কেন ভারতীয় নার্স নিমিশা প্রিয়া-কে মৃত্যুদণ্ডের শাস্তি দিল ইয়েমেন সরকার?
Nimisha Priya: ২০১৭ সালে মেহদির মৃতদেহ পাওয়ার পর, পুলিশ নিমিশার বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ তোলে। পুলিশ জানায়, অতিরিক্ত মাত্রায় ঘুমের ওষুধ খাইয়ে হত্যা করার পর দেহটি টুকরো টুকরো করে কেটে ফেলা হয়েছিল।
ইয়েমেন সরকার জানিয়ে দিল, নিমিশা প্রিয়ার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হবে ১৬ জুলাই। ৩৪ বছর বয়সি ভারতীয় নার্স নিমিশা প্রিয়া ইয়েমেনে থাকতেন। পরিবার তাকে বাঁচানোর জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। কেন মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হলো নিমিশা প্রিয়াকে?
নিমিশা কেরালার বাসিন্দা। মৃত্যুদণ্ডের রায়ে সিলমোহর পড়েছিল ছ’মাস আগেই। ২০১৭ সালে নিমিশার ব্যবসার অংশীদার, ইয়েমেনি নাগরিক তালাল আব্দো মেহদীর টুকরো টুকরো দেহ একটি জলের ট্যাঙ্ক থেকে উদ্ধার করা হয়। ২০১৮ সালে তাকে দোষী সাব্যস্ত করে ইয়েমেনের আদালত। নিমিশাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। এখন ইয়েমেনের রাজধানী সানার কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি আছে নিমিশা প্রিয়া।
১৯ বছর বয়স থেকেই নিমিশা ইয়েমেনে থাকে। তার মা ছিলেন গৃহকর্মী। তিনি ইয়েমেনের রাজধানী সানার একটি সরকারি হাসপাতালে নার্সের কাজ করত। কয়েকবছর পরে কেরালার কোচিতে তার বাড়িতে ফিরেও এসেছিল। বিয়ে করে এক অটো চালককে। নাম টনি থমাস। বিয়ের কিছুদিনের মধ্যেই ওই দম্পতি ইয়েমেনে ফিরে যায়। তবে আর্থিক অনটনের কারণে তাদের মেয়েকে নিয়ে ভারতে ফিরে আসেন থমাস। নিমিশা একটু বাড়তি আয়ের আশায় ইয়েমেনের সরকারি হাসপাতালে নার্সের কাজ করতে করতে নিজের ক্লিনিক খোলার সিদ্ধান্ত নেয়।
আরও পড়ুন- ডাইনি অপবাদে গোটা পরিবারকেই খুন! এই বর্বরতার শেষ কোথায়?
ইয়েমেনের আইন অনুযায়ী, ওই দেশে ব্যবসা করতে গেলে একজন স্থানীয় অংশীদার থাকা জরুরি। তাই মেহদির সঙ্গে ক্লিনিক খোলার সিদ্ধান্ত নেয় নিমিশা। প্রথমে দুজনের সম্পর্ক ভালই ছিল। মেয়ের ব্যাপ্টিজমের জন্য যখন নিমিশা ভারতে আসে, মেহদিও তার সঙ্গে আসে। কিন্তু ইয়েমেনে গৃহযুদ্ধ শুরু হতেই ২০১৪ সাল থেকে মেহদির ব্যবহার পাল্টে যায়। নিমিশা তখন স্বামী আর কন্যাকে ইয়েমেনে আনার ব্যবস্থা করতে ব্যস্ত। কিন্তু ইয়েমেনে গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে ভারত সরকার ইয়েমেনে কোনো নাগরিককে যাওয়ার অনুমতি দিচ্ছিল না। কিছুদিনের মধ্যেই কয়েক হাজার ভারতীয়কে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়েছিল। নিমিশা ক্লিনিকের জন্য বড়ো অঙ্কের অর্থ ঋণ নিয়েছিল বলে দেশে ফেরেনি। তখন থেকেই মেহদির আচার আচরণ নিয়ে নিমিশা অভিযোগ জানাতে শুরু করে স্বামীকে।
