বালুচিস্তানে দিশেহারা পাকিস্তান! বিশ্বের নজর ঘোরাতেই পহেলগাঁও হামলা?

Pakistan Balochistan Issue: বালুচিস্তান স্বাধীন রাষ্ট্র হলে, ইরান ও আফগানিস্তানকে চাপের মধ্যে রাখতে গেলে বালুচিস্তান এক কার্যকর কৌশলগত ঘাঁটি হয়ে উঠতে পারে ওয়াশিংটনের জন্য।

২২ এপ্রিল ২০২৫। বসন্তকাল পেরিয়ে কাশ্মীরের পাহাড়ি উপত্যকায় তখন ধীরে ধীরে গরম পড়ছে। তুষারের স্তর গলতে শুরু করেছে, চারপাশে ছড়িয়ে পড়েছে পাহাড়ি ফুলের সুবাস। এমন সময়েই, পরিবারের সঙ্গে পাহাড়ি উপত্যকায় ছুটি কাটাতে আসা সাধারণ পর্যটকদের উপরে নেমে আসে এক বিভীষিকার ছায়া। পহেলগাঁও— যে স্থান ভ্রমণপিপাসুদের কাছে শান্তির আশ্রয়, প্রকৃতির কোলে কয়েকদিনের মুক্তি— সেই জায়গাই এক নিমেষে পরিণত হয় মৃত্যু উপত্যকায়। অজ্ঞাতপরিচয় সশস্ত্র জঙ্গিরা এলোপাথাড়ি গুলি চালিয়ে হত্যা করে ২৬ জন ভারতীয় পর্যটককে। এই হামলায় প্রাণ যায় আরও দু'জন বিদেশি পর্যটকের এবং এক স্থানীয় তরুণের, যিনি জীবিকা নির্বাহ করতেন টাট্টু ঘোড়া চালিয়ে।

এই মৃত্যু শুধু রক্তে রাঙানো নয়, এর অন্দরে রয়েছে এক অদৃশ্য কিন্তু গভীর রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট। একটি প্রশ্ন ক্রমেই জোরালো হচ্ছে— এই হামলার পিছনে কি শুধু কাশ্মীরকে অস্থির রাখাই মূল লক্ষ্য ছিল? না কি এর ছায়ায় লুকিয়ে আছে আরেক ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ? বিশেষ করে যখন আমেরিকার উপ-রাষ্ট্রপতি জে ডি ভান্স ভারতে অবস্থান করছেন, তখনই এই হামলার কারণ কী? জঙ্গিদের অমুসলিমদের উপরে 'বদলা' নেওয়ার মনোবৃত্তি না কি পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ সংকট থেকে আন্তর্জাতিক মনোযোগ সরিয়ে নেওয়ার অপচেষ্টা?

এই মুহূর্তে ভারতের প্রতিবেশী রাষ্ট্র পাকিস্তানের রাজনৈতিক এবং আর্থসামাজিক পরিস্থিতি একেবারেই হাতের বাইরে চলে গেছে। বিগত কয়েক বছরের তুলনায় এবছরে পাকিস্তানের দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির হার অনেকটাই বেশি। আন্তর্জাতিক রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ আর্থিক বছরে পাকিস্তানের দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির হার দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩৮ শতাংশ। পাশাপাশি, পাকিস্তানের বালুচিস্তান প্রদেশে অস্থিরতা ক্রমশ বাড়ছে। বালুচিস্তানে সেনাবাহিনীর দমননীতি, গুম হয়ে যাওয়া নাগরিক এবং গোপন বন্দিশিবিরের বিরুদ্ধে যেভাবে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলি সরব হচ্ছিল, তাতে পাকিস্তান সরকারের উপর বাড়ছিল চাপ। এমন প্রেক্ষাপটে ভারতের ভূখণ্ডে এমন এক নিষ্ঠুর হামলা কেবল এক দুঃখজনক ঘটনা নয়— এ এক সম্ভাব্য রাজনৈতিক কৌশল, এক মনোযোগ ঘোরানোর পর্দা।

তাই এই হামলাকে কেবল বিচ্ছিন্ন সন্ত্রাসবাদী তৎপরতা হিসেবে না দেখে বৃহত্তর কূটনৈতিক প্রেক্ষাপট হিসেবেও দেখতে চাইছেন অনেক রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ। ফিরে তাকানো যাক বালুচিস্তানের সমস্যার দিকে— যেখানে বহু যুগ নিঃশব্দে রচিত হচ্ছে বহু নামহীন বিদ্রোহের গল্প।

শরিফের গলার কাঁটা বালুচিস্তান

১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা লাভের পর থেকে পাকিস্তান বহু সমস্যার সম্মুখীন হয়ে এসেছে। মিলিটারি শাসন থেকে রাজনৈতিক সমস্যা, সবকিছুই পাকিস্তানের একটা অংশ হিসেবে ছিল বহু বছর ধরে। সঙ্গে জঙ্গি সমস্যা তো লেগেই রয়েছে। বর্তমানে পাকিস্তানের আর্থসামাজিক পরিস্থিতি মোটেও ভালো জায়গায় নেই। নিজেদের মানুষদের কীভাবে বাঁচাবে, সেটাই এখন তাদের বড় চিন্তা। তারই মধ্যে পাকিস্তানের গোদের উপর বিষফোঁড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে বালুচিস্তান। পাকিস্তানের দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত এই প্রদেশটি আর পাকিস্তানের সঙ্গে থাকতে একেবারেই রাজি নয়। নিজেদের সেনাবাহিনী তৈরি করে প্রতিদিন পাকিস্তানের সৈন্যদের উপর হামলা চালাচ্ছে। কিছুদিন আগেই, পাকিস্তানের একটি ট্রেন হাইজ্যাক করে সরাসরি ইসলামাবাদকে চ্যালেঞ্জ করেছিল বালুচিস্তান। তাই এখন আর শুধুই দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি নয়, বালুচিস্তান সমস্যাও হয়ে উঠেছে পাকিস্তানের গলার কাঁটা।

