কেউ মধুচন্দ্রিমায় গিয়ে, কেউ পর্যটকদের বাঁচাতে গিয়ে নিহত! পহেলগাঁও প্রাণ কাড়ল যাদের
Pahalgam Attack: ধর্ম পরিচয় জিজ্ঞেস করে হত্যার অভিযোগ উঠলেও, পহেলগাঁওয়ের ওই উপত্যকায় প্রাণ গিয়েছে একজন স্থানীয়েরও, ধর্মে মুসলিম।
মার্চের শেষ থেকে শুরু হয়েছিল কাশ্মীর ভ্রমণের পালা। অধিকাংশ মানুষের ফেসবুক স্ক্রোল করলেই দেখা যাচ্ছিল ভূস্বর্গের নৈসর্গে আনন্দমুহূর্ত উপভোগের ছবি। এখন ফেসবুক জুড়ে হাহাকার। প্রতি সেকেন্ডে ভেসে উঠছে মধুচন্দ্রিমায় গিয়ে স্বামীর লাশ আঁকড়ে বসে থাকা যুবতীর ছবি। সাধারণ মানুষ, উপত্যকায় আনন্দ করছেন, ছবি তুলছেন আর তখনই হামলা! অভিযোগ উঠেছে, ধর্মীয় পরিচয় জেনে খুন করা হয়েছে নিরস্ত্র পর্যটকদের। ২৭ জনের দেহ মিলেছে। যাদের মধ্যে এই বাংলার একাধিক পর্যটকও রয়েছেন।
পহেলগামে জঙ্গি হামলায় প্রাণ হারিয়েছেন তিন বাঙালি, দু’জন কলকাতার, একজন পুরুলিয়ার বাসিন্দা।
কলকাতার বৈষ্ণবঘাটা পাটুলির বাসিন্দা বিতান অধিকারী স্ত্রী সোহিনী এবং সন্তানকে নিয়ে কাশ্মীর ঘুরতে গেছিলেন। মঙ্গলবার এই মর্মান্তিক ঘটনার আগেও বাড়িতে ফোন করেছেন কথা বলেছেন। পরমুহূর্তেই সব শেষ। বিতান ও তাঁর স্ত্রী কর্মসূত্রে থাকতেন ফ্লোরিডায়। গত ৮ এপ্রিল তিন বছরের পুত্র হৃদানকে নিয়ে কলকাতায় আসেন তাঁরা। ১৬ এপ্রিল তিন জনে জম্মু-কাশ্মীর বেড়াতে যান। সেখানে স্ত্রী সোহিনীর চোখের সামনে জঙ্গিরা গুলি করে তাঁর স্বামীকে! বাড়ি ফিরেছে বিতানের নিথর দেহ।
বেহালার সখেরবাজারের বাসিন্দা সমীর গুহও পরিবার নিয়ে কাশ্মীরে বেড়াতে গিয়েছিলেন। স্বামীর দেহ নিয়ে ফিরছেন স্ত্রী শবরী। কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারী সমীর গুহকে স্ত্রীর সামনেই গুলি করে খুন করে জঙ্গিরা। সেই অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে স্ত্রী জানিয়েছেন, মুখোশধারী ছিল সকল জঙ্গিই। সকলকে মাটিতে শুয়ে পড়তে নির্দেশ দিয়েছিল তারা। সকলের হাতেই বন্দুক দেখে বাকি সকলের মতোই সমীর, শর্বরীও ভয়ে শুয়ে পড়েন। তারপর পরিচয় জেনে গুলি করে জঙ্গিরা।
পহেলগাঁওয়ে জঙ্গিদের গুলিতে নিহত হয়েছেন পুরুলিয়ার ঝালদার বাসিন্দা মণীশরঞ্জন মিশ্র। তিনি নিজে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা আইবিতে কাজ করতেন। রাঁচি থেকে সদ্য বদলি হয়ে হায়দরাবাদে যান স্ত্রী, ছেলে এবং মেয়েকে নিয়ে। নবর্ষের দিন, ১৫ এপ্রিল সপরিবার অযোধ্যা যান। সেখান থেকে হরিদ্বার হয়ে পহেলগাঁও। সেখান থেকে বৈষ্ণোদেবী মন্দিরে যাওয়ার কথা ছিল, যোগ দেওয়ার কথা ছিল বাবা, মা এবং ভাইয়ের পরিবারেরও। সেই পরিকল্পনা মতোই মঙ্গলবার ঝালদার বাড়ি থেকে মণীশের পরিবার রওনা দেয় বৈষ্ণোদেবীর উদ্দেশে। কিন্তু ডালটনগঞ্জ পৌঁছনোর পরই ফোনে খবর আসে জঙ্গিহানায় মৃত্যু হয়েছে মণীশের।
আরও পড়ুন- পহেলগাঁও হামলা: কাশ্মীর উপত্যকা জুড়ে কীভাবে কাজ করে কোন কোন জঙ্গি গোষ্ঠী?
