বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে হারিয়ে যাচ্ছে ভাষাও! যে ভাবে ধ্বংস ডেকে আনছি আমরা
Climate Change: ক্লাইমেট পরিবর্তনের ফলে এই যে রাতারাতি বাস্তুহারা হল একটি সম্প্রদায়, একটি বিশেষ ভাষাবলম্বী মানুষ, তারা আয়ত্ত করতে বাধ্য হল এক নতুন ধরনের মিশ্র সংস্কৃতি- এই অভিবাসনের জন্য দায়ী পরিবেশ, প্রকৃতি।
দ্রুত বদলে যাচ্ছে জলবায়ু। মনের আনন্দে গাছ কেটে শহর বাড়ানোর ফল হাতেনাতে ভুগছে দুনিয়া। বৃষ্টি কমছে, বাড়ছে গরম। বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে গলে যাচ্ছে হিমবাহ। বেড়ে যাচ্ছে সমুদ্রের জল। ক্রমে বিপন্নতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে গোটা বিশ্ব। আর এই বিপন্নতা কিন্তু শুধু প্রকৃতিগত নয়। জাতিগত, সমাজগত এবং রাজনৈতিকও বটে। একই সঙ্গে ভাষাগতও।
গত কয়েক বছরে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে প্রাকৃতিক বিপর্যয়। কখনও ভূমিকম্প তো কখনও বন্যা, এসে উজাড় করে দিয়েছে শহর কে শহর, গ্রাম কে গ্রাম, এলাকার পর এলাকা। আর তার সঙ্গে হারিয়ে গিয়েছে ভাষা। জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে ভাষা হারিয়ে যাওয়ার সম্পর্ক যে এমন মারাত্মক, তা সম্প্রতি সামনে এসেছে একটি গবেষণায়। গত বছর ভয়াবহ ভূমিকম্পে কার্যত ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল তুর্কি। হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। গত বছর হড়পা বানে ভয়াবহ ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় সিকিম। উত্তরাখণ্ড ও হিমাচল প্রদেশ এখনও যুঝছে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সঙ্গে। প্রতি বছরই প্রকৃতির কোপ এসে কেড়ে নেয় অসংখ্য প্রাণ। নষ্ট হয়ে যায় সভ্যতা।
দেখা যাচ্ছে এই ধরনের প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের জেরে বহু ক্ষেত্রেই হারাতে বসেছে ভাষা। এমনকী ইতিহাস থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে বহু জনজাতি, উপজাতিরাও। আর সেই ছবিটা গোটা বিশ্ব জুড়েই। ২০১০ সালে ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়ে পাকিস্তান। সেই বন্যার মারাত্মক প্রভাব পড়েছিল গিলগিট বালোচিস্তান এবং খাইবার পাথকুনখাওয়ার উত্তরের পার্বত্য অঞ্চলে। আর সেখানে বাস করতেন তোরওয়ালি সম্প্রদায়ের অজস্র মানুষ। বন্যায় ভেসে যায় ক্ষেতের পর ক্ষেত। অজস্র মানুষ তাঁদের বাড়ি হারান। বাধ্য হন তোরওয়ালি মানুষরা এলাকা ছেড়ে পালাতে। সহায়-সম্বল যেটুকু যা বেঁচেছিল, সেসব নিয়ে তারা পৌঁছন প্রায় ৫৯ কিলোমিটার দূরের পশতুন অধ্যুষিত মিঙ্গোরা শহরে।
আরও পড়ুন: লাদাখ আর কিছু দিন, দায় কার?