বালুচিস্তানের অবস্থান

পাকিস্তান মূলত চারটি প্রদেশে বিভক্ত — উত্তরে খাইবার পাখতুনখাওয়া, যার সীমান্ত রয়েছে আফগানিস্তানের সঙ্গে, এর পাশেই রয়েছে পঞ্জাব, সীমান্ত ভাগাভাগি করছে ভারতের সঙ্গে, ভারতের গুজরাতের উপর দিকে রয়েছে সিন্ধ প্রদেশ এবং সিন্ধ প্রদেশের বাঁদিকে ইরান এবং আফগানিস্তানের সঙ্গে সীমান্ত ভাগাভাগি করে রয়েছে বালুচিস্তান। কিন্তু হঠাৎ এভাবে এই অঞ্চলে এত বিদ্রোহ কেন শুরু হলো? কেন বালুচ প্রদেশের বাসিন্দারা পাকিস্তানের সঙ্গে আর থাকতে চাইছে না? কিছু শতাব্দী আগে যেতে হবে এর উত্তর পেতে।

বালুচ উপজাতিদের আগমন

বিগত দ্বাদশ শতাব্দীতে এই অঞ্চলে এসে বসবাস করতে শুরু করে কিছু বিশেষ আদিবাসী উপজাতিগোষ্ঠী। এই উপজাতিরা ছিল বালুচ। মাকরান উপজাতি, কাচ্চি উপজাতি, তারবাট উপজাতি এবং সিস্টান উপজাতির মতো ৪৪টি উপজাতিগোষ্ঠী এই অঞ্চলে বসবাস শুরু করে। তাদের মধ্যে কোনও রাজনৈতিক মতাদর্শ ছিল না, একসঙ্গে থাকার কোনও চাহিদা বা প্রয়োজন কিছুই ছিল না। এরা নিজেদের আলাদা সর্দার নির্বাচন করত এবং নিজেদের মধ্যেই থাকত। আজকের বালুচিস্তান, ইরান এবং আফগানিস্তানের কিছুটা অংশ নিয়ে তারা নিজেদের আস্তানা তৈরি করেছিল।

দ্বাদশ শতাব্দীর শেষদিকে এই অঞ্চলে মীর জালাল খান নামের একজন নেতার আগমন ঘটে। তিনি এই অঞ্চলের ৪৪টি উপজাতি গোষ্ঠীর সঙ্গে একসঙ্গে বসে আলোচনা করেন এবং সবাইকে একত্র করে তৈরি করেন একটি জোট। এই আলোচনা থেকে উঠে আসে একটি বিশেষ মডেল, যেখানে ঠিক করা হয় প্রতিটি উপজাতিগোষ্ঠীর একজন নির্দিষ্ট সর্দার থাকবেন এবং তিনি সেই গোষ্ঠীকে পরিচালনা করবেন। পাশাপাশি, বড় সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য একজন নেতা নির্বাচিত হবেন, যার কথামতো বালুচ গোষ্ঠীগুলি কাজ করবে। প্রাথমিকভাবে মীর জালাল খান এই উপজাতিদের জোটের নেতা নির্বাচিত হন এবং তাঁর আমলেই আজকের বালুচিস্তান তৈরির ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করা হয়।

একটা দীর্ঘ সময় পর্যন্ত এই মডেল ভালোভাবেই চলছিল, কিন্তু সমস্যা শুরু হয় ১৬৬৬ সালে ইরানে সফাবিদ সাম্রাজ্য বড় হতে শুরু করলে। একদিকে তখন ভারতে মুঘল সাম্রাজ্য বিরাট আকার ধারণ করেছে। তাই দু'টি বড় সাম্রাজ্যের মাঝখানে অবস্থানের কারণে চাপে পড়ে যায় এই উপজাতি গোষ্ঠীগুলি। সেই কারণে, এবার তারা একটি কেন্দ্রীয় পরিচালন পদ্ধতি তৈরির জন্য উদ্যোগী হয়।

এই সবক'টি উপজাতিদের মধ্যে একটি উপজাতি ছিল আহমেদজাই ব্রাহুই উপজাতি এবং তারা বসবাস করত ভারতের সঙ্গে সীমান্ত লাগোয়া সব থেকে ধনী এবং উন্নত কালাত অঞ্চলে। এই উপজাতির সর্দার ছিলেন মীর আহমেদ খান। এই অঞ্চলটি থেকে সমগ্র বালুচ প্রদেশের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখা সহজ ছিল, সেই কারণে কালাত অঞ্চলটিকে বালুচ প্রদেশের রাজধানী হিসেবে নির্বাচিত করা হয় এবং মীর আহমেদ খান হয়ে যান খান অফ কালাত অর্থাৎ, বালুচ উপজাতিদের একপ্রকারের সর্বময় কর্তা। আর পুরো বালুচ প্রদেশের নাম হয়ে যায় খানেট অফ কালাত। এরপর ১৭৪৯ সালে মীর আহমেদ খানের পৌত্র মীর নাসির খান খান অফ কালাত হন এবং তিনি প্রথম এই অঞ্চলে একটি রাজনৈতিক সিস্টেম ও একটি বালুচ কাউন্সিল তৈরি করেন। নাসির খান বালুচ আর্মিও তৈরি করেন যেখানে ২৫ হাজারের বেশি সৈন্য এবং ১০০০-এর বেশি উট ছিল।