'সেভ নিমিশা প্রিয়া ইন্টারন্যাশনাল অ্যাকশন কাউন্সিল' নামে এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা আদালতে পিটিশনে জমা দিয়ে জানিয়েছিল, মেহদি নিমিশার সব টাকা-পয়সা নিয়েছিলেন। এমনকি পাসপোর্টও নিজের কাছে রেখে দিয়েছিলেন। মাঝে মধ্যেই নিমিশাকে বন্দুক দেখিয়ে ভয় দেখানো হতো।
আরও পড়ুন-ডাক্তার সময় বেঁধেছিলেন ৩ মাস! যে টোটকায় ক্যান্সারকে হারিয়ে সচল ১০৩ বছরের বৃদ্ধ
২০১৭ সালে মেহদির মৃতদেহ পাওয়ার পর, পুলিশ নিমিশার বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ তোলে। পুলিশ জানায়, অতিরিক্ত মাত্রায় ঘুমের ওষুধ খাইয়ে হত্যা করার পর দেহটি টুকরো টুকরো করে কেটে ফেলা হয়েছিল। নিমিশা আদালতে এইসব অভিযোগ অস্বীকার করেন। তার আইনজীবী আদালতে বলেছিলেন, মেহদিকে ঘুমের ওষুধ দিয়ে অজ্ঞান করে শুধুমাত্র পাসপোর্ট নিতে চেয়েছিলেন কিন্তু ওষুধের মাত্রা বেশি হয়ে গিয়েছিল। ২০২০ সালে এক স্থানীয় আদালত তাকে মৃত্যুদণ্ডের সাজা দেয়। প্রায় তিন বছর পর তার পরিবার ওই সাজার বিরুদ্ধে ইয়েমেনের সুপ্রিম কোর্টে আপীল করেছিল, কিন্তু তা খারিজ হয়ে যায়।
শরিয়া আইন অনুযায়ী, মৃত্যুদণ্ড তুলে নেওয়া সম্ভব যদি নিহতের পরিবার নিমিশাকে ক্ষমা করে দেন। ইয়েমেনের আইন অনুযায়ী, নিমিশার পরিবার সরাসরি নিহতের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারবে না, এর জন্য মধ্যস্থতাকারীর প্রয়োজন হয়। ইয়েমেনের একজন সমাজকর্মী স্যামুয়েল জেরোম দুই পরিবারের মধ্যে কথাবার্তা চালান। নিহতের পরিবারকে দেওয়ার জন্য প্রিয়ার পরিবার পরিজনরা 'দিয়া' বা 'ব্লাড মানি' (নিহতের পরিবারের নির্ধারিত ক্ষতিপূরণের অঙ্ক) জোগাড় করছেন। এই নিয়ে দুই পক্ষের আলোচনাও হয়েছে।
নিমিশার মা মেয়ের জীবন বাঁচাতে বেশ কয়েক বছর ধরে ইয়েমেনেই রয়েছেন। নিমিশাকে বাঁচাতে 'সেইভ নিমিশা প্রিয়া ইন্টারন্যাশনাল অ্যাকশন কাউন্সিল' নামের একটি গ্রুপ ভারতে ও ভারতের বাইরে বিভিন্ন দেশে গড়ে তোলা হয়েছে। ওই গ্রুপের সদস্যরা ক্রাউডফান্ডিং-এর মাধ্যমেও অর্থ সংগ্রহ করছে। কিন্তু নিহতর পরিবার দিয়া নিতে রাজি কি না, সেটা এখনও স্পষ্ট নয়। এরই মাঝে মৃত্যুদণ্ডের নির্দিষ্ট তারিখ ঘোষণা করা হয়ে গিয়েছে। নিমিশাকে বাঁচাতে তাঁর পরিবার ও সমর্থকদের হাতে আর সপ্তাহখানেকও সময় নেই। কী হয় তাই এখন দেখার।