শমীক ভট্টাচার্যকে সভাপতি করে তৃণমূলের সুবিধা করে দিল বিজেপি?
Samik Bhattacharya: শমীক ভট্টাচার্য সংখ্যালঘুদের মুসলমান-মৌলবাদ ও 'ধর্মীয় ফ্যাসিজম' ছেড়ে বিজেপির দিকে এগিয়ে আসতে আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি শুনিয়েছেন বাংলার বহুত্ববাদের কথা।
২০০৬ সালে শ্যামপুকুরে বিধানসভা নির্বাচনের প্রচারের ফাঁকে গলি, তস্য গলি পেরিয়ে একটি বাড়িতে দলীয় কর্মী ও দলীয় পতাকায় ঠাসা একচিলতে ঘরে বসেছিলেন তিনি। সেই বোধহয় প্রথমবার নির্বাচনে প্রার্থী হওয়া। মুখে সেই চিরাচরিত উদ্বেগের ছাপ। কিন্তু কথায় চিরাচরিত প্রত্যয়। সেই থেকে অনেকবার হার নিশ্চিত জেনেও ভোটের ময়দানে লড়াই করে গেছেন। ভাগ্যে শিঁকে ছিঁড়েছে বসিরহাটে উপনির্বাচনে। তিনি বিধায়ক হয়েছেন। আবার হেরেছেন। সব শেষে তিনি রাজ্যসভায় সাংসদ হিসেবে গেছেন।
বিজেপির একনিষ্ঠ কর্মী হিসেবে শমীক ভট্টাচার্য কোনওদিন হাল ছাড়েননি। যখন অনেক পাখি এসেছে এবং উড়ে গেছে বা কেউ উড়িয়ে দিয়েছে, তখন তপন শিকদার থেকে শুরু করে তথাগত রায়, রাহুল সিংহ, দিলীপ ঘোষ, এমনকী সুকান্ত মজুমদারের সভাপতিত্বেও তিনি মুরলীধর সেন স্ট্রিটের অফিসে নিজের উজ্জ্বল উপস্থিতি বজায় রেখেছেন। ব্যক্তিগত জীবনের বিতর্কের ঝড়-ঝঞ্ঝাও তিনি সামলে নিয়েছেন। রাজনৈতিক জীবনে তার বিশেষ প্রভাব পড়েনি।
শমীক ভট্টাচার্যকে রাজ্য সভাপতি করে এক ঢিলে অনেক পাখি মারতে চেয়েছে বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। শুভেন্দু, দিলীপ, সুকান্ত সহ দলের নানা গোষ্ঠীর কাউকেই খুশি বা অখুশি না করে, 'নির্দলীয়' শমীককে রাজ্য সভাপতির আসনে অভিষিক্ত করেছেন জগৎ প্রকাশ নাড্ডারা। আরএসএসের শাখা করে উঠে আসা দীর্ঘদিনের বিজেপি নেতাকে রাজ্য সভাপতির আসনে বসিয়ে পুরনো বিজেপি কর্মীদেরও সন্তুষ্ট করতে চেয়েছেন তাঁরা। খোদ আরএসএসের লোকই রাজ্য বিজেপির শীর্ষে আবার বসলেন।
অন্যদিকে শহুরে মধ্যবিত্ত বাঙালির সামনে শক্তি-সুনীলের ভক্ত, বাগ্মী শমীককে রেখে পশ্চিমবঙ্গ বিজেপি যেন বাঙালিয়ানায় প্রত্যাবর্তন করছে। নীতিগতভাবে শমীক গেরুয়া উত্তরীয় গলায় পরে বা কপালে লাল টিকা পরে ঘোরেন না। সাধারণত পাঞ্জাবী-পায়জামার থেকে সাদা জামা ও প্যান্ট পরাতেই তিনি স্বচ্ছন্দ। এতেও জনমানসে রাজ্য বিজেপির চেহারার একটি পরিবর্তন তো হবে বটেই। তিনি বলনে-চলনে যেন কমিউনিস্ট কিন্তু আসলে আরএসএস! এই চেহারাও শহুরে মধ্যবিত্তদের কাছে আকর্ষণীয় হতে পারে।
আরও পড়ুন- কেন শমীকের হাতে গুরুদায়িত্ব অর্পণ করল বিজেপি?