দ্য গ্রেট গেম - বাফার জোনের প্রতিষ্ঠা

১৮৩০ সাল এলে ধীরে ধীরে রাজনৈতিক পরিস্থিতি পাল্টাতে শুরু করে। অবিভক্ত ভারতে সেই সময় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি রাজত্ব করতে শুরু করেছে। একই সময়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন মধ্য এশিয়ার দিকে হাত বাড়াতে শুরু করেছে। ঠিক এই সময় ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে শুরু হয়েছিল এক ভূ-রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব যাকে বলা হয় দ্য গ্রেট গেম। মধ্য এশিয়ার একটি বিরাট অঞ্চল নিজেদের আওতায় আনার জন্য দু'টি পরাশক্তিই চালিয়ে যাচ্ছে লড়াই। আজকের কাজাকিস্তান, উজবেকিস্তান, ও তুর্কমেনিস্তানের এই অঞ্চলটি রাজনৈতিক এবং ব্যাবসায়িক দিক থেকে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সিল্ক রুট এবং অন্যান্য সমস্ত বাণিজ্যিক পথ এই অঞ্চলের উপর দিয়ে যেত। তাই যার হাতে থাকবে এই অঞ্চলের ক্ষমতা, ব্যাবসার ক্ষেত্রে সেই শক্তিই হবে অগ্রণী। রাশিয়া প্রথমেই এই বিষয়টার দিকে নজর রাখে এবং তারা মধ্য এশিয়ার কাজাকিস্তান এবং উজবেকিস্তান দখল করার পর সরাসরি আফগানিস্তানের দিকে এগোতে শুরু করে। ১৮৩৭ সালে আফগানিস্তানের শাসক দোস্ত মহম্মদের সঙ্গে রাশিয়া কথাবার্তা শুরু করে।

এই বিষয়ে জানতে পেরে কিছুটা ভীত হয়ে পড়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। তারাও পাল্টা আফগানিস্তানের উপরে প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বুঝতে পারে, যদি কোনওভাবে রাশিয়া আফগানিস্তান দখল করে নেয়, তাহলে সরাসরি ভারতের সীমান্তে আসতে খুব একটা বেশি সময় লাগবে না তাদের। তখন কিন্তু ব্রিটিশ সাম্রাজ্য সমস্যায় পড়ে যাবে। সেই কারণে, আফগানিস্তানকে নিজেদের দিকে টানার জন্য উঠে পড়ে লাগে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। তারা সিদ্ধান্ত নেয়, রাশিয়া এবং ভারতের মধ্যে একটা বাফার জোন তৈরি করতে হবে এবং সেই অঞ্চলের ক্ষমতা নিজের হাতে রাখবে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। ঠিক করা হয়, আফগানিস্তান হবে সেই বাফার জোন।

কিন্তু, ভারত থেকে আফগানিস্তানে সেনা পৌঁছনো তো এত সহজ নয়। উত্তরের যে রাস্তা রয়েছে, সেখানে শিখ সাম্রাজ্য এবং সেই সাম্রাজ্যের রাজা রণজিৎ সিং সমস্যায় ফেলে দেবেন। ফলে বিকল্প রাস্তার প্রয়োজন। তখনই ব্রিটিশরা সিদ্ধান্ত নেয়, কালাত অঞ্চলের উপর দিয়ে যাবে তাদের সেনা। বোলান পাস, কোটা এবং চামানের উপর দিয়ে ভারতীয় ব্রিটিশ সেনা পৌঁছবে আফগানিস্তান। সেই কারণে ব্রিটিশ সরকার আর্থিক সাহায্যের বিনিময়ে তৎকালীন খান অফ কালাত মেহরাব খানের সঙ্গে একটি চুক্তি করে। ১৮৩৯ সালে এই চুক্তি স্বাক্ষর হয় এবং তারপর ব্রিটিশ সৈন্য এখান থেকে যাওয়া শুরু করে।

চুক্তি স্বাক্ষর হয়ে গেলেও, ওই এলাকার স্থানীয় উপজাতিরা কিন্তু এই সিদ্ধান্তে খুব একটা খুশি ছিলেন না। সেই কারণে, তারা এই চুক্তির উল্লঙ্ঘন করে ব্রিটিশ সৈন্যদের উপর হামলা করতে শুরু করে। ব্রিটিশরা মনে করে, মেহরাব খান নিজেই হয়তো ব্রিটিশ সৈন্যদের হত্যা করছেন এবং সেই কারণে ১৮৩৯ সালের নভেম্বর মাসে ব্রিটিশরা কালাত স্টেট আক্রমণ করেন এবং মেহরাব খানকে সরিয়ে সেখানে শাহনাওয়াজ খানকে শাসক হিসেবে নির্বাচন করেন, যিনি প্রথম থেকেই ব্রিটিশদের পক্ষে ছিলেন। এইভাবে এই পুরো অঞ্চলটিকেই ব্রিটিশরা বাফার জোন হিসেবে ব্যবহার করে এবং ধীরে ধীরে খানেত অফ কালাতের রাজনৈতিক পরিস্থিতির পরিবর্তন শুরু হয়।

