স্বীকৃতিহীন অপূর্ণ প্রেমের প্রদীপখানি — ঋতুপর্ণ ঘোষের উৎসব
Utsab Rituparno Ghosh: পারুল আর শিশির সম্পর্কে ভাইবোন। সেই ভাইবোনের সম্পর্ককে পেরিয়ে ওদের মধ্যে জন্ম নেয় এক প্রেমের উদ্ভাসন।
অনেকেই হয়তো জানেন না ঋতুপর্ণ ঘোষ ‘উৎসব’ ছবিটির প্রথমে নাম রেখেছিলেন ‘চালচিত্র’। মৃণাল সেনের যেহেতু এই নামেই একটি ছবি রয়েছে, তাই নাম পালটে পরে স্থির হয় ‘সার্বজনীন’। সে-নাম কারও পছন্দ না হওয়ায় শেষে ‘উৎসব’-কে ছবির নাম হিসেবে বেছে নেন ঋতুপর্ণ ঘোষ।
ছবিটি সম্পর্কে আরও কয়েকটি তথ্য জরুরি। ‘উৎসব’ ঋতুপর্ণ ঘোষ নির্মিত ষষ্ঠ ছবি। ২০০০ সালে, একই বছরে ‘বাড়িওয়ালী’ ও ‘উৎসব’ রিলিজ করে। ‘বাড়িওয়ালী’ আগে, ‘উৎসব’ তার পরে এবং এই ছবির জন্যই, সে-বছর সারা দেশের মধ্যে শ্রেষ্ঠ পরিচালক হিসেবে জাতীয় পুরস্কার পেয়েছিলেন ঋতুপর্ণ!
ছবিটির রচনামন সম্পর্কে ‘সানন্দা’-য় একটি সাক্ষাৎকারে ঋতুপর্ণ ঘোষ বলেছিলেন:
‘উৎসব’ আমার লেখা ছিল টেলিফিল্মের জন্য। ভেবেছিলাম টেলিভিশনের জন্য করব। টেলিভিশন যেহেতু ফ্যামিলি মোজেক তাই এই ধরনের ছবি ওই মিডিয়ামে খুব সুন্দর হয়। দুই এপিসোডে খুব ভালো আসে। একটা বাড়িতে অনেকগুলো ফ্যামিলি, তাদের টুকরো-টুকরো প্রবলেম, অ্যাঙ্গজাইটিস, আনন্দ, হোপসগুলোকে পারসু করা যায়। এই প্যাটার্নের ছবি আমরা পেয়েছি সত্যজিৎ রায়ের কাছ থেকে। যেমন ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’, ‘শাখা-প্রশাখা’।
একান্নবর্তী পরিবারের ছবি ‘উৎসব’। মা দুর্গাকে গয়না পরাচ্ছে, কুমোর। আর, বাড়ির শিশুটির সঙ্গে গল্প করছে। এই দৃশ্য দিয়ে শুরু হয় ছবিটি। এখানে লক্ষ্য করার মতো বিষয় হলো, মা দুর্গার চার সন্তান। দু-জন ছেলে, দু-জন মেয়ে। ছবিতেও তাই। যে পরিবারের গল্প বলছেন ঋতুপর্ণ, সেখানে একজন বিধবা মা আছে। তারও দুই ছেলে ও দুই মেয়ে। ছবিটি শুরু হয় পঞ্চমী থেকে। শেষ হয়, একাদশীর দিন। দুর্গা পূজা বাঙালির চিরন্তন উৎসব। সেই উৎসবকে ঘিরে, গ্রামের বাড়িতে আসা এক পরিবারের ব্যক্তিগত টানাপড়েনকে একাকার করে দিতে চেয়েছিলেন পরিচালক। কিছুক্ষণ আগে উল্লেখিত কথোপকথনটিতে ঋতুপর্ণ ঘোষ ছবিটির মূল-মনোভাব সম্পর্কে বলেছিলেন:
প্রত্যেকটা ফ্যামিলির মধ্যেই একটা টেনশন আছে। একটা সময় আসে যখন টেনশনগুলো সব ঠিক হয়ে যায়, তখন আমাদের মনে হয় সত্যিই কি এগুলো ছিল? নাকি সবটাই শরতের মেঘের মতো ট্র্যানজিট। এই আছে, এই নেই।
এবার আসি ছবিটির অভ্যন্তরীণ বিষয়ে। যাঁরা ছবিটি দেখেছেন তাঁরা নিশ্চয়ই মনে করতে পারবেন ‘পারুল’ চরিত্রটিকে। চরিত্রটিতে অভিনয় করেছিলেন মমতাশংকর। বহু বছর আগে, পারুলদের বাড়িতে, ওর দাদা-বোনদের সঙ্গে থাকত ওর এক পিসতুতো দাদা, শিশির। যাকে সবাই ‘ভাইয়া’ বলে ডাকত। পারুল আর শিশির সম্পর্কে ভাইবোন। সেই ভাইবোনের সম্পর্ককে পেরিয়ে ওদের মধ্যে জন্ম নেয় এক প্রেমের উদ্ভাসন। জানাজানি হয়ে গেলে, পারুলের দাদারা শিশিরকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেয়। ছবিতে দেখা যায়, এত বছর পর শিশির পারুলদের বাড়িটি কিনতে চায় এখন। পারুল ও তার দাদা-বোনেরাও চায় বিক্রি করতে। শিশির আসে ওদের বাড়িতে কথা বলতে। কথা হয়। যদিও পারুল থাকে না সেখানে।
আরও পড়ুন- ঋতুপর্ণর ‘চিত্রাঙ্গদা’ একটা ইচ্ছের গল্প, কিন্তু কার?