কিন্তু দুর্জনেরা বলছেন, শমীক রাজ্য বিজেপির সভাপতি হওয়ায় সবচেয়ে বেশি খুশি হয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস নেতৃত্ব। কারণ, কেন্দ্রীয় বিজেপি নেতাদের নাকি পশ্চিমবঙ্গ থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে তাড়ানোর কোনও তাড়া নেই।
কথাটি একদম অমূলক নয়। অসাধারণ বক্তৃতা দেওয়ার ক্ষমতা থাকলেও শুভেন্দু অধিকারী বা দিলীপ ঘোষের মতো আগ্রাসী নেতা নন শমীক। দীর্ঘদিন দলীয় মুখপাত্র হিসেবে কাজ করার জন্য মুখের কথায় বিরোধীদের বিঁধতে অবশ্যই সাবলীল তিনি। তবুও, অন্যদের তুলনায় তিনি অনেক নরমপন্থী। তৃণমূলের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে জঙ্গি আন্দোলন করার জন্য বা তৃণমূলী আক্রমণ থেকে দলীয় কর্মীদের রক্ষা করার জন্য একজন বিজেপি নেতার মধ্যে যে আগ্রাসন দরকার তার জন্য শমীককে নিজে অনেক বদলাতে হবে।
তার থেকেও অবশ্য বড় কথা হলো, সভাপতি হিসেবে অভিষেকের (যে শব্দটি নিয়ে শমীকের প্রবল আপত্তি রয়েছে শুনলাম) প্রথমদিনই তিনি রাজ্য বিজেপির দলীয় লাইন গুলিয়ে দিয়েছেন।
এত দিন ধরে বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীদের প্রবল মুসলমান-বিদ্বেষ এবং হিন্দুত্বের উপর ভরসা করার যে লাইন রাজ্য বিজেপি নিয়ে চলছিল, তা লঘু করে দিয়েছেন নতুন সভাপতি। যে মুসলমানদের ভোটকে হিসেবের বাইরে রেখে রাজ্য বিজেপি ২০২৬-এর দিকে যাওয়ার রাস্তা তৈরি করছিল, সেখানে শমীক ভট্টাচার্য সংখ্যালঘুদের মুসলমান-মৌলবাদ ও 'ধর্মীয় ফ্যাসিজম' ছেড়ে বিজেপির দিকে এগিয়ে আসতে আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি শুনিয়েছেন বাংলার বহুত্ববাদের কথা। এ তো নরেন্দ্র মোদির 'সবকা সাথ সবকা বিকাশ'-এরই প্রতিধ্বনি। অনেকেই বলতে পারেন এ আর নতুন কী?
এসব কথা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিপ্রিয় বাঙালির কাছে আাশাব্যঞ্জক ও স্বস্তিদায়ক। কিন্তু বিজেপির জন্য মোটেই কাজের কথা নয়। সাম্প্রতিক মুর্শিদাবাদ দাঙ্গাই হোক বা নতুন ওয়াকফ আইন নিয়ে প্রতিবাদ — সংখ্যালঘু-বিদ্বেষ গোপনে পোষণ করা বাঙালিদের মনে সংখ্যালঘুদের প্রতি বিরক্তি কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। এই পরিস্থিতির জন্য অনেকে প্রকাশ্যে, আবার অনেকে মনে মনে তৃণমূলকে যেমন গালাগালি দিয়েছে, তেমনই বিজেপির উপরে তাঁদের ভরসা বেড়েছে। এমন একটি ধারণাও তৈরি হয়েছে যে বিজেপি ক্ষমতায় এলে তবেই 'ওরা' শায়েস্তা হবে।
এ কথা গোপনে হলেও বিজেপি নেতারা স্বীকার করবেন যে, সাম্প্রদায়িক ইস্যুতে আন্দোলনে তাঁরা যতটা স্বচ্ছন্দ ততটা ঠিক অন্য কোনও সামাজিক বা অর্থনৈতিক ইস্যুতে নন। গোটা রাজ্যটি যখন দুর্নীতি ও তৃণমূলের দাদাগিরিতে ডুবে রয়েছে, তখনও মুর্শিদাবাদ বা মহেশতলা ইস্যুতেই বিজেপি নেতা-কর্মীরা চাঙ্গা বোধ করেন। আরজি কর হোক বা শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি — এই সব আন্দোলনে বিজেপি বিশেষ দাগ কাটতে পারে না। কাজেই এই পরিস্থিতিতে রাজ্য বিজেপির একমাত্র ইউএসপি (ইউনিক সেলিং প্রোপোজিশন) তাঁরা এমন হেলায় ছেড়ে দেবেন!
তাই প্রশ্ন উঠছে, তবে কি ২০২৬-এর বিধানসভা নির্বাচনের আগে শমীক ভট্টাচার্যকে সভাপতি করে তৃণমূলের সুবিধা করে দিল কেন্দ্রীয় বিজেপি নেতৃত্ব?