কালাত রাজ্যের পাকিস্তানে সংযুক্তি: ইতিহাসের এক বিভ্রান্ত অধ্যায়

ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এই অঞ্চলে কিছু সমস্যা তৈরি করে রেখেছিল। বালুচ উপজাতিদের এই অঞ্চলে কিন্তু কখনই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি উপনিবেশ স্থাপন করেনি। তবে এই অঞ্চলের সীমানা তৈরি করেছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। আফগানিস্তান এবং ইরানকে খুশি করার জন্য এই অঞ্চলের কিছু এলাকা গোল্ড মাইন্ড এগ্রিমেন্ট এবং ট্রিটি অফ গন্ডামার্কের মাধ্যমে এই দু'টি দেশকে উপহার হিসেবে দিয়েছিল ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। অন্যদিকে ১৮৭৬ সালের ডিসেম্বর মাসে বালুচদের সঙ্গে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে যার নাম দেওয়া হয়, ট্রিটি অফ কালাত। প্রাথমিকভাবে খুব ভালো মনে হলেও, যখন ব্রিটিশরা ১৯৪৭ সালে ভারত ছেড়ে চলে যায় এবং দেশ ভাগ হয়, সেই সময়ে চুক্তির মূল সমস্যাটা বোঝা যায়। এই চুক্তিতে, বালুচ প্রদেশকে একটি স্বাধীন প্রদেশ হিসেবে অভিহিত করেছিল ব্রিটিশরা। তবে, বৈদেশিক নীতির নিয়ন্ত্রণ কিন্তু ছিল সব সময় ব্রিটিশদের হাতে। এর পরিবর্তে কালাত স্টেটকে ব্রিটিশরা প্রতিবছর ১ লাখ টাকা করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল এবং একটা দীর্ঘ সময়ের জন্য এই অঞ্চলটি লিজ নিয়েছিল। সেই সময়ই এই অঞ্চলের নামকরণ হয়েছিল ব্রিটিশ বালুচিস্তান।

১৯৪৭ সালে যখন ব্রিটিশরা ভারত ছেড়ে যাওয়ার পরিকল্পনা শুরু করে তখন কালাত স্টেটের তৎকালীন শাসক মীর মহম্মদ ইয়ার খান ঘোষণা করেন, তারা পাকিস্তানের সঙ্গে যাবেন না। যেহেতু ইংরেজরা কখনই তাদের অঞ্চলে উপনিবেশ স্থাপন করেনি, তাই তারা আলাদা দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবেন। আইনগতভাবেও বিষয়টা ঠিক, কারণ ১৮৭৬ সালে যে চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছিল সেখানে ব্রিটিশরা সরাসরি জানিয়েছিল, কালাত স্টেট ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অংশ নয়। পাশাপাশি, যে এলাকাটা ব্রিটিশ বালুচিস্তান হিসেবে চিহ্নিত রয়েছে, সেটাও শুধুমাত্র লিজ নেওয়া জায়গা। এছাড়াও ১৮৭৭ সালে দিল্লি ইম্পেরিয়াল অ্যাসেম্বলিতে খান অফ কালাত খুদাদ খানকে একজন স্বাধীন রাজা হিসেবেও আমন্ত্রণ জানিয়েছিল ইংরেজরা।

অন্যদিকে আমেরিকা এবং ব্রিটেনের আরও একটি চিন্তা ছিল, কালাত স্টেট স্বাধীন হয়ে গেলেও তারা খুব একটা ক্ষমতাশালী কখনই ছিল না। ফলে, রাশিয়া খুব সহজেই ওই এলাকার উপরে প্রভাব বিস্তার করতে পারত, যা ব্রিটেন এবং আমেরিকার ভবিষ্যতের জন্য একেবারেই সুবিধাজনক ছিল না। তাই ব্রিটেন চেয়েছিল, যাতে বালুচিস্তান স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে নয়, বরং পাকিস্তানের মধ্যেই চলে আসুক। তার ফলে পাকিস্তানের শক্তি অনেকটা বাড়বে এবং রাশিয়ার প্রভাব একেবারেই কমে যাবে।

দেশভাগ ও জিন্নাহ

১৯৪৫ সালের পর থেকেই যখন দেশভাগের কথা উঠছে, সেই সময় মহম্মদ আলি জিন্নাহর মুসলিম লীগ এবং জওহরলাল নেহেরুর কংগ্রেস নিজেদের নিজেদের সীমানা নির্ধারণ শুরু করে দেয়। ইংরেজদের বালুচিস্তান লিজ গ্রহণের বিষয়টা মহম্মদ আলি জিন্নাহ জানতেন এবং সেই কারণে প্রথম থেকেই তিনি স্টেট অফ কালাতকে পাকিস্তানের অংশ করার জন্য উঠে পড়ে লাগেন। তিনি জানতেন, যদি একবার ভারতকে এই অঞ্চল থেকে সরিয়ে রাখা যায়, তাহলে খুবই সহজে পাকিস্তান পরে এই অঞ্চলকে নিজেদের দেশে শামিল করে নেবে।