জানা গিয়েছে, জম্মু-কাশ্মীরে ছুটি কাটাতে গিয়ে কর্নাটকের মঞ্জুনাথ রাওয়ের মৃত্যু হয়েছে। প্রাণে বেঁচে গিয়েছেন স্ত্রী পল্লবী এবং তাঁদের পুত্র। পল্লবীর দাবি, তাঁর স্বামীকে খুন করার পর জঙ্গিদের একজন তাঁকে বলে, ‘‘তোকে মারব না। যা, মোদিকে গিয়ে বল।’’
বেঙ্গালুরুর ভারত ভূষণকে স্ত্রী সুজাতা আর তাঁর ছোট্ট ৩ বছরের ছেলের সামনে মাথায় গুলি করা হয়। জানিয়েছেন, পহেলগাঁওয়ের বৈসরনের অমন মনোরম তৃণভূমিতে ঘোরার সময় আরবি ভাষায় একাধিক শ্লোগান শুনতে পান তাঁরা। কী ঘটছে তা দেখতে সুজাতা ঘুরে দাঁড়াতেই গুলির শব্দ শুনতে পান।
মধুচন্দ্রিমায় গিয়ে নিহত স্বামীর পাশে যে যুবতীর বসে থাকার ছবি নাড়িয়ে দিয়েছে ভারতবর্ষকে, জানা গেছে দিন সাতেক আগেই ২৬ বছরের বিনয় নরওয়ালের সঙ্গে ২৪ বছরের হিমাংশীর বিয়ে হয়। পেশায় নৌসেনার লেফটেন্যান্ট বিনয়। ভিসার জটিলতায় ইউরোপে মধুচন্দ্রিমার পরিকল্পনা ভেস্তে যায়, বদলে কাশ্মীরে যান তাঁরা। সেখানে নববিবাহিতার চোখের সামনে খুন করে দেওয়া হলো স্বামীকে।
ধর্ম পরিচয় জিজ্ঞেস করে হত্যার অভিযোগ উঠলেও, পহেলগাঁওয়ের ওই উপত্যকায় প্রাণ গিয়েছে একজন স্থানীয়েরও, ধর্মে মুসলিম। পর্যটকদের লক্ষ্য করে জঙ্গিদের গুলি চালানোর মুহূর্তে এক জঙ্গির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে বন্দুক ছিনিয়ে নিতে চেষ্টা করেছিলেন সৈয়দ আদিল হুসেন শাহ। একে ৪৭-এর গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যান তিনিও।
পর্যটকদের টাট্টু ঘোড়ায় চড়িয়ে ঘোরানোই ছিল তাঁর জীবিকা। মঙ্গলবার দুপুরে পর্যটকদের কাছে এসে জঙ্গিরা একে একে গুলি করে হত্যা করতে শুরু করতেই এগিয়ে আসেন আদিল। প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ানে, পর্যটকদের বাঁচাতে এক জঙ্গির হাত থেকে বন্দুক ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন সইদ আদিল। তাঁকে লক্ষ্য করেও গুলি চালিয়ে দেন জঙ্গিরা। ঘটনাস্থলেই মারা যান পরিবারের একমাত্র রোজগেরে সইদ।