মণিপুর থেকে মুর্শিদাবাদ: মেয়েদের লাঞ্ছনাতেই উগ্রবাদীদের জয়?
Murshidabad: ওয়াকফ কতটা ধর্মীয় মাথাব্যথা, আর কতটাই বা তা জমি অধিগ্রহণ জনিত চিন্তা থেকে প্রসূত? ওয়াকফের জমি কি সাধারণ মুসলমানের কাজে লাগে?
মুর্শিদাবাদের ভীত সন্ত্রস্ত মেয়েদের মুখে আজ যে ছায়া, সে ছায়া বিলকিস বানোর। টিভিতে দেখছি ন্যাশনাল কমিশন ফর উইমেন থেকে সভানেত্রী গিয়েছেন মালদার উদ্বাস্তু ক্যাম্পে। তিনি হিন্দু মেয়েদের যৌন হেনস্থার কথা বলছেন সংবাদমাধ্যমকে। অথচ এ এমন এক অদ্ভুত সময়, যখন রাজ্য এবং কেন্দ্র উভয় ক্ষেত্রেই মহিলা কমিশন হয়ে গেছে পিতৃতান্ত্রিক শাসকের ধামাধরা। পূর্বতন রাজ্য মহিলা কমিশনের একাধিক সদস্যের সঙ্গে একাধিকবার কথা হয়েছে সম্প্রতি। কেউ তাঁরা সোচ্চারে সিপিএম, কেউ অ-দলীয় কিন্তু সকলে একবাক্যে বলেন, কেন্দ্র ও রাজ্য দু' জায়গাতেই, মহিলা কমিশন যে কোনও না কোনও দলের এমন বশংবদ হতে পারে, তা আগে ভাবা যেত না। তাই মহিলা কমিশন মেয়েদের সঙ্গে দেখা করতে গেছে, এতেও স্বস্তি পাচ্ছি না। মনে হচ্ছে, কেন্দ্রীয় মহিলা কমিশনের বক্তব্য বিজেপি-শাসিত কেন্দ্রীয় সরকারের কথারই প্রতিধ্বনি নয় তো? ঠিক যেমন সন্দেশখালিতে যখন রাজ্য মহিলা কমিশন যায়, তখন তাদের বক্তব্যও পাখি-পড়া বুলি মনে হয়।
তাই যে মেয়েদের টিভিতে দেখা যায়, যাঁদের কথা শোনা যায়, তাঁদের মুখের ছায়া দেখি, তাঁদের কথা খুঁটিয়ে শুনি। ফোন করি মুর্শিদাবাদের বাসিন্দা পরিচিত মেয়েদের। সবাই হকচকিয়ে আছেন। মুসলমান বান্ধবীরাই বলছেন, হ্যাঁ, বাড়ি ছেড়ে মানুষ পালাচ্ছেন। মেয়েরাও, পুরুষরাও। আরেকটা কথা তাঁরা সবাই বলছেন। অনেক অনেক বয়ঃসন্ধির ছেলে দেখা যাচ্ছে দাঙ্গাবাজদের মিছিলে। ধুলিয়ান, সুতি (এক), সামশেরগঞ্জ… নেতারা বহিরাগত হোক বা না হোক এই উঠতি বয়সের ছেলেরা কিন্তু স্থানীয়ই। প্রতিবেশী, অথচ ঘৃণার বসত ছিল তাদের মনে, যে ঘৃণায় হাওয়া দিয়েছে মৌলবাদীর দল। আরও শুনছি, সেই বয়ঃসন্ধির (মুসলিম) ছেলেরা অনেকেই আর বাড়ি ফেরেনি৷ ফোন অফ রেখেছে। তারা কি গা-ঢাকা দিয়েছে? তারা কি উগ্র মৌলবাদীদের খপ্পরে পড়ল? বেপথু হয়ে গেল না তো? এ প্রশ্ন তাদের বাড়ির লোকেদের।
সেই ছেলেরাই গ্রামের বা প্রতিবেশী গ্রামের মেয়েদের ধর্ষণের হুমকি দিচ্ছে। মায়ের বয়সি, মাসির বয়সি মেয়েদের। মেয়েরা বলছেন, তাঁদের শাঁখা-পলা খুলতে বলা হয়েছে নাকি। তাঁদের শাড়ি ধরে টানাটানি করা হয়েছে। এসব শুনছি আর মনে পড়ে যাচ্ছে, বিলকিস বানোকে ধর্ষণ করেছিল যারা, তারাও সকলেই ছিল তার প্রতিবেশী। গরু দুইয়ে তাদের কারও কারও বাড়িতে রোজ দুধ দিতে যেত বিলকিস।
