ফুর্তির জন্য শান্তিনিকেতনই কেন বাঙালির 'হট ফেভারিট'?

Shantiniketan: প্রকৃতপক্ষে বোলপুর মহকুমায় যতটা জমি আছে তার বিশ গুণ আছে জমির কারবারি মায় দালাল। রাস্তাঘাটে কারও সঙ্গে দেখা হলেই বলে, "সস্তার জমি আছে। কেউ নিলে বলবেন।"

সামগ্রিকভাবেই বোলপুর শহর বিস্রস্ত এবং বেলাগাম এক অবস্থার মধ্যে আছে বলেই মনে হয়। অথচ এর সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো বোলপুর বীরভূম জেলার একটি প্রশাসনিক কেন্দ্র অর্থাৎ মহকুমা। এই মফসসল শহরে চোদ্দ বছর আগের আদমসুমারি অনুযায়ী জনসংখ্যা ছিল আশি হাজারের সামান্য বেশি। এই শহরের ক্ষেত্রে বোলপুর পৌরসভার সঙ্গে আরও চারটি ব্লক সংযুক্ত যার অনেকটাই মফসসল থেকে গ্রামাঞ্চল অবধি বিস্তৃত। ফলে এই অঞ্চলের সিংহভাগ মানুষকে বোলপুর শহরে নানা কাজে যাতায়াত করতে হয়। শান্তিনিকেতন পর্যটন কেন্দ্র হয়ে ওঠার ফলে আশেপাশের জেলা ও বিশেষ করে কলকাতার বহু মানুষ আসেন এখানে। সেক্ষেত্রে বর্তমানে সব মিলিয়ে সম্ভবত প্রায় এক কোটির উপর মানুষের চাপ নিতে হয় এই মহকুমা শহরটিকে। সেই কারণেই পরিষেবার দিকটি সবিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, এই মাঝারি শহরটিতে নানা সময়ে অত্যধিক যানজটের অবস্থা তৈরি হয়। কখনও কখনও পুলিশ বড় বড় মালবাহী গাড়ি থামিয়ে রাখে (তোলা তোলে?) বলে যানবাহন ভয়ঙ্কর মন্থর হয়ে পড়ে এবং যার ফলশ্রুতি হিসাবেও যানজটের পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।

এবার শুরু করি বোলপুরের স্টেশনের রাস্তা যেটি মূল শহরের দিকে বা শান্তিনিকেতন-শ্রীনিকেতনের দিকে যাচ্ছে তার অবস্থা দিয়ে। বিগত চার দশক ধরেই এই অত্যন্ত সরু রাস্তাটি ক্রমে আরও সংকীর্ণ হয়ে যাচ্ছে। তার প্রধান কারণ, দোকানদারদের জবরদখল করে রাস্তার ওপর ডালি বা মালপত্র রাখা। আর দ্বিতীয়ত বাজার সংলগ্ন সারি সারি দোকান থাকার ফলে এখানে কেনাকাটার জন্য প্রচুর মানুষের ভিড় হয়। এই রাস্তার দু'ধারে অসংখ্য সাইকেল, স্কুটার, বাইক, টোটো এমনকী গাড়িও দাঁড় করিয়ে রাখা হয় কোনওরকম আইন কানুন না মেনে। এর ফলে নিয়মিত ট্রেন আসার সময় সে এক নরকগুলজার! এক কিলোমিটার রাস্তা অতিক্রম করতে ঘণ্টা পেরিয়ে যায়। পৌরসভা বা স্থানীয় প্রশাসন বছরের পর বছর নিত্যযাত্রীদের এই দুর্ভোগ দেখে যাচ্ছে। এর কোনও প্রতিকার নেই, কোনও কার্যকরী পদক্ষেপও নেই।