জিন্নাহ নিজের কাজ শুরু করে দেন। এমনিতেই এই অঞ্চলে মুসলিম জনসাধারণের সংখ্যা বেশি। সেই কারণে, বালুচ প্রদেশের প্রতিটি উপজাতির সর্দারের সঙ্গে মহম্মদ আলি জিন্নাহ নিজে গিয়ে ভালো সম্পর্ক তৈরি করতে শুরু করেন। তিনি তাদের জানান, যদি তারা পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত হয় তাহলে, এই পুরো দেশটা ইসলামিক দেশ হিসেবে স্থাপিত হবে এবং তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি রক্ষায় সম্পূর্ণ সাহায্য করবে পাকিস্তান। তবে, খান অফ কালাত তার কালাত স্টেটকে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। এটা জানার পর পরিকল্পনা পরিবর্তন করেন জিন্নাহ।

এরপর তিনি চিন্তা করেন, আগে কালাত স্টেট স্বাধীন রাষ্ট্র হয়ে যাক, তারপর তাদের বিরুদ্ধে সরাসরি আক্রমণ করা যাবে এবং বালুচিস্তানকে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করা যাবে। এর কিছুদিন পর জিন্নাহ ঘোষণা করেন, যেহেতু এই অঞ্চলে কোনও ব্রিটিশ কলোনি তৈরি হয়নি এবং এই অঞ্চল যেহেতু লিজ নেওয়া ছিল, তাই এটা একটা স্বাধীন দেশ হওয়া উচিত। এইসব শুনে বালুচিস্তানের শাসক খুশি হন এবং ১৯৪৬ সালে মহম্মদ আলি জিন্নাহকে পুরো কালাত স্টেটের আইনি উপদেষ্টা হিসেবে নির্বাচিত করেন। ১৯৪৬ সালের মার্চ মাসে মহম্মদ আলি জিন্নাহ একটি মেমোরেন্ডাম তৈরি করেন এবং ব্রিটিশদের চুক্তি ও লিজের ব্যাপারে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা করে দেন।

তবে খেলা ঘুরে যায় ১৯৪৭ সালে। ব্রিটিশরা তাদের ব্রিটিশ বালুচিস্তান এলাকার পৌর প্রতিনিধিদের একত্র করে ভোট করায়, ব্রিটিশরা যাওয়ার পর এই অঞ্চলটি কোন দেশের সঙ্গে যুক্ত হবে সেই সম্পর্কে। যথারীতি সমস্ত ভোট পাকিস্তানের পক্ষে যায় এবং ব্রিটিশ সরকার ঘোষণা করে, তাদের যাওয়ার পর এই অঞ্চলটি সরাসরি পাকিস্তানের হাতে চলে যাবে। এই ঘটনা ঘটার পরেই বালুচরা কালাত স্টেটের বিভিন্ন জায়গায় বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করে। এরপর ১৯৪৭ সালের ৪ অগাস্ট লর্ড মাউন্টব্যাটেন, মহম্মদ আলি জিন্নাহ এবং খান অফ কালাত একটি গোলটেবিল বৈঠকে বসেন এবং সেখানে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, স্টেট অফ কালাত পুরোপুরিভাবে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হবে এবং এর উপর কোনও দেশের প্রভাব থাকবে না। অন্যদিকে সেই একই দিনে, পাকিস্তান কালাত স্টেটকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে মেনে নিয়ে স্ট্যান্ড স্টিল চুক্তি স্বাক্ষর করে এবং ভারত বালুচিস্তানের পুরো বিষয়টা থেকে বেরিয়ে যায়।

বালুচিস্তানের স্বাধীনতা ও পরাধীনতা

১৯৪৭ সালের ১৫ অগাস্ট ভারত এবং পাকিস্তানের মতোই খান অফ কালাত তাঁর নিজের দেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। ১ মাস সব কিছু খুব ভালো চলছিল কিন্তু ১২ সেপ্টেম্বর শুরু হয় মহম্মদ আলি জিন্নাহর পাল্টা আক্রমণ। এই দিন ব্রিটিশরা একটা ছোট আনুষ্ঠানিক বিবৃতি জারি করে যে কালাত স্টেট স্বাধীন হয়ে গেছে ঠিকই কিন্তু এখনও আন্তর্জাতিক দায়িত্ব গ্রহণ করার জন্য সেই দেশ উপযুক্ত হয়ে উঠতে পারেনি। এই বিবৃতি সামনে আসার পরেই, পাকিস্তান খান অফ কালাতের উপর চাপ বাড়াতে শুরু করে, যাতে তারা পাকিস্তানের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে যায়। একদিকে, রাজনৈতিক চাপ বাড়তে শুরু করে, অন্যদিকে আবার কালাত স্টেটের উপরে আক্রমণ করার পরিকল্পনা শুরু করেন মহম্মদ আলি জিন্নাহ।