ছবিটির এই তথ্যগুলি মনে করে নেওয়া প্রয়োজন কারণ ‘পারুল’ ও ‘শিশির’ এই দু'টি চরিত্রকে নিয়ে এখানে খুব অদ্ভুত খেলা খেলেছেন ঋতুপর্ণ। কীরকম খেলা? পারুলের দাদার মেয়ে শম্পা এবং পারুলের ছেলের নাম জয়। ছবিটি যত এগোয়, আমরা বুঝতে পারি ওদের দু'জনের মধ্যেও একটা সমাজ-বহির্ভূত সম্পর্ক রয়েছে। যে সম্পর্ক, আসলে মনের। অর্থাৎ, শিশির-পারুল-এর ঘটনার পুনরাবৃত্তি? তা ঠিক নয়।
এখানেই ঋতুপর্ণর অভিনবত্ব! পারুল ও শিশির, চরিত্র দু'টির সম্পর্কের অসম্পূর্ণতাকে পরিচালক জয় ও শম্পার মধ্যে দিয়ে পূর্ণতা দিতে চেয়েছেন। এই দু'টি চরিত্রের বিভিন্ন সংলাপে বোঝা যায়, তারা নিজেদের ভেতরকার এই যোগাযোগকে অস্বীকার না-করে, বাঁচিয়ে রাখতে চায়। এখানে একটি সংলাপের উল্লেখ করছি:
শম্পা। এই জয় শোন না
জয়। কী?
শম্পা। ওই দ্যাখ…
জয়। কে?
শম্পা। চিনিস ভদ্রলোককে?
জয়। না। ঠিক বুঝলাম। দিদুর বাপের বাড়ির কেউ? জড়িয়ে ধরে কাঁদছিল, তারপর বড় মামা-মামিকে…
শম্পা। এই-ই ভাইয়া…
জয়। কে ভাইয়া?
শম্পা। বাবাদের পিসতুতো ভাই, যে বাড়িটা কিনবে বলেছে।
জয়। ও… এ তো বেশ প্লেজেন্ট একটা লোক।
শম্পা। হঠাৎ আনপ্লেজেন্ট হতে যাবে কেন?
জয়। না, হবে না। আসলে এত আনপ্লেজেন্ট গল্প শুনেছি। গল্প নয়, ঝগড়া। এই পুজোর আগে-আগে মাঝরাতে অনেকবার আমার ঘুম ভেঙে গেছে। বাবা-মার ঝগড়ায়। মা ঝগড়া করত না। চুপ করে কাঁদত। বাবা চেঁচাত। মা-কে খারাপ-খারাপ কথা বলত। একটা কথা আমার এখনও মনে আছে। বাবার পেট ফ্রেজ- ‘ভাইয়া থেকে সাইয়া’। অনেকবার হয়েছে আমার ঘুম ভেঙে গেছে। আমি উঠিনি। বাথরুম পেয়েছে। চেপে শুয়ে থেকেছি। কী জানে ওইটুকু বয়সে বুঝেছিলাম, আমার ওঠা উচিত না। উঠলে ব্যাপারটা আরও আনপ্লেজেন্ট হয়ে যাবে। মা আরও লজ্জা পাবে।
শম্পা। টুকটুকদির বিয়েতে তো তুই যাসনি। পিসিমণি গিয়েছিল আমাদের সঙ্গে। সেখানে ওই ভদ্রলোক এসেছিলেন। শোনা মাত্র, পিসিমণি কেমন হিস্টিরিক্যাল হয়ে গেল। বলল, এক্ষুনি বাড়ি যাব। দাদাকে ডেকে দে। বাবা খাচ্ছিল। খেতে-খেতে উঠে এল। সেদিন পিসিমণির কন্ট্রোল দেখে আমি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। আমি হলে পারতাম না।
পারুল ও শম্পার পরিস্থিতি, এক। দু-জনেই নিজের ভাইয়ের প্রতি প্রেমসম্পর্ক অনুভব করেছে। কিন্তু শম্পা যে পারুলের থেকে অনেক অংশে আলাদা, তা বলে দেয় কথোপকথনের পরবর্তী অংশ। ‘আমি হলে পারতাম না’ এর প্রত্যুত্তরে জয় বলে:
জয়। কী?
