর্টিস্টের ক্ষেত্রে এমনই হওয়া তো উচিত! কিন্তু হয় কি? আজকের গা-বাঁচিয়ে চলা পৃথিবীতে শাসকের সামনে দাঁড়িয়ে নিজের বক্তব্যকে স্পষ্টভাবে ক-জন বলতে পারেন? তিনি পারেন। ইরানের রাষ্ট্রব্যবস্থার বহু নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও পারেন। তিনি, জাফর পানাহি।
সকলেই জানেন, জাফর পানাহি-র নতুন ছবি ‘ইট অয়াজ জাস্ট অ্যান অ্যাকসিডেন্ট’ সম্প্রতি কান ফিল্ম ফেস্টিভালের শ্রেষ্ঠ সম্মানে ভূষিত হয়েছে। তিরিশ বছর আগে, এক নিষ্পাপ শিশুগল্প নিয়ে পানাহি তৈরি করেছিলেন তাঁর প্রথম ছবি ‘দ্য হোয়াইট বেলুন’। একটি বাচ্চা মেয়ের রঙিন মাছ কিনতে যাওয়াকে ঘিরে ঘটে-যাওয়া নানা ঘটনাক্রম সারা পৃথিবীর সিনেমাদর্শকের কাছে এক বিশেষ মুগ্ধতার আসনে বসিয়ে দিয়েছিল পরিচালককে। বলা বাহুল্য, ১৯৯৫ সালে রিলিজ হওয়া এই ছবির চিত্রনাট্য লিখেছিলেন ইরানের আরেক সিনেমা-জাদুকর আব্বাস কিয়ারোস্তামি। জাফর পানাহি তাঁর পরিচালক-জীবনের প্রথম দিকে বেশ কিছু দিন কিয়ারোস্তামি-র ছবিতে অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর হিসেবে কাজ করেছিলেন। এবং কিয়ারোস্তামিকে নিজের শিক্ষকও মনে করতেন পানাহি। ইরানের এই সিনেমা-ঐতিহ্য বেশ অবাক করে দেয়। একজন নতুন পরিচালক, যে ভবিষ্যতে সারা পৃথিবীর সিনেমার ক্ষেত্রে এক বিশেষ নাম হয়ে উঠবে, তাঁর প্রথম ছবির চিত্রনাট্য লিখেছেন সেই একই ভূখণ্ডের এবং সমগ্র সিনেমার ইতিহাসের এক প্রবাদপ্রতিম পরিচালক। এমন শিল্পসংযোগ এদেশে কি সেভাবে দেখতে পাই?

প্রথম ছবি: 'দ্য ওয়াইট বেলুন'
১৯৯৭ সালে পানাহির ‘দ্য মিরর’-এর মূল-কেন্দ্রে আবারও দেখতে পাওয়া যায় একটি বাচ্চা মেয়েকে, যে স্কুল থেকে নিজের বাড়িতে ফেরার রাস্তা খুঁজছে। এর আগে, ১৯৯৫ সালে ‘দ্য হোয়াইট বেলুন’ পেয়েছিল কান ফিল্ম ফেস্টিভালের বিশেষ সম্মান ‘ক্যামেরা ডি-অর’। এবার, লোকার্নো ফিল্ম ফেস্টিভালে ‘দ্য মিরর’ লাভ করে ‘গোল্ডেন লেপার্ড’ সম্মান। পানাহির কেরিয়ারের দিকে তাকালে ঠিক এরপরই দেখা যায় বদলে যাচ্ছে তাঁর ছবির বিষয়-জগৎ। ইরানে মেয়েদের প্রতি সমাজের নিপীড়নমূলক মনোভাবকে সামনে রেখে ২০০০ সালে পানাহি তৈরি করছেন ‘সার্কেল’। রাষ্ট্রক্ষমতার ধর্মান্ধ মুখচ্ছবি বেরিয়ে পড়ায় ইরান সরকার তৎক্ষণাৎ ছবিটিকে নিষিদ্ধ করলেও ‘সার্কেল’ সে-বছর আন্তর্জাতিক ভেনিস ফিল্ম ফেস্টিভালে ‘গোল্ডেন লায়ন’ পুরস্কার পায়।