প্রাণে তো বাঁচলেন তোরওয়ালিরা। কিন্তু বাঁচল না তাঁদের সংস্কৃতি, ভাষা। গ্রাম থেকে উপভাষা বুকে চলে আসা মানুষকে যেমন প্রতিনিয়ত শহুরে ভাষার আগ্রাসন সহ্য করতে হয়, তোরওয়ালিদের সঙ্গে হল ঠিক তেমনটাই। পশতুনদের ভিড়ে গিয়ে ক্রমে হীন, ছোট, সংকীর্ণ হতে লাগল তাঁদের জনজীবন। এই মুহূর্তে মিঙ্গোরা শহরে বসবাসকারী তরুণ-তরুণরা যে ভাষায় কথা বলেন, তা তোরওয়ালিদের আসল ভাষার থেকে অনেকটা আলাদা। তাতে মিশেছে পশতুন সংস্কৃতি। তাঁদের ভাষা থেকে হারিয়ে গিয়েছে বিশুদ্ধ তোরওয়ালি শব্দভাণ্ডার। তার বদলে মিশছে আধো পাঞ্জাবি, আধো পশতু এবং আধো উর্দু বুলি। বিশুদ্ধতা হারানো এক জগাখিচুড়ি ভাষার জন্ম দিচ্ছেন তারা। বয়ে নিয়ে যাচ্ছেন সেই সংকর সংস্কৃতিকে। যা না পুরোটা পশতুনদের, না তোরওয়ালিদের।
এই যে একটি ভাষা বিনষ্ট হয়ে গেল পুরোপুরি, তার দায় কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের ঘাড়েই চাপাচ্ছেন বিশেষজ্ঞেরা। ক্লাইমেট পরিবর্তনের ফলে এই যে রাতারাতি বাস্তুহারা হল একটি সম্প্রদায়, একটি বিশেষ ভাষাবলম্বী মানুষ, তারা আয়ত্ত করতে বাধ্য হল এক নতুন ধরনের মিশ্র সংস্কৃতি- এই অভিবাসনের জন্য দায়ী সম্পূর্ণ ভাবে পরিবেশ, কার্যত প্রকৃতি। আর শুধুমাত্র তোরওয়ালিই নয়। এই ক্লাইমেট বিপর্যয়ের শিকার পাকিস্তানের পার্বত্য উত্তরাঞ্চলের অন্তত তিরিশটি ভাষা একই রকম ভাবে বিপন্ন। বিশেষত সেই ভাষাগুলি, যেগুলো ব্যবহার করেন খুব ছোট জনসংখ্যার মানুষ। হয়তো সেই সংখ্যাটা এক হাজারেরও কম। আর সেই ধরনের ভাষাভাষী মানুষের বলা ভাষা, তাঁদের সংস্কৃতির জন্য ঝুঁকিটা সবচেয়ে বেশি।
পাকিস্তানের চিত্রাল জেলায় পাঁচশোটিরও বেশি হিমবাহ রয়েছে। তার মধ্যে তেরোটি বিস্ফোরণের কবলে পড়েছে সাম্প্রতিক কালে। আর তার কারণটা যে বিশ্ব উষ্ণায়ন, তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। আর এই যে হিমবাহের গলে যাওয়া, তার থেকে তৈরি হওয়া বন্যা, তার জন্য বাস্তুচ্যুত হয়েছেন অসংখ্য উপজাতি, জনজাতির মানুষ। তারা থাকতে বাধ্য হয়েছে অস্থায়ী আশ্রয়ে, হারাতে বাধ্য হয়েছেন ভাষা, সংস্কৃতি, জনজীবন। আর এ ঘটনা যে শুধু ২০১০ সালের গিলগিট বালুচিস্তানেই ঘটেছে, তা নয়। ১৯৯৯ সাল থেকে ২০১৭, কম করে হলেও ১৫টি প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে পাকিস্তান।
২০১৮ সালে এমনই এক বিপর্যয়ের মুখে পড়ে গিলগিট বালুচিস্তানের ঘিজার জেলার বাডসওয়াত গ্রাম। সেখানে বসবাস ওয়াখি সম্প্রদায়ের মানুষের। বন্যা বিপর্যস্ত ওয়াখিরা বাধ্য হন এলাকা ছাড়তে। তারা চলে যান মূল গিলগিট শহরে। আবার একই রকম পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হয় তাদের। মাত্র ৪০ হাজার ওয়াখি ভাষা বলা মানুষগুলোকে রপ্ত করতে হয়েছিল পাকিস্তানের সরকারি ভাষা উর্দু এবং স্থানীয় শিনা ভাষা।