এরপর ১৯৪৮ সালের জানুয়ারি মাসে জিন্নাহ পাকিস্তানের মাকরান লজবেলা ও খরান উপজাতির সর্দারদের সঙ্গে একটি বৈঠক করেন এবং তাদের আশ্বাস দেন, পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত হলে তাদের কোনও সমস্যা হবে না। ১৯৪৮ সালের ১৭ মার্চ কালাত অঞ্চলটি দিয়ে বর্তমান বালুচিস্তানের বাকি অংশ পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায় এবং কালাত পুরোপুরি ল্যান্ড লক হয়ে যায়। এর ঠিক ১০ দিনের মাথায় কালাত স্টেট আক্রমণ করে পাকিস্তান সেনা এবং পুরো অঞ্চলকে পাকিস্তানের মধ্যে শামিল করে নেয়। নতুন এই প্রদেশের নাম দেওয়া হয় বালুচিস্তান।

বালুচিস্তানের স্বাধীনতার লড়াই

খান অফ কালাত মীর আহমদ ইয়ার খানকে পরাজিত করে তাঁর হাতে একটি বিজ্ঞপ্তি ধরানো হয় এবং সেখানে সই করার আদেশ দেওয়া হয়। এই ঘটনার কিছুদিন পরেই তাঁর ভাই প্রিন্স আব্দুল কারিম শুরু করেন পাকিস্তান সেনার বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ। ১৯৪৮ সালের এপ্রিল মাসে ১৫০ জনকে নিয়ে তিনি গঠন করেন বালুচ ন্যাশনাল লিবারেশন কমিটি এবং আফগানিস্তান সীমান্ত লাগোয়া অঞ্চলে পাকিস্তান সেনার বিরুদ্ধে শুরু করে দেন গেরিলা যুদ্ধ। খরণ পাহাড় অঞ্চলে পাকিস্তানের সেনার বিরুদ্ধে একের পর এক রক্তক্ষয়ী আক্রমণ শুরু হয় এবং এর ফলে সমস্যায় পড়ে যায় পাকিস্তান। তবে, যেহেতু অঞ্চলটি পুরো পাহাড়ে ঘেরা তাই সেনার পক্ষে লড়াই করা সহজ ছিল না। প্রতিদিন শয়ে শয়ে সেনা মারা যাচ্ছিল বালুচদের সঙ্গে লড়াইয়ে।

কুরআনের কসম খেয়ে বিশ্বাসঘাতকতা

১৯৪৮ সালের ৮ জুলাই পাকিস্তান সেনাপ্রধান নিজে প্রিন্স আব্দুল করিমের সঙ্গে কথা বলতে আসেন। তাঁকে কুরআনের কসম খেয়ে নিচে আসার অনুরোধ করেন এবং বলেন তাঁদের সমস্ত সমস্যা সেনাপ্রধান নিজে শুনবেন এবং সমাধান করবেন। কিন্তু নীচে আসার সঙ্গে সঙ্গেই তাদের গ্রেফতার করা হয় এবং জেল হেফাজতে নিয়ে চলে যায় পাক সেনা। এই বিশ্বাসঘাতকতার পরে বালুচরা আরও বেশি আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে।

এরপর ১৯৫৫ সালে পশ্চিম পাকিস্তান তাদের ওয়ান ইউনিট পলিসি নিয়ে আসে, যার মাধ্যমে পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতিটি প্রদেশ একত্র হয়ে পশ্চিম পাকিস্তান হয়ে যাবে এবং পুরো দেশ চলবে একটি কেন্দ্রীয় নিয়মে। আসল সমস্যা ওয়ান ইউনিট পলিসিতে ছিল না, সমস্যা ছিল পঞ্জাব প্রদেশের অতিরিক্ত ক্ষমতায়। এমনিতেই পঞ্জাব প্রদেশটি পাকিস্তানের মধ্যে সবথেকে ধনী প্রদেশ। ফলে এই ওয়ান ইউনিট পলিসিতে সব থেকে বেশি সুবিধা পেল পঞ্জাব এবং বালুচ ও পাশতুনরা হয়ে গেলেন পাকিস্তানেরই দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক। এই বিষয় সামনে আসার পরেই, বালুচিস্তানে বিদ্রোহ শুরু হয় এবং ১৯৫৮ সালে এমন পরিস্থিতি দাঁড়ায় যে পাকিস্তান সরকারকে বালুচিস্তান প্রদেশের উপর মার্শাল আইন লাগু করতে হয়।

বাংলাদেশের গঠন ও পাকিস্তানের নতুন সংবিধান

মার্শাল আইন চালু করার পর থেকেই বালুচিস্তান এবং পাকিস্তানের অন্যান্য অংশে একের পর এক হামলা শুরু হয় পাকিস্তান সেনার বিরুদ্ধে। সরকারি সাপ্লাই লাইন, গ্যাস, পেট্রোল, ডিজেল সাপ্লাই লাইনের উপরে হামলা করতে শুরু করে বালুচরা। অবশেষে ১৯৭০ সালে পাকিস্তানের জেনারেল ইয়াহিয়া খান ওয়ান ইউনিট পলিসি রদ করার সিদ্ধান্ত নেন এবং ১৯৭০ সালের ডিসেম্বর মাসে প্রথমবার পাকিস্তানে সাধারণ নির্বাচন হয়। বালুচিস্তানেও সাধারণ নির্বাচন হয়, তবে এই নির্বাচনে জয় লাভ করে সেখানকার স্থানীয় দল এনএপি এবং জেইউআই। অন্যদিকে, ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তান অর্থাৎ বাংলাদেশ পাকিস্তান থেকে আলাদা হয়ে যায় এবং সংবিধান পরিবর্তন হয় পাকিস্তানের।