শম্পা। ভাইয়া-ই হোক সাইয়া-ই হোক, এভাবে কমপ্লিটলি যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে।
জয়। তোর বর যদি তোকে বকত?
শম্পা। তোকে খবর পাঠাতাম! তুই এসে বাঁচাতিস না আমায়?
জয়। যদি আমি বিদেশে থাকতাম?
শম্পা। আমি কষ্টে আছি জানলে আসতিস না একবারও?
জয়। (হাসি) যাই বল ভাইয়া আর সাইয়াটা বেশ ভালো রাইম করে… তাই না?
এখানেই, ভাইবোনের সম্পর্কের পোশাক খুলে বেরিয়ে আসে দু'জন নারী-পুরুষ। প্রেম যাদের সন্ধিমনের শিকড়রূপে গ্রথিত। আমরা মনে রাখতে চাইব, জয়ের বলা, ‘ভাইয়া আর সাইয়াটা বেশ ভালো রাইম করে… তাই না’ এই কথাটিকে। কারণ, কিছু পরেই এই একই সংলাপকে ফিরিয়ে এনে শম্পা চরিত্রটির মধ্যে দিয়ে এক অনবদ্য উত্তরকে উপস্থাপন করবেন ঋতুপর্ণ! সংলাপটি এমন:
শম্পা। এবারে পুজোয় আমার আসার ইচ্ছা ছিল না।
জয়। মিথ্যে কথা বলিস না?
শম্পা। হ্যাঁ। জাস্ট আমায় একা রেখে বাবা-মার আসা সম্ভব নয়, তাই এসেছি।
জয়। তুই জানতিস এবারে না এলে তোর সঙ্গে আমার আর দেখা হবে না। গা ছুঁয়ে বল না?
শম্পা। তুই আমেরিকায় গেলে আবার কবে আসবি?
জয়। তোর বিয়ের সময়। অবশ্য তোর বড় যদি তোকে না বকে!
শম্পা। বকলেও, তুই শুনবি কেন তার কথা?
জয়। তুই তো শুনবি!
শম্পা। আচ্ছা বল তো, জয়ের সঙ্গে কী ভালো রাইম করে?
জয়। ভয়!
শম্পা। বোকা! এইজন্যই বলি তুই বাংলায় একেবারে কাঁচা। কেন ‘প্রণয়’, ‘হৃদয়’ এসব কিচ্ছু মাথায় এল না?
এখানে ‘মিল’ দিতে গিয়ে জয় বলছে ‘ভয়’। এই শব্দটিকে কি ঋতুপর্ণ কেবল চরিত্রটি বাংলা কত কম জানে, সেজন্যই ব্যবহার করেছিলেন? নাকি এর সঙ্গে ভাইবোনের অবৈধ সম্পর্ক বাইরে চলে আসার একটা সামাজিক ভয়েরও সংযোগ রয়েছে?
