মেয়ের স্বাবলম্বিতাই চক্ষুশূল।। রাধিকাহত্যা চিনিয়ে দিল পিতৃতন্ত্রের স্বরূপ
Patriarchal Fear in India: সন্তানের সম্পূর্ণ জীবন বাবা-মা চালনা করতে পারেন না। মুশকিল হল, অনেকেই ভেবে নেন যে তাঁরা পারেন। আসলে, সন্তানের জীবনের প্রতি অতিরিক্ত নজর, অতিভাবনা, সন্তানকে নিয়ে অতিউচ্চাশা এইসব অন্যায়ের মূল।
মহাভারতকার জানাচ্ছেন, মণিপুররাজের ভক্তিতে তুষ্ট হয়ে শিব মণিপুররাজকে বর দিয়েছিলেন যে তাঁর বংশে কেবল পুত্র সন্তানই জন্মাবে। তা সত্তেও যখন রাজকূলে চিত্রাঙ্গদা-র জন্ম হল, তখন রাজা তাঁকে পুত্ররূপেই পালন করলেন। রাজকন্যা অভ্যাস করলেন ধনুর্বিদ্যা, শিক্ষা করলেন যুদ্ধবিদ্যা ও রাজদণ্ডনীতি। অর্থাৎ পিতার ইচ্ছায় জন্ম থেকেই পালটে গেল কন্যার নিয়তি। মহাভারত থেকে এমন আরও অনেক উদাহরণ দেওয়া যায়। যেমন, মহাভারতে শিখণ্ডিনী-র প্রতি রাজা দ্রুপদের তাচ্ছিল্য এবং পুত্র ধৃষ্টদ্যুম্ন-র দিকে সব সময় স্নেহ পক্ষপাত প্রায়ই চোখে পড়ে। আসলে এসবই পিতৃতন্ত্রের শিকড়ের কথাগুলি বলে। কন্যা নয়, পুত্রসন্তান চাই— এমন অন্ধ মনোভাব বহু যুগ পর্যন্ত পৃথিবীর অনেক দেশে বহাল ছিল। এখনও, কখনো-কখনো এই বৈষম্য মনোভাবের উদাহরণ চোখে পড়ে না, তা নয়। কিন্তু আজকের দিনের পিতৃতন্ত্র কিছু-বা বদলেছে বৈকি! অধিকার আরোপের শিকড়গুলি ছড়িয়ে পড়েছে আরও গভীরভাবে। যুদ্ধবিদ্যা, রাজদণ্ডনীতি এসব কি চিত্রাঙ্গদা নিজের ইচ্ছেয় শিখেছিল? না। পিতার ইচ্ছাপূরণের জন্য শিখেছিল। আজও অভিভাবকদের ব্যক্তিগত ইচ্ছাপূরণের পাথরখণ্ডকে বহন করতে হয় বহু ছেলেমেয়েকে।
আরও পড়ুন-
দেশে দেশে গুপ্তহত্যা! কী ভাবে কাজ করে ইজরায়েলি গোয়েন্দা বিভাগ?