আরও পড়ুন- পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বাকে গণধর্ষণ, বিলকিস বানো মামলার নেপথ্যে যে ভয়াবহ ইতিহাস
এক্ষেত্রে ছেলেগুলি মুসলমান৷ সেক্ষেত্রে পুরুষেরা ছিল হিন্দু। আক্রান্ত কিন্তু বারবার নারী। মুর্শিদাবাদে তারা ধর্ষিত হয়ত হয়নি এখনও, অন্তত তেমন খবর পাওয়া যায়নি কিন্তু যৌন হেনস্থার ভয় যে তারা পাচ্ছে, তাও কি কম লজ্জার? এই ভয় একজন লিঙ্গরাজনৈতিক কর্মীর কাছে গুরুত্বপূর্ণ। এই ভয় যেমন বর্তমান সময় থেকে উৎসৃত, তেমনই এর এক দীর্ঘ অতীত ধারা আছে। ভীষ্ণ সাহানির ‘তামস’ বা আব্দুস সামাদের ‘দো গজ জমিন’ বা জ্যোতির্ময়ী দেবীর ‘এপার গঙ্গা ওপার গঙ্গা’ উপন্যাসে — সবর্ত্রই দাঙ্গাকালে মেয়েরা লুণ্ঠিত। বিধর্মীর হাত থেকে নিজেদের বাঁচাতে একইভাবে পঞ্জাব দাঙ্গার প্রেক্ষাপটে ভীষ্ণ সাহানির মেয়েরা, বিহার দাঙ্গার সময় আব্দুস সামাদের মেয়েরা, আর নোয়াখালি দাঙ্গার কালে বাঙালি মেয়েরা বাড়ির পিছনের পুকুরে ঝাঁপ দেয়। কিংবা দেশভাগ কালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার খতিয়ান আছে মান্টোর গল্পে। ধর্ষিতার মৃত ঠান্ডা দেহ সেখানে ধর্ষককে বাধা দেয় নিজের প্রেমিকার সঙ্গে যৌন মিলনে (ঠান্ডা গোস্ত)। এই যে পুরুষ, সে তো চূড়ান্ত অসংবেদী নয়! নাহলে পাপবোধ তো তাকে তাড়া করত না! তাহলে কোন কালো জাদুতে পুরুষ ধর্ষক হয়ে ওঠে? সে মন্ত্রের নাম কি ‘ঘৃণা’ নয়? নারীঘৃণা, জাতিঘৃণা।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় মেয়েরাই ‘গণিমতের মাল’। গুজরাত দাঙ্গায় ধর্ষিত হয়েছেন সহস্রাধিক নারী, বিলকিস বানো তাঁদের একজন মাত্র। বিগত দিনে যখন মণিপুরে দাঙ্গা হলো, তখনও লুণ্ঠিত হয়েছিল কুকি নারীই। মেইতেই মেয়েরাই নাকি তাদের তুলে দিয়েছিল নিজের জাতির পুরুষের হাতে। কেন?
নারী যেন রক্তমাংসের মানুষী নয়। সে একটা অশরীরি ধারণা— সম্ভ্রমের, ইজ্জতের, পারিবারিক বা জাতিগত গৌরবের ধারণা। তাকে পেড়ে ফেলতে পারলেই যেন শত্রুপক্ষকে শিক্ষা দেওয়া হয়। শত্রুপক্ষের পুরুষকে বে-ইজ্জত করা যায়। বা সেই ‘অপর’ পুরুষকে না-পুরুষ ঘোষণা করা যায়, কারণ সে পারেনি তার নারীকে ‘রক্ষা’ করতে। শুধু তো সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় নয়, যে কোনও যুদ্ধেই ‘অপর পক্ষের’ মেয়েমানুষের প্রতি যুদ্ধবাজ পুরুষের যৌন লালসা বারবার ধাবিত হয়েছে। বিজিত প্রদেশের নারী যে বিজয়ী পুরুষের ভোগ্য, তা যেন সুপ্রতিষ্ঠিত। নারী আর ভূমি, শাস্ত্রমতে দুই-ই নাকি ‘বীরভোগ্যা’। যুদ্ধশেষে ভূমির মতো নারীকেও তাই অধিকার করে নিতে হয়। ৩৭০ ধারা বাতিল হতেই 'কাশ্মীর কি কলি'-দের বিয়ে করার স্বপ্ন দেখছিল মূল ভূখণ্ডের পুরুষ। এ যৌন ফ্যান্টাসি কেবলই ঠাট্টাযোগ্য, নাকি গভীরতর দুশ্চিন্তার? এ যদি বিচ্ছিন্ন বিকৃতি হয়, তাহলে কুনান ও পোশপরা নামের দু'টি যমজ কাশ্মীরি গাঁয়ে কেন ভারতীয় সেনা গণহারে মেয়েদের ধর্ষণ করেছিল নব্বইয়ের দশকের গোড়ায়? কেন থাংজাম মনোরমার ধর্ষণ ও খুন ঘটে পরের দশকেও? ভার্মা কমিশন ধর্ষণ আইন সংস্কার করতে গিয়ে বলেছিল, আফস্পা অধ্যুষিত এলাকায় যৌন নিগ্রহ হলে তার জন্য কেস দাখিল করতে কেন্দ্রের বিশেষ অনুমতি না লাগাই উচিত৷ সে পরামর্শ গ্রাহ্য হয়নি। নারীর যৌন নিপীড়ন যদি বা নিন্দার্হ হয়, পরাজিত অঞ্চলের নারীর বিজয়ী পুরুষের ভোগ্যে পরিণত হওয়াটা ততটাও খচখচায় না। পৃথিবীর নানা প্রান্তে সে ঘটনা আকছার ঘটে। তুর্কি সৈন্য হোক বা উগ্র আইসিস দল — সকলেই ধরে নেয়, সিরিয়ার কুর্দ অঞ্চল যে যখন দখল করবে, তখন তাদের যৌনদাসী হতে কুর্দ মেয়েরা বাধ্য থাকবে। আবার সম্প্রতি ইউক্রেনকে যেই আক্রমণ করল রাশিয়া, অমনি ইউক্রেনের যুবতীরা দেখল, তাদের টিন্ডার প্রোফাইলে রুশ সেনাদের 'সোয়াইপ' বাড়ছে। শত্রুপক্ষকে মুঠোফোনে কয়েক মিটারের দূরত্বে দেখে তারা ভয়ে কাঁপল। অ্যাকাউন্ট ডিঅ্যাক্টিভেট করল বা বদলাতে লাগল প্রোফাইলে দেওয়া শহরের নাম, ঠিকানা। এ নিরাপত্তাহীনতা চারিয়ে গেছে স্ত্রীলিঙ্গের সমষ্টিগত চেতনায়। মুর্শিদাবাদ থেকে মণিপুর, সব নারীর মুখেই তাই বিলকিস বানোর ছায়া পড়ে।
মনে পড়ে যাওয়া অস্বাভাবিক নয় যে, ২০০৬ সালে যখন প্রিয়াঙ্কা ভোটমাঙ্গে নামের এক দলিত মেয়েকে নগ্ন করে ঘুরিয়ে হত্যা করা হয়েছিল, তখন দলিত কবি সুকীর্থারানির অবসাদ তাঁকে দিয়ে লিখিয়েছিল এক কবিতা 'এল উদাল (আমার শরীর)'। এই কবিতায় নারীশরীরকে প্রকৃতির সমান্তরালে রাখেন কবি। উভয়েই নির্যাতিতা। উভয়েই শরীরের স্বাধিকার ফিরে পেতে চায়। সেই কবিতা দিল্লি ইউনিভার্সিটির সিলেবাস থেকে বাদ গিয়েছিল না ২০১৯ সালে?
আরও পড়ুন- মুর্শিদাবাদ: হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে কাঁটাতারের বেড়া আর কি কাটা যাবে না?
