যে রথ পুরাণের গল্প দেখায়
krishna : নন্দীবাড়ির রথযাত্রার মূল সৌন্দর্য হচ্ছে তার ৯৬ বছরের পুরনো কাঠের তৈরি ন-টি চূড়াবিশিষ্ট রথের গায়ে আঁকা পৌরাণিক কাহিনি।
মাটির বাড়ি, গাছের ছায়া, আঁকাবাঁকা পথ নিয়ে চলে যায় পুকুর ঘেঁষা প্রান্তরে। সেখানেই প্রতিবছর বসে রথের মেলা। আর, সেই মেলায় আলো করে থাকে নন্দীবাড়ির নবরত্নশোভিত রথ। শিয়াখালার কাছে হুগলি জেলার একটি ছোট্ট গ্রাম রামপাড়া। আর সেখানেই ৯৬ বছর ধরে চলছে রথযাত্রা। গ্রামীণ বাংলায় এমন রথযাত্রার তালিকা একাধিক রয়েছে। কিন্তু নন্দীবাড়ির রথযাত্রার মূল সৌন্দর্য হচ্ছে তার ৯৬ বছরের পুরনো কাঠের তৈরি ন-টি চূড়াবিশিষ্ট রথের গায়ে আঁকা পৌরাণিক কাহিনি। তারাপদ সাঁতরা তাঁর লেখা 'পশ্চিমবঙ্গের লোকশিল্প ও শিল্পীসমাজ' বইতে এই ধরনের অংকনশৈলীকে 'রথচিত্র' বলে অভিহিত করেছিলেন। আধুনিক সময় রথচিত্র কার্যত বিলুপ্তির পথে এগিয়ে চলেছে। বাংলার শতাব্দীপ্রাচীন এই শিল্প এখনকার সময় খুব কমই দেখা যায়। সেই বিলুপ্তপ্রায় তালিকার মধ্যে রয়েছে রামপাড়ার নন্দীবাড়ির রথ।

নন্দবাড়ির রথ
রথের কাঠ-কাঠামোর মধ্যে লক্ষ করা যায়, পুরাণের নানা দৃশ্যকথা ছবি হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। আসলে, কাহিনিকে ছবির আকারে মানুষ বরাবরই দেখতে চায়। সেই দেখতে চাওয়ার মধ্যে রয়েছে ইতিহাস-অন্বেষণও। বাংলার পোড়ামাটির মন্দিরে, বহু পৌরাণিক ঘটনাবলী, এমনকী ঔপনিবেশিক সময়ের সমাজচিত্রের দেখাও পাওয়া যায়। আর, বাংলার রথগুলি যেহেতু এই পোড়ামাটির মন্দিরের চলমান সংস্করণ, তাই সেখানেও পৌরাণিক ঘটনার সমাহার লক্ষণীয়।
আরও পড়ুন-
কোথাও গাত্রবর্ণ নীল, কোথাও আছে হাত! বাংলার মাটির জগন্নাথ কেন বৈচিত্র্যে ভরা?
কৃত্তিবাসের রামায়ণে দেখা যায়, একশতআট নীল পদ্ম না-পেয়ে রামচন্দ্র নিজের চোখের মণি মা দুর্গাকে দিতে যাচ্ছেন। বনবাসী রামচন্দ্রের এই ভক্তি দেখে মা দুর্গা তাঁকে নিজের চোখের মণি দেওয়া থেকে বিরত করেছিলেন। এই নাটকীয় দৃশ্যকে অনুপম শৈলীতে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে রথের গায়ে। এর মধ্যে মা দুর্গার অলংকরণটি অনবদ্য। রথের দৃশ্যাবলীর মধ্যে দেখা যায়, রামায়ণের বিবিধ ঘটনাবলী। যেমন, বিশ্বামিত্রের নির্দেশে লক্ষণকে সঙ্গে নিয়ে তাড়কা রাক্ষসীকে বধ করতে যাচ্ছেন রামচন্দ্র। জঙ্গল থেকে ধেয়ে আসছে তাড়কা। পাশে দাঁড়ানো বিশ্বামিত্র তর্জনী তুলে রাজকুমার রামচন্দ্রকে নির্দেশ করছেন তির ছোড়ার জন্য। এরই সঙ্গে রথের গায়ে রয়েছে, অহল্যার শাপমোচনের দৃশ্যও।
এক্ষেত্রে লক্ষণীয়, বাঙালির গোঁফওয়ালা সবুজ গাত্রবর্ণের যোগী রামের বদলে এখানে রামচন্দ্রের গাত্রবর্ণ নীল। রামের কোনো গোঁফ নেই। তবে বৈষ্ণবীয় প্রভাবে হাতে তির-ধনুক নিয়েও সে শান্ত,সরল ও সমাহিত। মুখে জেগে রয়েছে সদাহাস্যময়তা। যেন, তিনিই করুণার সিন্ধু। রাম-রাবণের যুদ্ধের অন্তিম লড়াইয়ের দৃশ্যাবলীও দেখা যায় এই রথের গায়ে। একদিকে বানরসসেনা, অন্যদিকে রাবণের নেতৃত্বে লঙ্কাবাহিনী। রাবণ যেন একজন বাঙালিবাবু হয়ে উঠেছেন। সাদা রঙের ধুতি ও লাল পাঞ্জাবি পরে নিজের বাহিনীকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন দশানন।
আরও পড়ুন-
