বাঙালির আবেগকে দুরমুশ করে দিয়ে গেল রবীন্দ্রনাথের 'পাষাণ হৃদয়'

Rabindranath Tagore Sculpture: ভাস্কর্যটি রবীন্দ্রনাথ তাঁর সুহৃদ অক্ষয়চন্দ্র চৌধুরীকে দিয়েছিলেন। এত বছর ধরে চিত্রশিল্পী অতুল বসুর পরিবারের কাছে ছিল এই ‘পাষাণ হৃদয়’ ভাস্কর্যটি।

সারা জীবনে মাত্র একটি ভাস্কর্য গড়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তখন তাঁর বয়স মাত্র ২২। ‘পাষাণহৃদয় কেটে খোদিনু নিজের হাতে / আর কি মুছিবে লেখা অশ্রুবারিধারাপাতে’, এই পংক্তি খোদাই করেছিলেন সেই পাথর কেটে। 'পাষাণ হৃদয়', রবীন্দ্রনাথের একমাত্র সেই ভাস্কর্যটি সম্প্রতি নিলামে ওঠে। ১ কোটি ৪ লক্ষ ৫২ হাজার ২১০ টাকা দর ওঠে। মুম্বইয়ের অষ্টগুরু সংস্থা এই নিলামের ব্যাবস্থা করেছিল। কলকাতার প্রতিষ্ঠান দেবভাষা এই অষ্টগুরুর সঙ্গে, ভাস্কর্যের মূল মালিক শিল্পী অতুল বসুর পুত্র ও পুত্রবধূর সঙ্গে, যিনি আবার কবি বিষ্ণু দে-র কন্যা। আর এই যোগাযোগেই আমার সামান্য প্রাথমিক ভূমিকা ছিল। ২০০০ সালে আমি বাংলার শিল্পকলা বিষয় নিয়ে কলকাতার টাউন হলে প্রদর্শনীর দায়িত্ব পাই। সেখানে রবীন্দ্রনাথের একটি চিত্র প্রদর্শিত হয় যা আগে কখনও লোকসমক্ষে আসেনি। সেই কাজটি এই অতুল বসুর পরিবার থেকেই এসেছিল। সেই সংবাদ আমি দেবভাষাকে জানাই। সেই সূত্রেই দেবভাষা এই অমূল্য সম্পদ, রবিঠাকুরের একমাত্র ভাস্কর্যটির হদিশ পায়। দেবভাষা তা প্রদর্শিতও করে। এর পর থেকেই শকুনি আর্ট মাফিয়ারা সজাগ হয়ে ওঠে স্বাভাবিকভাবেই। পাষাণ হৃদয় আমার আর দেখা হয়নি। এই খেদ রয়েই গেল।

এখানে উল্লেখ্য, দেবভাষা সেই বহু মূল্যবান চিত্রটিও প্রদর্শনীতে রাখে। সেই ছবির ঠিকানা এখন কী, তাও আমি জানি না। এ শহরের বহু এমন পারিবারিক সম্পদ বেহাত হয়েছে, যা আমার নিজের চোখে দেখা। চোখের সামনে থেকে হেমেন মজুমদার, হরেন দাসের ব্যক্তিগত চিত্র সংগ্রহ, যামিনী রায়ের চিত্র— সব চলে যেতে দেখেছি। নতুন কিছু নয়। তবে, পাষাণ হৃদয়ের নিলামের সংবাদটি আনন্দবাজার পত্রিকার প্রতিবেদনেই জানতে পারি।

আরও পড়ুন- প্রদীপশিখার গানে যে অস্বস্তিকর দ্বন্দ্ব রেখে গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ

এ এক ভয়ংকর সংবাদ। এই জন্য ভয়ংকর নয় যে রবি ঠাকুরের একমাত্র ভাস্কর্য আসলে একটি জাতীয় সম্পদ। আশঙ্কে এখানে যে, পাষাণ হৃদয় লোকচক্ষুর আড়ালে চলে গেল এবংএই আশঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না যে খুবই দক্ষভাবে তা বিদেশে পাচারও হয়ে যেতে পারে, আরও বহু কোটিতে। অষ্টগুরুর দাবি, পাষাণ হৃদয় দেশেই থাকবে। কোন দেশে যে থাকবে, কেই বা তার নিশ্চয়তা দেবে! নিলামের নিয়ম অনুসারে, বর্তমান মালিকের নাম প্রকাশ করা যাবে না।