শিনা ভাষার অবস্থাও অবশ্য একই রকম শোচনীয়। এই সব এলাকার বাসিন্দারা ১৯৭৮ ও ২০১০ সালের বন্যায় ঘরবাড়ি হারিয়ে উঠে আসতে বাধ্য হন করাচিতে। ফলে অভ্যস্ত হতে হয় উর্দু বলতে। এই ভাবে বাস্তুচ্যুত অভিবাসী মানুষজন নিজের সংস্কৃতি ভোলেন, শিখতে বাধ্য হন অচেনা বুলি। আর একের পর এক হারিয়ে যেতে থাকে ছোট ছোট জনজাতির ভাষা, গুলিয়ে যায় তাদে সংস্কৃতি। ভৌগোলিক দূরত্ব বাড়তে বাড়তে জীবনের দূরত্ব হয়ে দাঁড়ায় ক্রমশ। ইসলামাাদের ফোরাম ফর ল্যাঙ্গুয়েজ ইনিশিয়েটিভের কর্মকর্তা ফখরুদ্দিন আখুনজাদা জানালেন, চিত্রালের বিপন্ন ভাষাগুলিকে বাঁচাতে, সংরক্ষণ করার সবরকম চেষ্টা তারা করছেন। আসমতুল্লাহ দামেলি নামে এক গবেষক ২০০০ সালে দামেলি ভাষার বর্ণমালা সংকলন করেছিলেন। তিনি জানান, বাড়িতে তাঁরা নিজেদের ভাষায় কথা বলেন এখনও। কিন্তু তার বাইরে সেই ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখা কার্যত একটি চ্যালেঞ্জ।
এমন ছবি শুধু যে পাকিস্তানেই ঘটে, তা নয়। এ ছবি গোটা বিশ্ব জুড়ে। গ্রাম ছেড়ে ভালো পেশা, বেশি রুজির টানে শহরে আসেন মানুষ। রপ্ত করতে শুরু করেন সেই জায়গার আদবকায়দা। এই ভাবে সংস্কৃতি হারায়, তাঁদের নিজস্ব উপাচার হারায়। আর হারায় ভাষা। বড় ভাষা গিলে ফেলে ছোটো জনজাতির ভাষাকে। এডওয়ার্ড কলেজের অধ্যাপক সামিউল্লাহ আরমান এ ক্ষেত্রে ভাষার 'বাজারমূল্য'-এর কথা উল্লেখ করেছেন। যে ভাষার বাজারমূল্য বেশি, সে ভাষাই টিকে থাকে বেশি। পেশোয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি ও ফলিত ভাষাতত্ত্ব বিভাগের প্রধান আমজিদ সেলিম কিন্তু মনে করেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে শুধুমাত্র মানুষ বাস্তুচ্যুত হয় না, বাস্তুচ্যুত হয় সংস্কৃতি। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ছারখার পরিবারগুলো যখন কোনও একটি জায়গায় সরে যেতে বাধ্য হয়, একই সঙ্গে তারা বাধ্য হন প্রভাবশালী ভাষায় কথা বলতে। কারণ সেখানে তাঁদের মাতৃভাষার চল নেই। সেই ভাষায় পড়ানোর মতো স্কুল নেই, দোকানে বাজারে তাঁদের সেই ভাষা কেউ বোঝে না। ফলে অভিযোজিত হতে বাধ্য হন কার্যত তারা।
আরও পড়ুন:কেন হারাল সংস্কৃত ভাষা? প্রাণ ফেরা সম্ভব?
বিবর্তনই সভ্যতার একমাত্র সত্য। আর সেই বিবর্তনের মূল কথাই অভিযোজন। যে জাতি, যে জনগোষ্ঠী সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অভিযোজিত হতে পেরেছে, তারা টিকে গিয়েছে। কিন্তু এই অভিযোজনের ধাক্কায় বহু ক্ষেত্রেই হারিয়েছে ভাষা। জলবায়ুগত সঙ্কট বিপন্ন করে তুলেছে তাদের। যে কোনও ভাষাই বাঁচে মানুষের বলা কথায়, ব্যবহারে। যে ভাষা ব্যবহারে যত জীর্ণ, তার আয়ু ততই দীর্ঘ। যে ডানা দাঁড়ে বসে দানা খেতে অভ্যস্ত, ক্রমে আকাশে ওড়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে সেই ডানা। ভাষার ক্ষেত্রেও এ এক সার সত্য। কিন্তু ভাষাকে বাঁচানোর দায়িত্ব আসলে রাষ্ট্রের। যে ভাবে জলবায়ু পরিবর্তনকে রোখার দায়িত্বও নিতে হবে রাষ্ট্রকেই। বহু বিশেষজ্ঞই মনে করছেন, সংস্কৃতির ক্ষয় রোখার কৌশল হিসাবে আসলে ভাষার ক্ষতির এই ভয়াবহ দিকটিকে জলবায়ু পরিবর্তন নীতি যোগ করার প্রয়োজন রয়েছে। পাঠ্যক্রমে সমস্ত ভাষা অন্তর্ভুক্ত করার জন্য পদক্ষেপও নিতে হবে দেশের সরকারকেই। পাশাপাশি ছোট ভাষা সংরক্ষণের লক্ষ্যে অভিবাসী পরিবারের শিশুদের তা শেখার সুযোগ করে দেওয়ার কাজটিও বর্তায় রাষ্ট্রের কাঁধেই। কিন্তু রাষ্ট্র কি আদৌ সেই দায়িত্বের কথা মনে রেখেছে? সংশয় থেকেই যায়।