রথ দেখা ও কলা বেচার প্রবাদের শুরু বাংলার এই রথযাত্রা থেকেই
শিবের জটা থেকে গঙ্গাকে মর্ত্যে ভগীরথ নিয়ে আসছেন। রথের গায়ে, কাহিনীটির স্থির চিত্রদৃশ্যাবলীর মধ্যে রয়েছে অদ্ভুত চলমানতা। শ্রীকৃষ্ণের লীলা মাহাত্ম্যের মধ্যে রয়েছে কালিয়াদমন, পুতনাবধ, নবজাতক কৃষ্ণকে কংসের কারাগার থেকে ঝড়-জলের রাত্রে উদ্ধার করে নিয়ে চলেছেন পিতা বসুদেব প্রভৃতি কাহিনিচিত্র। অন্যদিকে, শিবের বিয়ের দৃশ্যাবলী এবং মা দুর্গার সপরিবারে শরৎকালে মর্ত্যে আগমনের দৃশ্যে নাম না-জানা শিল্পীরা নিজেদের দক্ষতার স্বাক্ষর রেখেছেন। বাংলার শিবের গোঁফ থাকলেও, এখানে শিবের কোনও গোঁফ নেই। যদিও শরীরী স্থূলতা অপরিবর্তনশীল। শিবের বিয়ের দৃশ্যে যে-সকল নারী মূর্তি রয়েছে তাদের অভিব্যক্তির মধ্যে বঙ্গরমনীর লাজুক মনোভাব দেখা যায়। কুর্ম,বরাহ,বামনসহ বিষ্ণুর দশ অবতারই রথচিত্রের মধ্যে স্থান পেয়েছে।

রথের গায়ে পুরাণের কাহিনিদৃশ্য
রথের গায়ে, নৃত্যরত মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্য ও তাঁর কীর্তনের পারিষদবর্গের চিত্ররূপ রথের ভক্তিআবহকে এক অন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছে। থালা-ভর্তি মিষ্টান্ন ও ফুল নিয়ে দাঁড়িয়ে বঙ্গ রমনীর পাশে কাত্যায়নীর, শৈলপুত্রী, কৌমারি, অন্নপূর্ণা মাতৃশক্তির অনন্য রূপকে তুলে ধরেছেন। রথের চারটি কোণে চারটি কাঠের মূর্তি রয়েছে। রথের সামনের দিকে রয়েছেন কৃষক এবং বটি দিয়ে মাছ কাটা এক রমণী। রথের পেছনদিকে রয়েছেন কপালে তিলক, গলায় তুলসীর মালা এবং হাতের জপের মালা নিয়ে বসে থাকা গোঁসাই। তার পাশেই, ঢোলক বাজাচ্ছেন এক রমণী। কাঠের তৈরি এই চারটি প্রতিমার মধ্যে তৎকালীন জীবনের-যাপনের কথা তুলে ধরা হয়েছে। রথের পাঁচটি চূড়ার চারটির ওপরে নারীমূর্তি বসানো। পঞ্চম তথা সুউচ্চ চূড়ায় বিরাজ করছে গরুড়। রথের সামনের দিকে কাঠের তৈরি সারথি বিরাজ করছেন। রথের চারটি কোণায় কাঠ খোদাই করে যুদ্ধ ও শিকারের দৃশ্যাবলী অনবদ্য আঙ্গিকে তুলে ধরা হয়েছে।
রথের একটি দৃশ্য দেখে সহজেই চোখ আটকে যায়। সেখানে সবুজ ও বিভিন্ন রঙের উর্দি পরে, হাতে বন্দুক নিয়ে এগিয়ে চলেছে যোদ্ধারা। রথটি যেহেতু বারে-বারে সংস্কার হয়েছে, তাই স্বাধীন ভারতের সেনাবাহিনীর দৃশ্যাবলী এতে সময়ের সঙ্গে-সঙ্গে জুড়ে গিয়েছে। জানা যায়, রথটি শেষ তিন বছর আগে সংস্কার করা হয়েছিল। নন্দীবাড়ির পরিবারের কথায়, আজকের সময় আগেকার দিনের মতন শিল্পীদের আর পাওয়া যায় না যাঁরা এই রথচিত্রগুলিকে সুন্দরভাবে সংরক্ষিত করতে পারবেন। ফলে, রথের গায়ে কয়েকটি চিত্র ক্ষতিগ্রস্তও হয়েছে। সেগুলি সম্পূর্ণ ফিরিয়ে আনা খুবই কঠিন।
প্রতিবছর রামপাড়ার স্থানীয়রা রথের মেলাকে ঘিরে ভক্তিভরে উদযাপন করেন জগন্নাথের আরাধনা। এই আরাধনার মধ্যে ফেলে আসা অতীতের প্রতি ভালোবাসা ও সম্মান দুটোই মিশে থাকে। নন্দীবাড়ীর রথ শুধুমাত্র একটি ভক্তি বা বিশ্বাসের স্তম্ভ নয়, তা হয়ে উঠেছে পুরান ও মহাকাব্যের বিভিন্ন গল্পের এক প্রদর্শনশালা। হুগলি জেলার অন্য দুই ডাকসাইটের রথযাত্রা, যেমন মাহেশ ও গুপ্তিপাড়ার পাশে, অবশ্যই রথের নান্দনিকতার দিক দিয়ে এক বিশেষ স্থান করে নেবে রামপাড়া এই নন্দীবাড়ির রথ।