১৯৭১ সালে যখন পাকিস্তানের নতুন সংবিধান আসতে চলেছে সেই সময় পাকিস্তানের শাসক জুলফিকার আলি ভুট্টো এনএপি এবং জেইউআই-এর সহায়তা প্রার্থনা করেন। তিনি বালুচিস্তানের সর্দার আতাউল্লাহ মেঙ্গলকে সেখানকার মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করেন এবং ঘোষ বখশকে রাজ্যপাল ঘোষণা করেন। এছাড়াও, বালুচিস্তানের বিভিন্ন জায়গায় এই দু'টি দলের সদস্যদের গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ করেন এবং তার বিপরীতে এনএপি এবং জেইউআই জুলফিকার আলি ভুট্টোকে সহায়তা করে সংবিধান তৈরি করার জন্য। সংবিধান তৈরি করে জুলফিকার আলি ভুট্টো পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হন এবং সবার আগে তিনি বালুচিস্তানের বিরুদ্ধেই আক্রমণ শুরু করেন।

১৯৭৩ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি বালুচিস্তানের দু'টি রাজনৈতিক দলকে জঙ্গিগোষ্ঠী হিসেবে ঘোষণা করা হয় এবং বালুচদের বিরুদ্ধে মিলিটারি অপারেশন চালু করা হয়। এই মিলিটারি অপারেশনে বালুচিস্তানের রাজনৈতিক নেতা, সাংবাদিক এবং ছাত্র-ছাত্রীদের হত্যা করা হয়। সমাজকর্মী থেকে শুরু করে সর্দার, সমাজের সমস্ত স্তরে শুরু হয় আক্রমণ।

গোয়াদার বন্দর ও চিনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ

২০০০ সালে বালুচরা নিজেদের একটি লিবারেশন আর্মি তৈরি করে যার নাম দেওয়া হয় বালুচ লিবারেশন আর্মি। তারই মধ্যে পাকিস্তান সরকার বালুচিস্তানের গোয়াদার অঞ্চলে একটি বন্দর তৈরি করার সিদ্ধান্ত নেয়। এই বন্দর তৈরির সমস্ত দায়িত্ব দেওয়া হয় চিনের সংস্থাকে। পাকিস্তান জানায়, এই সমুদ্র বন্দরটি আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে এবং এর সাহায্যে ভারতের উপরে নিয়ন্ত্রণ রাখা অনেক সোজা হবে। তবে, বালুচ লিবারেশন আর্মির এই বিষয়টা পছন্দ হলো না। প্রথমত, এই বন্দরে স্থানীয় বালুচ যুবকদের কাজ না দিয়ে পাকিস্তান সরকার চিনের ইঞ্জিনিয়ারদের কাজ দিতে শুরু করেছিল। দ্বিতীয়ত, বালুচিস্তানের চাগাই অঞ্চলে পাওয়া গিয়েছিল সোনা ও তামার খনি যেখানকার মূল লাভ চিন ও পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশ গ্রহণ করছিল আর বালুচিস্তানের হাতে আসছিল লাভের মাত্র ২ শতাংশ।

এর সঙ্গেই শুরু হয়ে গিয়েছিল চায়না-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডোরের কাজ। ৬০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ করে চিনের কাজগার থেকে বালুচিস্তানের গোয়াদার বন্দর পর্যন্ত তৈরি হওয়ার কথা ছিল এই ইকোনমিক করিডোর। এই পুরো অঞ্চলে ভালো রাস্তা, গ্যাস পাইপ লাইন, ফাইবার অপটিক্স, সমস্ত ধরনের আধুনিক পরিকাঠামো তৈরি হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সেখানেও এই একই সমস্যা। কম টাকায় সাধারণ বালুচদের থেকে জমি নেওয়া হয়, সাধারণ বালুচদের কাজে না নিয়ে চিনের থেকে ইঞ্জিনিয়ারদের নিয়ে আসা হয়, সেখানে পাকিস্তানের আর্মি বসিয়ে দেওয়া হয়, পাকিস্তানের পঞ্জাব প্রদেশ থেকে লোকজন আসে এবং ধীরে ধীরে নিজেদের এলাকায় কোণঠাসা হতে শুরু করে বালুচরা। ফলে আবারও আক্রমণ শুরু করে বিএলএ। তারা এই ইকোনমিক করিডোরের উপরে এত আক্রমণ করতে শুরু করে যে ২০২১ সালে চিন জানায়, এবারে তারা নিজেদের সেনা নিয়ে আসবে।