জুনিয়ার ইন্টারন্যাশনাল টেনিস ক্রিকেট-এর খেলোয়াড়, পঁচিশ বছর বয়সি রাধিকা যাদব সদ্যই খুন হয়েছেন। তাঁকে খুন করেছে তাঁর নিজের বাবা। ঘটনাটি ঘটেছে দিল্লির হরিয়ানাতে। খুনের সময় রাধিকা তাঁর বাড়িতেই ছিলেন। রাধিকা অবিবাহিত। মা-বাবার সঙ্গে একই ফ্ল্যাটে থাকতেন। তদন্ত অনুযায়ী, ১০ জুলাই বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে দশটা নাগাদ রাধিকার বাবা দিলীপ যাদব বাড়িতে ঢুকে মেয়েকে পরপর তিনবার গুলি করেন। গুলির আওয়াজ পেয়ে নীচের ফ্ল্যাট থেকে রাধিকার ভাই কূলদীপ দৌড়ে আসে। পাড়া প্রতিবেশীরাও এসে জড়ো হন। মেঝেয় লুটিয়ে পড়া রাধিকাকে তাড়াতাড়ি কাছের একটি প্রাইভেট নার্সিংহোমে নিয়ে যেতে-যেতেই রাধিকা প্রাণ হারান।

ম্রৃত তরুণী, রাধিকা যাদব
এরপরই, রাধিকার ভাই কূলদীপ বাবা দীপক যাদবের বিরুদ্ধে এফআইয়ার দায়ের করে এবং দীপককে অ্যারেস্ট করে পুলিশ। বাবা হয়ে মেয়েকে খুন করল কেন দীপক? অনুসন্ধানে জানা যাচ্ছে, বাবা-মেয়ের মধ্যে বাকবিতণ্ডা এই খুনের কারণ। শুধু কি এটুকুই? না। রাধিকা একটি টেনিস কোচিং অ্যাকাডেমি চালাতেন। দীপক চাইতেন না রাধিকা সেই অ্যাকাডেমি চালাক। খুনের দায় স্বীকার করে নেওয়ার পর দীপক জানিয়েছে, রাধিকা টেনিসের কোচিং দিচ্ছেন, তা তীব্রভাবেই অপছন্দ ছিল দীপকের। বারংবার বারণ সত্ত্বেও রাধিকা তার কথা শোনেননি এবং কোচিং চালিয়ে গেছেন।

টেনিস প্লেয়ার, রাধিকা যাদব
মোনা শর্মা, রাধিকার প্রতিবেশী। মোনা-র নিজে মেয়ে রাধিকার অ্যাকাডেমির ছাত্রী। তাঁর মতে, দীপক প্রথম থেকেই খুব সাহায্য করতেন রাধিকাকে। রাধিকার দেশ-বিদেশ ঘুরে খেলা থেকে অ্যাকাডেমির কোচিং— সর্বত্রই দীপককে সক্রিয় থাকতে দেখা যেত। এটাই তো স্বাভাবিক! তাহলে সমস্যা বাঁধল কোথায়? পুলিশ দীপককে জেরা করে দুটি তথ্য পেয়েছে। রাধিকার বাবা স্বীকার করেছে, মেয়ের রিলস্ বানানো, সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করা পছন্দ হত না তার। মেয়ের রোজগারের অর্থে তাকে চলতে হয়, চারপাশের এমন কটাক্ষও নাকি দীপককে প্রায় শুনতে হত, স্বাভাবিকভাবেই যা ভালো লাগত না দীপকের। অথচ রাধিকার পাড়া-প্রতিবেশীদের বক্তব্য, দীপক নিজে আর্থিকভাবে যথেষ্ট সচ্ছল। কোনওভাবেই সে রাধিকার রোজগারের ওপর নির্ভরশীল নয়। সত্য যাই হোক, এর জন্য নিজের মেয়েকে খুন করবেন একজন বাবা? 'পরিবার' কথাটির মানে এক অটুট ঐক্য। আজকের সময়ে, সেই পরিবারের ধারণাকেও পেরিয়ে যায় ব্যক্তিগত নিয়ন্ত্রণইচ্ছা। এবং ফল মনোমত না হলে নিজের সন্তানকেও খুন করতে দ্বিধাগ্রস্থ হন না একজন বাবা।

রাধিকার বাবা, দীপক যাদব