আরও পড়ুন-
নিরাপদ নির্মাণ: শ্যাম বেনেগালের সিনেমা
এরপরই একটা আশ্চর্য জিনিস ঘটতে থাকে পানাহির জীবনে। দেখা যায়, একের পর এক ছবি বানাচ্ছেন পানাহি আর ইরান সে-ছবির ওপর নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে দিচ্ছে। পাশাপাশি, সেসব ছবি অর্জন করছে বহু আন্তর্জাতিক সম্মান। যেমন, পানাহির ‘ক্রিমসন গোল্ড’-কে ‘ডার্ক’ অভিধায় রিলিজই করতে দেয়নি ইরান। অথচ কান ফিল্ম ফেস্টিভালে ছবিটি ‘পিক্স ডু জুরি’ সম্মান লাভ করে।

'অফসাইড'-এর পোস্টার
১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামিক বিপ্লবের পর খেলার ম্যাচে মেয়েদের প্রবেশাধিকার নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়। ইরান সরকারের মতে, খেলার মাঠে মেয়েরা উপস্থিত থাকলে তাদের দিকে ছুটে আসতে পারে নানারকমের কটূক্তি, এমনকী যৌন-হিংসাও। এই নিষেধাজ্ঞার সঙ্গে জড়িয়ে আছে পানাহির এক ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা। জাফর পানাহির নিজের মেয়েকে একটি খেলার ম্যাচে ঢুকতে দেওয়া হয়নি কেবলমাত্র সে একজন ‘নারী’ বলে। এই অসাম্যমূলক আচরণের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় ২০০৬ সালে পানাহি তৈরি করেন ‘অফসাইড’ ছবিটি। বার্লিন ফিল্ম ফেস্টিভালে ‘অফসাইড’ ‘দ্য সিলভার বিয়ার’ পুরস্কার পায় এবং পানাহির জন্ম-ভূখণ্ড ইরানে এবারেও ছবিটিকে ব্যান করে দেওয়া হয়।
আরও পড়ুন-
বাংলা সিনেমার উচ্চতা থেকে পতন নিয়ে দু’চার কথা
লক্ষ করার মতো বিষয় হল, পানাহির নিজের দেশের মানুষ তাঁর তৈরি সিনেমা দেখতে পাচ্ছেন না। অথচ তাঁর ছবির মধ্যে দিয়ে সমগ্র পৃথিবীর দর্শকের কাছে ছড়িয়ে পড়ছে ইরানের সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবন, দেশের ক্ষমতাতন্ত্রের মধ্যে বসবাসকারী ধর্মীয় অন্ধতার দিকগুলি। পাশাপাশি, পানাহির ব্যক্তিগত জীবনে তখন শুরু হয়ে গেছে রাষ্ট্রের নিগ্রহ, সারাক্ষণের নজরদারি। কারণ, কোনও শাসকই চাইবে না তাঁর নিপীড়ন-পরিচয় প্রকাশ্যে আসুক। ‘সার্কেল’ তৈরির পর থেকেই ইরান সরকার নানা অজুহাতে বেশ কয়েকবার গ্রেপ্তার করেছিল তাঁকে। শেষ পর্যন্ত, ২০১০ সালে ইসলামিক প্রজাতন্ত্রের বিরুদ্ধে অপপ্রচারের অভিযোগে ইরানের ইসলামিক কোর্ট তাঁকে ছ-বছরের কারাদণ্ড এবং কুড়ি বছরের জন্য তাঁর ছবি তৈরি, চিত্রনাট্য লেখা, দেশের বাইরে যাওয়া, এমনকী সাক্ষাৎকার প্রদানের ওপরেও নিষেধাজ্ঞা জারি করে।

