প্রতিদিন খোঁজ নিতেন গাজার! প্রয়াত ব্যাতিক্রমী সংবেদনশীল পোপ ফ্রান্সিস

Pope Francis Death: প্রথম জেসুইট পোপ ফ্রান্সিস বরাবর বিশ্বের দরিদ্র, উদ্বাস্তু এবং সুবিধাবঞ্চিতদের মানুষদের সমর্থনে কথা বলে এসেছেন।

প্রয়াত পোপ ফ্রান্সিস। সোমবার সকাল ৭:৩৫ নাগাদ, ৮৮ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন রোমের বিশপ। অ্যাপোস্টোলিক চেম্বারের ক্যামেরলেঙ্গো কার্ডিনাল কেভিন ফারেল, কাসা সান্তা মার্টা থেকে পোপ ফ্রান্সিসের মৃত্যুর ঘোষণা করেছেন। বেশ কয়েক মাস ধরে ব্রঙ্কাইটিসে আক্রান্ত ছিলেন পোপ ফ্রান্সিস। চলতি বছরের ১৪ ফেব্রুয়ারি অ্যাগোস্টিনো জেমেলি পলিক্লিনিক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল তাঁকে। ক্রমেই পোপ ফ্রান্সিসের শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে থাকে। ১৮ ফেব্রুয়ারি নিউমোনিয়া ধরা পড়ে তাঁর। হাসপাতালে ৩৮ দিন যুদ্ধের পর পোপকে কাসা সান্তা মার্টায় তাঁর ভ্যাটিকান বাসভবনে ফিরে আনা হয়। তবে শেষরক্ষা হয়নি আর।

শারীরিক এই বিড়ম্বনার শিকড় অবশ্য পোপের যুবক অবস্থা থেকেই। ১৯৫৭ সালে ফ্রান্সিস অর্থাৎ জর্জ মারিও বার্গোগ্লিওর বয়স যখন ২০-র কাছাকাছি, তখন তাঁর শ্বাসযন্ত্রের গুরুতর সংক্রমণের ফলে ফুসফুসের একটি অংশ বাদ দিতে জন্মস্থান আর্জেন্টিনায় এক হাসপাতালে অস্ত্রোপচার হয়েছিল। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পোপ ফ্রান্সিসের শ্বাসকষ্টের অসুস্থতা প্রায়ই বাড়তে থাকে। ইনফ্লুয়েঞ্জা এবং ফুসফুসের প্রদাহের কারণে ২০২৪ সালের নভেম্বরে সংযুক্ত আরব আমিরশাহির পরিকল্পিত সফর বাতিল করতে হয় তাঁকে।

গত ২৩ মার্চ হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার পরে গুড ফ্রাইডের পরের রবিবার জনসাধারণের মধ্যে উপস্থিত হন তিনি। ইস্টার উপলক্ষ্যে সেন্ট পিটার্স স্কয়ারে জড়ো হওয়া মানুষের সঙ্গে সামান্য কথাও বলেন তিনি। এর আগে, রোমের রেজিনা কোয়েলি কারাগারে বন্দিদের সঙ্গে দেখা করেছেন তিনি, তারও আগে সাধারণ পোশাকেই সেন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকায় হঠাৎ করেই চলে গিয়েছিলেন পোপ ফ্রান্সিস।

ক্যাথলিকদের কাছে নম্র স্বভাবের পোপ ফ্রান্সিস ছিলেন খুবই জনপ্রিয়। গত বছরই একজন পোপের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার জন্য পালিত আচার আচরণের সরলীকরণ ঘটিয়েছিলেন তিনি। আগেই তিনি জানিয়ে দিয়েছিলেন, রোমের এসকুইলিনো এলাকার ব্যাসিলিকা সান্তা মারিয়া ম্যাগিওরে তাঁর সমাধি হোক। পোপদের সাধারণত ভ্যাটিকান সিটির সেন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকার নীচেই অনেক ধুমধাম করে সমাহিত করা হয়।

ইতিমধ্যেই কে ফ্রান্সিসের উত্তরসূরি এবং ক্যাথলিক গির্জার ২৬৮ তম প্রধান হবেন তা নিয়ে ভ্যাটিকানে চিন্তাভাবনা শুরু হয়ে গিয়েছে। ফ্রান্সিসের মৃত্যুর আগেই সম্ভাব্য উত্তরসূরি হিসেবে নাম উঠে আসে মাত্তেও জুপ্পি, পিয়েত্রো প্যারোলিন, লুইস আন্তোনিও ট্যাগলের নাম।

পোপ হিসেবে এক যুগ অতিবাহিত করা কালীন প্রথম জেসুইট পোপ ফ্রান্সিস বিশ্বের দরিদ্র, উদ্বাস্তু এবং সুবিধাবঞ্চিতদের মানুষদের সমর্থনে কথা বলে এসেছেন। কর্পোরেট লোভী পুঁজিবাদী এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে চিরকালই কঠোর সমালোচনা করে গিয়েছেন ফ্রান্সিস। ভ্যাটিকানের মধ্যেও আতিশয্য এবং বিশেষাধিকারের সমালোচনা করেছিলেন। গির্জার নেতাদের নম্র হতে আহ্বান জানিয়েছিলেন। স্বাভাবিকভাবেই ফ্রান্সিসের বিরোধীও ছিলেন বহু মানুষ। বহু কার্ডিনাল এবং প্রভাবশালী ভ্যাটিকান কর্মকর্তারা ফ্রান্সিসের এহেন বক্তব্যে বিক্ষুব্ধ ছিলেন। গির্জার প্রাচীন প্রতিষ্ঠানগুলিকে সংশোধন করার জন্য ফ্রান্সিস যা যা প্রচেষ্টা করতেন, তাতে বাধা দেওয়ার বহু চেষ্টা হয়েছে। তবে সহানুভূতি এবং মানবতা দিয়ে পোপ ফ্রান্সিস বিশ্বের লক্ষ লক্ষ মানুষের মন জয় করেছিলেন।