কোয়ার্টজাইট পাথর কেটে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাতে তৈরি সেই ভাস্কর্য।

অর্থাৎ, বহু অর্থের লোভে পাষাণ হৃদয় এক অজানা ঠিকানায় হারিয়ে গেল। বা বলা যায়, আত্মগোপন করল। আর এই নিয়ে দেশের সরকার বা রাজ্যের সরকার যা আদতে মাফিয়াদের হাতেই নিয়ন্ত্রিত—তাদের কোনও হেলদোল থাকার কথাও নয়। দুই সরকারেরই প্রাথমিক কাজ, চুরি করা,ব্যাঙ্ক লুট করা,ভোটে জেতা ও ক্ষমতায় থাকা, জনগণের করের টাকায় বিদেশ ঘোরা ও নানাবিধ ধ্যাষ্টামো করা—  রবীন্দ্রনাথের হাতে গড়া একমাত্র ভাস্কর্যের কদর করা বা এই সব জাতীয় সম্পদের মূল্য বোঝে এদের কর্মসূচিই নয়! দুর্ভাগ্য আমাদেরই, আমাদের মানে আমরা যারা আবেগে ভাসি, সাংস্কৃতিক মনকে প্রশ্রয় দিই— আমরা ব্যাথিত হই, দুঃখ পাই। এটুকুই মাত্র!

রবীন্দ্রনাথের প্রভূত ভালোবাসায় সৃষ্ট এই ভাস্কর্য ১৮৮৩ সালে তৈরি করা, সেই শেষবার তিনি ও কাদম্বরী দেবী অর্থাৎ নতুন বৌঠান একত্রে ভ্রমণ করেন। রবীন্দ্রনাথের তখন বাইশ বছর বয়স। বোম্বাই প্রেসিডেন্সির অন্যতম প্রধান শহর কারোয়ারে যান তাঁরা, সপরিবারে। দাদা সত‍্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে থাকার সময়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একটি কোয়ার্টজাইট পাথর উপহার পান। সেই পাথর রবীন্দ্রনাথ হৃদয়ের আকারে কেটে লিখেছিলেন ওই কবিতা— ‘পাষাণ হৃদয় কেটে/ খোদিনু নিজের হাতে/ আর কি মুছিবে লেখা/ অশ্রুবারিধারাপাতে?’

আরও পড়ুন-নিজের বইয়ের ‘অন্ত্যেষ্টি সৎকার’ করতে চেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ

জানা যায়, ভাস্কর্যটি রবীন্দ্রনাথ তাঁর সুহৃদ অক্ষয়চন্দ্র চৌধুরীকে দিয়েছিলেন। এত বছর ধরে চিত্রশিল্পী অতুল বসুর পরিবারের কাছে ছিল এই ‘পাষাণ হৃদয়’ ভাস্কর্যটি। অক্ষয় চৌধুরী রবীন্দ্রনাথের এই ভাস্কর্য পাওয়ার পর তা দিয়ে যান স্ত্রী শরৎকুমারী চৌধুরানীকে। পরে তা কন্যা উমারানির হস্তগত হয়। উত্তরাধিকার সূত্রে দম্পতির কন্যা দেবযানী পাথরটির মালিকানা পান। তাঁরই স্বামী বিখ্যাত শিল্পী অতুল বসু। তাঁর তিন সন্তান— অভিজিৎ, সঞ্জীব ও দীপঙ্কর। মৃত্যুর আগে দেবযানী তাঁর বড় ছেলে অভিজিতের স্ত্রী ইলোরার হাতে পাষাণ হৃদয়ের স্বত্ব তুলে দেন। অভিজিৎ ও ইলোরা কর্মসূত্রে প্রবাসী, থাকেন আমেরিকার ব্লুমিংটনে। সেখানকারই একটি ব্যাঙ্কের লকারে প্রায় ৪৪ বছর ‘পাষাণ হৃদয়’ রাখা ছিল বলে জানা গেছে।

১৯৪১ সালে রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণের ঠিক পরেই ক‍্যালকাটা মিউনিসিপ্যাল গেজেটের বিশেষ সংখ‍্যায় ছবি-সহ পাষাণ হৃদয় ভাস্কর্যটির কথা বেরোয়। তারপরে, অভিজিৎ ও ইলোরা দেশে ফিরে এলে দেবভাষার সেই প্রদর্শনীর আয়োজন হয় গত বছর। এবং তারপর এই নিলাম। পাষাণ হৃদয়ের ঠিকানা আর গোচরে এল না আমাদের।  

More Articles