এই যে নারী আর প্রকৃতির তুলনা, এই যে তাদের সমান্তরাল নির্যাতনের কথা সুকীর্থারানির কবিতায়, তারই পুনরাভিনয় এখন চলছে মণিপুর থেকে মুর্শিদাবাদে। ওয়াকফ কতটা ধর্মীয় মাথাব্যথা, আর কতটাই বা তা জমি অধিগ্রহণ জনিত চিন্তা থেকে প্রসূত? ওয়াকফের জমি কি সাধারণ মুসলমানের কাজে লাগে? তা ছিল উলেমা বা ইমামদের কব্জাগত, এবার হবে হয়তো কেন্দ্রীয় সরকার পোষিত শিল্পপতিদের হস্তগত। একইভাবে, মণিপুরে দাঙ্গা লাগিয়ে পাশ হয়েছিল যে জঙ্গল অধিকার সংশোধনী আইন, তাও একান্তই জনজাতি থেকে শিল্পপতিদের হাতে জমির হস্তান্তরমুখী এক আইন। এবার আবারও জমি হস্তান্তর সংক্রান্ত জাতিদাঙ্গায় ধর্ষণের হুমকি পেল নারী, কারণ জমির মতো সেও ‘বীরভোগ্যা’। নারীশরীর চিরদিনই যুদ্ধকালে হয়ে ওঠে অধিকারযোগ্য ভূমির সমান৷
আর যে বিষয়টি আমাদের ভাবিয়ে তুলছে তা হলো, দাঙ্গাকালে বয়ঃসন্ধির বিষাক্ত পৌরুষের তীব্র প্রকাশ। ২০২১ সালে আমরা যখন নো-ভোট-টু-বিজেপি ক্যাম্পেন করছিলাম, বেশ কিছু আশ্চর্য মেসেজ ইনবক্সে পেতাম। হিন্দু বাবা বলছেন, "ছেলে বদলে যাচ্ছে৷ মুখে সারাক্ষণ ঘৃণা, সারাক্ষণ জয় শ্রী রাম। কিছু করা যায় না ওদের জন্য?" সেই ঘৃণা ছিল জাতিঘৃণা, যার সঙ্গে কোনও দিন নারীঘৃণার সংমিশ্রণ ঘটলে (সব ঘৃণার মধ্যে আবার নারীঘৃণায় সামাজিক প্রশ্রয় সবচেয়ে বেশি), সেই ছেলেরা হয়তো বিধর্মীর ধর্ষক হতে পারত। মুর্শিদাবাদে মুসলমান ছেলেরাও কি ঠিক তা-ই হয়ে উঠেছে? বয়েজ লজার রুম সংস্কৃতির অতিযৌনতা আর অতি-আগ্রাসনের সঙ্গে উগ্র মৌলবাদের মিশ্রণ ঘটলে পুরুষ এমন মুসলমান বা হিন্দু মৌলবাদী হয়ে ওঠে৷ শুধু মন্দির-মসজিদ থেকে গেরুয়া বা সবুজ পতাকা খুলে নেওয়ার মধ্যে তারা সীমাবদ্ধ থাকে না। নারীর প্রতি ঘৃণাকে, বিশেষত বিধর্মী নারীর প্রতি ঘৃণাকে তারা পবিত্র ভাবে। ধর্ষণ তখন এক মহৎ কর্তব্য হিসেবে স্বীকৃত হয়ে যায়। গুজরাতে এমন হয়েছে। মুর্শিদাবাদে হওয়া আটকাতেই হবে।
মৌলবাদ আর পিতৃতন্ত্র একে অন্যের হাত ধরে চলে। মৌলবাদের প্রতিটি প্রকাশ পিতৃতান্ত্রিক৷ মৌলবাদে 'অপরের' প্রতি হিংসা ও আগ্রাসন স্বীকৃত। আর এই আগ্রাসন আর হিংসাকেই প্রচলিত অর্থে বলে 'পুরুষালি'। বয়ঃসন্ধির ছেলেদের এক নিদারুণ অধঃপাতের বার্তা নিয়ে এল এই দাঙ্গার নববর্ষ। অথচ যে আগামী ঘৃণার, যে আগামী আগ্রাসী ও পুরুষালি, তা ‘শুভ’ হতে পারে না। ঊর্বশী বুটালিয়া তাঁর ‘দ্য আদার সাইড অফ দ্য সাইলেন্স’ গ্রন্থে উদ্বাস্তু মেয়েদের প্রতি যৌন নির্যাতনের কথা বলতে গিয়ে বারবার দ্বিধাগ্রস্ত হন। তাঁর মনে হয়, তিনি বিভেদকামীদের হাতে অস্ত্র তুলে দিচ্ছেন না তো? এ হলো সংবেদশীল সংখ্যাগুরুর দ্বিধা। কিন্তু তা যেন মেয়েদের ভয়, মেয়েদের অপমান সম্পর্কে সত্য বলতে না আটকায়, অন্তত একজন লিঙ্গ আন্দোলন কর্মীকে৷ ভারতে সংখ্যাগুরুর মেয়েও লিঙ্গপরিচয়ে প্রান্তিক। তাছাড়া মুর্শিদাবাদে সে সংখ্যালঘুও হয়তো। তাই আমরা সতর্ক থাকব, কিন্তু নীরব নয়৷ মেইতেই মেয়ে আর কুকি মেয়েরা ভগিনী হয়ে উঠতে পারেনি। আমরা বরং একবার চেষ্টা করে দেখি?