১৯৩৬ সালে আর্জেন্টিনার বুয়েনস আইরেসে জন্মগ্রহণ করেন জর্জ মারিও বার্গোগ্লিও। ২০১৩ সালের মার্চ মাসে পোপ নির্বাচিত হন তিনি। পোপ হয়েও পোপের নির্দিষ্ট গাড়ির পরিবর্তে বাসে করে যাতায়াত করতেন তিনি। ভ্যাটিকান গেস্টহাউসে যাওয়ার আগে যে হোটেলে ছিলেন তার বিল মিটিয়ে যান। প্রথম সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে বলেছিলেন 'দরিদ্র গির্জা এবং দরিদ্রদের জন্য গির্জার' ইচ্ছা রয়েছে তাঁর।

দারিদ্র্য এবং বৈষম্যের কথা বলতে গিয়ে বারেবারেই পুঁজিবাদকে 'শয়তানের গোবর' বলে উল্লেখ করেছিলেন ফ্রান্সিস। পরিবেশের উপর ১৮০-পৃষ্ঠার একটি এনসাইক্লিক্যাল জারি করে বিশ্বের ধনী দেশগুলিকে তাদের 'গুরুতর সামাজিক ঋণ' দরিদ্রদের জন্য পরিশোধ করার দাবি জানিয়েছিলেন। বলেছিলেন, জলবায়ু সংকট "আগামী দিনে মানবতার প্রধান চ্যালেঞ্জগুলির মধ্যে একটি"।

উদ্বাস্তুদের প্রতি সহানুভূতি এবং উদারতার আহ্বান জানিয়ে পোপ ফ্রান্সিস বলেছিলেন, শরণার্থীদের দাবার বোড়ের মতো ব্যবহার করা হয়। গ্রিক দ্বীপ লেসবস পরিদর্শন করার পর, তিনি ১২ জন সিরিয়ানকে ভ্যাটিকানে আশ্রয় দেওয়ার প্রস্তাব দেন। বন্দি এবং আধুনিক কালের ক্রীতদাসত্ব এবং মানব পাচার নিয়েও সোচ্চার ছিলেন পোপ ফ্রান্সিস। সম্প্রতি হাসপাতালে ভর্তি থাকাকালীন গাজার হোলি ফ্যামিলি চার্চে ফোন করেছিলেন ফ্রান্সিস। ২০২৩ সালের ৯ অক্টোবর থেকে প্রতি রাতে ফোন করে গাজার খবর নিতেন তিনি।

ফ্রান্সিসের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল চার্চের যাজকদের যৌন নির্যাতন এবং গির্জার যাজক এবং বিশপদের সংঘটিত অপরাধগুলিকে ঢেকে রাখার চেষ্টার বিরুদ্ধে লড়াই। পোপ হওয়ার প্রথম কয়েক বছরেই, নানা কেলেঙ্কারির খবর আসতে থাকে সামনে। অভিযোগ ওঠে, ফ্রান্সিস এই সঙ্কটের মাত্রাকেই বুঝছেন না। তা সামলাতেও তিনি ব্যর্থ। এই সঙ্কট নিয়ে আলোচনা করার জন্য বিশ্বজুড়ে বিশপদের ২০১৯ সালে রোমে ডেকেছিলেন ফ্রান্সিস। পরে তিনি আদেশ জারি করেছিলেন যাতে যাজক এবং সন্ন্যাসীনিদের যৌন নির্যাতনের অভিযোগ গির্জার কর্তৃপক্ষ অবধি পৌঁছয় এবং অভিযোগের পরে তাঁদের সুরক্ষার নিশ্চয়তাও দিতে হবে।

এছাড়াও ক্যাথলিক চার্চের প্রধান হিসাবে তাঁর মেয়াদকালে, ফ্রান্সিস সন্ত্রাসবাদ এবং নিপীড়নের প্রতিবাদও জানিয়েছেন নিরবিচ্ছিন্নভাবে। বলেছিলেন, সত্যিকারের ধর্মের হিংসায় কোনও ভূমিকাই নেই। ইসলামের সঙ্গে সন্ত্রাসবাদের কর্মকাণ্ড গুলিয়ে না দেওয়া উচিত বলেও মন্তব্য করেছিলেন ফ্রান্সিস। ২০১৬ সালে ফ্রান্সে একজন ক্যাথলিক ধর্মযাজকের হত্যার পর তিনি বলেছিলেন, “আমি মনে করি হিংসার সঙ্গে ইসলামকে যুক্ত করা ঠিক নয়। আমি মনে করি, প্রায় সব ধর্মেই একটি ছোট মৌলবাদী গোষ্ঠী থাকে, আমাদেরও (ক্যাথলিকদের) আছে।” সমকামী ধর্মযাজকদের সম্পর্কে একটি প্রশ্নের জবাবে ফ্রান্সিস বলেছিলেন, “আমি বিচার করার কে?”

বিশ্বজুড়ে হিংসার মাঝে এমন সংবেদনশীল ধর্মীয় নেতৃত্বের প্রয়াণ শুধু এক স্নেহশীল যুগের সমাপ্তি নয়, ধর্মের জগতে ভেদাভেদের সেই দুয়ারের আগল নড়বড়ে হয়ে যাওয়াও।

More Articles