BRAS ও BNA

চিনের হস্তক্ষেপের পর বালুচ গোষ্ঠীগুলো একসঙ্গে তৈরি করে একটি বড় সংগঠন এবং এর নাম দেয় BRAS। এই সংগঠন লাগাতার চায়না-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডোরের উপরে হামলা করে এবং চিনের সাধারণ ইঞ্জিনিয়ারদের হত্যা করে পুরো পরিকল্পনা একেবারেই ভেস্তে দেয়। পাশাপাশি তারা ২০২৫ সালে বালুচ ন্যাশনাল আর্মি ওরফে BNA গঠন করে এবং নিজেদের একটি স্বাধীন দেশ হিসাবে দাবি করে শুরু করে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সরাসরি আন্দোলন। বিএনএ এখনও পর্যন্ত পাকিস্তানে ৭২টি কোঅর্ডিনেটর হামলা করেছে এবং পরিস্থিতি এই মুহূর্তে এমনই যেন লিবারেশন আর্মি নয়, দু'টি দেশের সেনা একে অপরের সঙ্গে লড়াই করছে। সাম্প্রতিককালের একটি ঘটনা সারা বিশ্বের নজর কেড়েছে। ১১ মার্চ ২০২৫, কোয়েটা থেকে পেশাওর যাওয়ার ট্রেন জফর এক্সপ্রেস যখন বোলান পাসের কাছে পৌঁছয় তখন ৮ কেজি আইইড বোমার মাধ্যমে সেই ট্রেন লাইন থেকে সরিয়ে দেয় বিএনএ। এরপর পুরো ট্রেনের হাইজ্যাক করে নিয়ে ৬৪ জনকে হত্যা করে BNA। যদিও এর মধ্যে ৫০ জনের বেশি শুধুমাত্র পাকিস্তানের সেনা জওয়ান ছিলেন।

এই সাম্প্রতিক হামলার পর বালুচিস্তানে পরিস্থিতি মারাত্মকভাবে অবনতি ঘটেছে। গোটা অঞ্চলে নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে চূড়ান্ত মাত্রায় শক্তিশালী করে তুলেছে পাকিস্তান। সেনাবাহিনীর উপস্থিতি বৃদ্ধি করা হয়েছে, নিয়মিত ড্রোন টহল দিচ্ছে আকাশে এবং গোটা এলাকায় এক ধরনের জরুরি অবস্থার আবহ তৈরি হয়েছে।

এই মুহূর্তে পাকিস্তানের সামনে সবচেয়ে বড় সংকট হলো— তারা নিজেই সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না বালুচ সমস্যার সমাধান কীভাবে করা হবে। বাঁধাধরা সেনা অভিযানে এই আন্দোলন দমন করা হবে, না কি বালুচ নেতাদের সঙ্গে রাজনৈতিক আলোচনায় বসা হবে— এই দোটানায় পড়েছে ইসলামাবাদ। কিন্তু বিষয়টা এখানেই থেমে নেই। বালুচিস্তানের ভৌগোলিক অবস্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ— এর সীমানা ইরান ও আফগানিস্তানের সঙ্গে যুক্ত, ফলে এই অঞ্চল এখন আন্তর্জাতিক রাজনীতির একটি কৌশলগত কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে।

বালুচিস্তানে পাকিস্তান সরকারের পক্ষ থেকে উন্নয়ন প্রকল্পের ঘোষণা হলেও সেগুলো প্রায়শই বালুচ জনগণের জন্য উপকারী প্রমাণিত হয়নি। বালুচ জনগণের মতে, এই উন্নয়ন প্রকল্পগুলো মূলত বাইরের লোকজনকে আনা এবং স্থানীয়দের ওপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করার একটি কৌশল। ফলে, এই ধরনের প্রকল্পও বালুচ জনগণের মধ্যে বিদ্রোহের আগুন আরও প্রজ্বলিত করেছে।

বালুচিস্তানের প্রাকৃতিক সম্পদ, বিশেষত তেল, গ্যাস এবং খনিজ সম্পদ, সোনা ও তামা বালুচ জনগণের জন্য লাভজনকভাবে ব্যবহৃত হয়নি। বালুচ নেতাদের অভিযোগ, পাকিস্তান সরকার এই সম্পদের ব্যবহার থেকে বালুচ জনগণকে বঞ্চিত রেখেছে এবং তাদের ভূমির ওপর শোষণমূলক নীতির মাধ্যমে নিজেদের সুবিধা আদায় করেছে। এই সব কারণে, বালুচ জাতির প্রতিরোধ ক্রমশ শক্তিশালী এবং দীর্ঘস্থায়ী হয়ে উঠেছে এবং এটি এখন পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে এক চলমান সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এই অঞ্চলে এখন বহু বিদেশি শক্তির দৃষ্টি নিবদ্ধ, যারা পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবে বালুচদের সমর্থন জোগাচ্ছে। বিশেষত, ট্রেন হাইজ্যকের ঘটনার পর যুক্তরাষ্ট্রের নামও উঠে এসেছে বালুচ আলোচনায়। বিশ্লেষকদের মতে, ইরান ও আফগানিস্তানকে চাপের মধ্যে রাখতে গেলে বালুচিস্তান একটি কার্যকর কৌশলগত ঘাঁটি হয়ে উঠতে পারে ওয়াশিংটনের জন্য, বিশেষ করে যদি এটি পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।

কী ঘটবে ভবিষ্যতে, তা সময়ই বলবে। তবে এটুকু নিশ্চিত, বর্তমানে বালুচ ইস্যুতে পাকিস্তান যতটা চাপের মুখে রয়েছে, অতীতে তারা কখনও এতটা সংকটে পড়েনি। রাষ্ট্রশক্তির দমননীতি আর বিক্ষুব্ধ জনগণের প্রতিরোধ— এই দুইয়ের সংঘর্ষেই আজ বালুচিস্তানের নিয়তি নির্ধারিত হচ্ছে। আর তাই হয়তো এই বিষয় থেকে বিশ্বের নজর ঘোরাতে ভারতের সাধারণ মানুষের উপরে অতর্কিতে হামলা চালাল পাকিস্তান-পোষিত দ্য রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট।

More Articles