ঠিক এখানেই ওড়িশা-বিজেপির কৌশলের ছায়া দেখা যাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের বুকে। যদিও বিজেপির প্রতি নরমপন্থী বিজু জনতা দলের নবীন পট্টনায়েকের সঙ্গে তীব্র বিজেপি-বিরোধী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তুলনা সরাসরি করা যায় না। তাঁরা দুজনেই অবশ্য এক সময়ে বিজেপি পরিচালিত এনডিএ-এর শরিক ছিলেন। কিন্তু এই গত নির্বাচনের আগে পর্যন্ত ওড়িশায় নবীনকে খুব চাপে ফেলেনি বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। মন্দির ও ধর্মপ্রধান ওড়িশায় বিজু জনতা দলের স্বাভাবিক উত্তরাধিকার, বিজেপি কিন্তু কোনও তাড়াহুড়ো করেনি। অনেক আগেই বিজেডি সরকারকে ফেলে দিয়ে তারা সরকার গড়তে পারত। কিন্তু নবীনকে নির্বিঘ্নে কাজ করতে দিয়েছে বিজেপি। প্রত্যুত্তরে নবীনও সংসদে ও সংসদের বাইরে বিজেপিকে দরকারি সমর্থন জুগিয়ে গেছেন।
যখন ওড়িশায় কংগ্রেস বলে আর কিছুই নেই এবং নবীন পট্টনায়ক তাঁর নেতৃত্বের উত্তরাধিকার প্রাক্তন আইএএস অফিসার ও জন্ম-শিক্ষা সূত্রে তামিল ভিকে পান্ডিয়ানের হাতে তুলে দিচ্ছেন ও তা নিয়ে দলের নেতাদের মধ্যে তীব্র অসন্তোষ দেখা দিচ্ছে, ভোটাররাও বিরক্ত হচ্ছেন, তখনই বিজেপি সুযোগ নিয়েছে। ওড়িশায় প্রথমবার একক শক্তিতে সরকার গড়েছে তারা।
আরও পড়ুন- জাতগণনার সিদ্ধান্ত বিজেপির কাছে ব্যুমেরাং হবে না তো?
পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি নিজেদের শক্ত জায়গা তৈরি করে নিতে চাইছে। বলা ভালো, বাম-কংগ্রেসের জন্য কোনও জায়গাই তারা রাখতে চাইছে না। আপাতত তর্কের খাতিরে যদি ধরা হয়, ২০২৬-এ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যদি সত্যিই ক্ষমতাচ্যুত হন, তাহলে তৃণমূল দলটির কী হবে কেউ হলফ করে বলতে পারে না। পরিষদীয় রাজনীতিতে শূন্য হয়ে গেলেও এখনও পর্যন্ত বামপন্থীরা রাজ্য থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়নি। বিজেপি কখনই চাইবে না, তৃণমূলের ছাড়া কোনও শূন্যস্থান বাম বা কংগ্রেস পূরণ করুক।
খেয়াল করলে দেখা যাবে, দিল্লিতেও আম আদমি পার্টিকে ধীরে ধীরে কোণঠাসা করার সঙ্গে সঙ্গে বিজেপি এও নিশ্চিত করেছিল যে, কংগ্রেস যেন মাথা তোলার সুযোগ না পায়। ঠিক সেই পরিস্থিতিতে বিজেপি শেষ শটটি খেলে সরকারে এসেছে।
পশ্চিমবঙ্গের পরিস্থিতিও একদম নিজেদের অনুকুলে এলে তবেই কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব পুরোদমে ঝাঁপাবে। গোষ্ঠীদীর্ণ, বেহাল-সংগঠনের বিজেপির জন্য রাজ্যের পরিস্থিতি এখনও অনুকূল নয়। রাজ্যে মেরুকরণের সুযোগ নিয়ে প্রধান বিরোধী দল হিসেবে তারা এক ধাপ এগিয়ে গেছে। পরবর্তী ধাপে পৌঁছনোর জন্য শমীক হয়তো একটি স্টপগ্যাপ। নির্বাচনের মাস দশেক আগে 'বহুত্ববাদী' শমীক ভট্টাচার্যকে রাজ্য সভাপতি করে বিজেপির রাজনীতিকে গুলিয়ে দিলেন না তো কেন্দ্রীয় নেতারা? নাকি তাঁরা জাদুর অপেক্ষায় থাকবেন?
শুধু মনে রাখবেন, অসমের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে কংগ্রেস থেকে দল বদল করে আসা, দুর্নীতিতে-অভিযুক্ত হিমন্ত বিশ্বশর্মাকে মুখ্যমন্ত্রী করে লাগাম ছেড়ে দিতে দ্বিধা করেনি বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। তার জন্য অসমের প্রথম বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সোনওয়ালের আপত্তিকেও পাত্তা দেয়নি তারা।
পশ্চিমবঙ্গেও এমন কিছু করতে পারত কি তারা?
সেই আগ্রাসী পথে না গিয়ে আপাতত পশ্চিমবঙ্গে শমীক ভট্টাচার্যকে রাজ্য সভাপতি করে রাজ্য বিজেপির অঙ্ক হঠাৎ করেই কঠিন হয়ে গেছে।