রাধিকার পাড়া প্রতিবেশী, তাঁর ভাই কূলদীপ সকলেই বারবার বলছেন যে রাধিকার স্বভাব ছিল শান্ত ও নম্র ধরনের। ইন্টারন্যাশনাল টেনিস ফেডারেশনে ১৯৯৯ র্যাংক ছিল রাধিকার। টেনিস গভর্নিং বডি ওয়েবসাইটে দেখা যাচ্ছে এ-বছর ফেব্রুয়ারি-মার্চে ইন্দোর ও মালয়েশিয়াতে টেনিস খেলেছেন রাধিকা। হারিয়ানা টেনিস অ্যাসোসিয়েশন-এর প্রধান সুমন কাপুরের বক্তব্য থেকেও রাধিকার স্বভাব সম্পর্কে আন্দাজ করা যায়। সুমন বলছেন:
রাধিকাকে এক সপ্তাহের ‘গেমস গোয়া ২০২৩’-এ দেখেছিলাম। খুবই ডিসিপ্লিনড এবং দৃঢ় ব্যক্তিত্বের একটি মেয়ে। নিজের খেলার জিনিসপত্র খুবই যত্ন করে রাখত এবং নিজের খেলার প্রতি খুবই শ্রদ্ধাশীল ছিল। খুবই ভালো খেলত রাধিকা।
সম্পূর্ণ বিষয়টির তদন্তে থাকা পুলিশকর্মীরা দীপকের সঙ্গে কথা বলে বুঝতে পেরেছেন যে দীপকের মধ্যে ইদানীং এক ধরনের হীনমন্যতা জন্ম নিয়েছিল। কিন্তু এই হীনমন্যতার কারণ কী? গভীর অধিকারবোধ? যা প্রায় স্বেচ্ছাচারের সমার্থক! দীপকের মত লোকেরা হয়তো ভাবেন 'আমার মেয়ে মানে আমার সম্পত্তি', তাই সন্তানে তার ইচ্ছে মতো নয়, নিজের ইচ্ছা অনুযায়ী নিয়ন্ত্রণ করতে চান। এই প্রবণতা আজকের দিনের পিতৃতন্ত্রের আরেক প্রকার স্বৈরাচারকে স্পষ্টভাবে চিনিয়ে দেয়। ঘটনাটির মূল তদন্তে থাকা বিনোদ কুমার জানিয়েছেন, বেশ কিছুদিন শারীরিকভাবে অসুস্থ ছিলেন রাধিকা, সেই অসুস্থতার মধ্যেও তিনি নিজের টেনিস কোচিং অ্যাকাদেমি-তে ছেলে-মেয়ে উভয়কেই টেনিস শেখাচ্ছিলেন। এই ঘটনা দীপকের কাছে অসহ্য হয়ে ওঠে।

ঘটনার পরে রাধিকার ফ্ল্যাটে পুলিশ
কথা হল, রাধিকা তাঁর জীবিকাজীবনে কী করবেন তাঁর সিদ্ধান্ত কি তাঁর বাবা নেবেন? তা কখনোই হতে পারে না। অভিভাবক হিসেবে বাবা বলতেন পারেন তাঁর বক্তব্য, উপদেশ। কিন্তু সন্তানের সম্পূর্ণ জীবন তাঁরা চালনা করতে পারেন না। মুশকিল হল, অনেকেই ভেবে নেন যে তাঁরা পারেন। আসলে, সন্তানের জীবনের প্রতি অতিরিক্ত নজর, অতিভাবনা, সন্তানকে নিয়ে অতিউচ্চাশা এইসব অন্যায়ের মূল। আরও একটা কথা এখানে ভেবে দেখা উচিত, রাধিকা একজন মেয়ে বলেই কি কথার অবাধ্য হওয়া মাত্র তাঁকে খুন করা এত সহজ হল? এবং মেয়ে বলেই কি পিতার সমস্ত ভালো-লাগা মন্দলাগা, এমনকী হীনমন্যতাকেও মান্য করে চলতে হবে?
আরও পড়ুন-
মহাভারতের ‘ঘৃণ্য’ চরিত্র পূজিত হন ভারতে! দুর্যোধন মন্দিরের যে কাহিনি অবাক করবেই
পিতৃতন্ত্রের স্বৈরাচারী মনোভাব এরকমই। ঠিক যে মনোভাবে চিত্রাঙ্গদাকে মণিপুররাজ নিজের ইচ্ছানুসারে মানুষ করেছিলেন, এমনকী মহাভারতকারও সে-বিষয়ে কোনও প্রশ্ন তোলেননি, ঠিক সেভাবেই এখনও অনেক পুরুষই ভাবেন মেয়েরা তাঁদের একান্ত অধিকারবস্তু। পিতা আশ্রয়সম হলেও তিনি জীবনের নিয়ন্ত্রক নন। আশা করি, রাধিকা যাদবের খুনের ঘটনাটি অনেকের মনেই একটি বিশেষ সতর্কতা জাগিয়ে রাখবে!