আমার মনে হয়, হয়তো সংযোগ আছে। কিন্তু সেই ভয়কে দু'টি শব্দের দ্বারা সম্পূর্ণ মুছে দিতে চায় শম্পা। শব্দ দু'টি হলো, ‘প্রণয়’ ও ‘হৃদয়’। এখানেই পারুল ও শিশিরকে ছাড়িয়ে, অনেকটা এগিয়ে যায় শম্পা ও জয়ের সম্পর্ক। শম্পা জানে, সে জয়কে কোনওদিনই বিয়ে করতে পারবে না। জয়ও জানে। ভবিষ্যতে, দু'জনেরই পৃথক-পৃথক জীবন হবে। তবু তারা একে-অপরকে ভালোবাসবে না, যোগাযোগ রাখবে না — তা তো নয়।
পরিবার কী বলল, সমাজ কী বলল, সবাই মেনে নিল বা নিল না — এই সব লোকচক্ষুপ্রশ্নের বাইরে দাঁড়িয়ে ওদের ভেতর একটা সংযোগরেখা ঠিক থাকবে। ছবিটিকে এই মনোভাবের কাছে পৌঁছে দেওয়ার পর এক আশ্চর্যকে ডাক দেন ঋতুপর্ণ। আমরা দেখতে পাই, জয় ও শম্পা বসে আছে। শম্পা গান গাইছে, ‘অমল ধবল পালে লেগেছে মন্দ মধুর হাওয়া’ এবং এই গানের মধ্যে দিয়েই, বাড়িতে ঢুকছে শিশির। সকালে ফেলে-যাওয়া তার চশমা ফেরত নিতে এসেছে সে। তখন সন্ধ্যাকাল। বহু বছর পর শিশিরের দেখা হচ্ছে পারুলের সঙ্গে। পারুল তখন কী করছে? পারুল ঠাকুরদালানে দশমীর প্রদীপে তেল দিচ্ছে।
আরও পড়ুন-স্মৃতি আসলে কার? ‘মেমোরিজ ইন মার্চ’-এ যে উত্তর খুঁজেছেন ঋতুপর্ণ
এই প্রদীপ তো মনের প্রদীপ! যেখানে দশমী হয়ে গেছে কতদিন। তবু পারুল শিশিরকে ভুলতে পারেনি। এখনও প্রদীপ জ্বলছে। পারুল জ্বালিয়ে রেখেছে সে-প্রদীপ। দু-জনের দেখা হওয়ার মুহূর্তটি এমন:
পারুল। কে?
শিশির। আমি। সকালবেলা আমার সানগ্লাসটা বোধহয় ফেলে গিয়েছি।
পারুল। জানি। ওপরে আছে। মার কাছে।
শিশির। আমি জুতো পরে আর উঠব না।
পারুল। পাঠিয়ে দিচ্ছি।
শিশির। কে গাইছে? কন্যা।
পারুল। দাদার মেয়ে। শম্পা।
শিশির। তোমার তো ছেলে। আসেনি?
পারুল। একবার জুতোটা খুলে ওপরে যাবে। আমার সঙ্গে দেখা হয়েছে, সেটা বলো না প্লিজ।
শিশির। তাহলে থাক।
পারুল। থাক।
শিশির। তোমার চা ফ্রেঞ্চ টোস্ট ভালো হয়েছিল।
পারুল। এটা বলার জন্য বুঝি এতদূর তেল পুড়িয়ে এলে?
শিশির। হ্যাঁ…খুশি?
এই কথোপকথনটুকু এ ছবির অন্যতম শ্রেষ্ঠ দৃশ্য। যেখানে এতদিন পর দু-জনের কথা হচ্ছে এবং শিশির ও পারুল — দু'জনেই ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিচ্ছে তারা এখনও দু'জনের মধ্যে জেগে আছে এবং এও বুঝিয়ে দিচ্ছে তারা যে, এই জেগে থাকার আজও কোনও স্বীকৃতি নেই।
কিন্তু পারুল ও শিশির যা জানে না তা হলো, ওদের ওই কথোপকথনকে দূর থেকে সুরে ভরিয়ে রাখছে শম্পার গান। পাশেই বসে আছে জয়। পারুল ও শিশিরের মতনই তো ওরাও। একই প্রেমের ভূমি! অস্বীকৃত, অথচ একই চাওয়ার ভূখণ্ড থেকে ছুটে আসছে ওই গান, ‘অমল ধবল পালে লেগেছে মন্দ মধুর হাওয়া’। সেই গানের, সেই হাওয়ার ভেতর কথা বলছে পারুল ও শিশির।
আমরা জানি না, জয় ও শম্পা ভবিষ্যতে আর সংযোগ রাখতে পারবে কিনা কিন্তু আমাদের মনের সমস্ত বিশ্বাসটুকু ওই ‘মন্দ মধুর হাওয়া’ হয়ে পৃথিবীর সমস্ত অস্বীকৃত, অবৈধ ইচ্ছের সঙ্গে জেগে থাকুক। কে বলতে পারে, একদিন পারুলরাও স্বামী-দাদা-মার ভয় না পেয়ে, মনের স্বাধীনতাকেই নিজের একান্ত অস্তিত্ব বলে মেনে নেবে!