জাফর পানাহি
তখন জেলে যেতে না হয়নি পানাহিকে, কিন্তু পরিচালকের ওপর বাকি নিষেধাজ্ঞাগুলি বহাল রাখে রাষ্ট্র। “ইফ উই কুড টেল আ ফিল্ম, দেন হোয়াই মেক আ ফিল্ম?” বলেছিলেন পানাহি। এবারে তাঁর এই চিন্তার কাছেই আশ্রয় নিলেন তিনি।পরিচালক মোজতবা মিরতাহমসবের সঙ্গে নিজের অ্যাপার্টমেন্টে বসে তাঁর গৃহবন্দি অবস্থাকে ক্যামেরায় তুলে রাখতে আরম্ভ করলেন। সেখানে দেখা গেল পানাহি নিজের বন্দি-জীবন ও চারপাশের সময়কে মিলিয়ে কথা বলে চলেছেন তাঁর সিনেমাচিন্তা সম্পর্কে। নজরদারির বদলে চাইছেন প্রত্যক্ষ কারাবাস। রাষ্ট্রের দ্বারা নিষিদ্ধ হওয়ার পর এভাবেই তিনি নিজেই নিজের জীবনের ওপর তৈরি করলেন একটি ছিয়াত্তর মিনিটের ডকুমেন্টারি, ‘দিস ইজ নট আ ফিল্ম’। ছবি তো তৈরি করলেন কিন্তু তাকে দেশের বাইরে পাঠাবেন কী করে? ‘দিস ইজ নট আ ফিল্ম’ ছবিটিকে জন্মদিনের কেকের ভেতর লুকিয়ে ফ্ল্যাশ ড্রাইভে ইরান থেকে কান ফিল্ম ফেস্টিভালে পাঠিয়েছিলেন পানাহি। পরে নিউওয়ার্ক ফিল্ম ফেস্টিভালেও দেখানো হয় ছবিটি। এবং ২০১২ সালের অস্কারের শ্রেষ্ঠ ডকুমেন্টারি ফিচার বিভাগে তা মনোনয়ন লাভ করে।
এরপরেও তিনি গোপনে বানিয়েছেন ‘ক্লোজড কার্টেন’, ‘থ্রি ফেসেস’-এর মতো ছবি। ২০১৫ সালে তৈরি করেছেন ‘ট্যাক্সি’। ছবিটিতে দেখা যায় জাফর পানাহি একজন ট্যাক্সি ড্রাইভার হিসেবে সারা ইরান ঘুরে-ঘুরে বিভিন্ন যাত্রীর কাছ থেকে শুনছেন দেশের দারিদ্র, লিঙ্গ-বৈষম্য ও মৃত্যুদণ্ড সম্পর্কে তাঁদের স্বাধীন মতামত। ছবিটি সে-বছর বার্লিন ফিল্ম ফেস্টিভালে ‘গোল্ডেন বিয়ার’ পুরস্কারে সম্মানিত হয়।

'দিস ইজ নট আ ফিল্ম'-এর পোস্টার
এক সময়, সোভিয়েত ইউনিয়ন বরিস পাস্তেরনাকের মৌলিক রচনা প্রকাশের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল। ‘ডক্টর জিভাগো’ লেখার পর বরিস পাস্তেরনাককে নোবেল পুরস্কার নিতে যেতে দেয়নি তাঁর নিজের রাষ্ট্র। আলেকজান্ডার সোলঝিনিৎসিনকে পাঠানো হয়েছিল শ্রমশিবিরে। তিনিও নোবেল পুরস্কার পান এবং দেশ থেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। এখন জাফর পানাহির জীবনচিত্র অনেকটা সেরকমই। তবু, ইরানের স্বৈরাচারী শাসন-ব্যবস্থা পানাহিকে নানাভাবে অত্যাচার করে চললেও, শিল্পের ক্ষমতা আসলে কী তার পরিচয় সারা পৃথিবীর কাছে ক্রমান্বয়ে দিয়ে চলেছেন জাফর পানাহি!