আরও পড়ুন-পলাশের ডাল ভাঙা, মদের মোচ্ছব | শান্তিনিকেতনে দোলখেলার শ্মশানযাত্রা

এ তো গেল শহরে ঢোকার গল্প! তারপর রাস্তার দু'ধারের দখলিকৃত জায়গাতেই রয়েছে সারি সারি দোকান। সেখানেও একইভাবে এলোমেলো বেআইনি পার্কিং। অন্যসব জেলার মতোই এখানেও এই সমস্ত দায়িত্বটাই সিভিক ভলান্টিয়ারদের হাতে। কিন্তু তারা তো এ গাড়ি সে গাড়ি থেকে টাকা তুলতেই ব্যস্ত! ফলে রাস্তার বেসামাল অবস্থা। মাঝে মাঝে স্থানীয়দের পথ অবরোধ করতে দেখা যায়। পুলিশ বুঝিয়ে সুঝিয়ে সরিয়ে দেয়। কিন্তু ওই পর্যন্তই। এ নিয়ে, আবার বলব, প্রশাসনের কোনও হেলদোল নেই। অবস্থার চূড়ান্ত পরিণতি তৈরি হয় নানা উৎসব-পার্বণ ও মেলাখেলার সময়। রাস্তায় গাড়ি তো দূর অস্ত, হেঁটেও পার হওয়া যায় না। এক্ষেত্রে সোনাঝুরির হাটের সামনের রাস্তাটা উল্লেখযোগ্য। দুপুর থেকে সন্ধ্যা সাতটা-আটটা অবধি মারাত্মক যানজটের কোনও প্রতিকার নেই।

অনেকেই বলে, পুরনো সব ভালো আর নতুন সব খারাপ বলাটাও এক ধরনের ব্যাধি। কিছু মানুষ অযথা সমালোচনা করে থাকে। এর কিছুটা সত্য মেনে নিলেও সম্পূর্ণ মানা সম্ভব নয়। নতুন যা কিছু তা যে অনেকাংশেই বেশ অসুবিধার সৃষ্টি করছে তা অগ্রাহ্য করি কী করে? এই যে চোখের সামনে আদিবাসীদের গ্রামগুলো দৃশ্যতই পাল্টে গেল তার পেছনের কারণগুলো তাহলে কী? একটা সময় এই সমস্ত সাঁওতাল গ্রাম দেখতেও পর্যটকেরা আসত। গ্রামের ছবি তোলার আদর্শ অঞ্চল হিসেবে পরিগণিত হতো একসময়। আজ কোন ছবি ভেসে ওঠে? কংক্রিটের জঙ্গল দেখতে ভালো লাগে কিনা জানি না। তার জন্য এত পথ পেরিয়ে আসার কী দরকার? ঘরে বসে অবনীন্দ্রনাথ, নন্দলাল, রামিঙ্কর, বিনোদবিহারীদের ছবি তাহলে ইতিহাস হয়েই থাক, যার আর কোনও ধারাবাহিকতা থাকবে না। নতুন প্রজন্ম কংক্রিটের গ্রামই আঁকুক।

আসলে গাছে গাছে শোভিত জঙ্গলের ধারে কিংবা ভেতরে বনবাসীদের যে গ্রামগুলো ছিল, ছিল মাটির বাড়ি আর তার গায়ে আদিবাসীদের আঁকা দেওয়ালচিত্র, তা আর চোখে পড়ে না। সেইসব গ্রামের সত্তর শতাংশই এখন কোঠা বাড়ি। মনে পড়ে, রবীন্দ্রনাথ শ্রীনিকেতনে একতলার উর্ধ্বে কোনও বাড়ি চাননি। রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন রবীন্দ্রভবন দোতলা করলেন তখন রবীন্দ্রনাথ ছেলের ওপর রাগ করে কিছুদিন শান্তিনিকেতন ছেড়ে সুরুলের জমিদার বাড়িতে থাকা শুরু করেছিলেন। সে তো আজ বিস্মৃত কাহিনি। বর্তমানে শান্তিনিকেতনে তো একটার পর একটা দোতলা, তেতলা বাড়ি নির্মিত হচ্ছে। তা কার নির্দেশে? কাদেরই বা মস্তিষ্কপ্রসূত এই কাণ্ডকারখানা! একবারও কেউ ভেবে দেখল না রবীন্দ্রনাথ কী চেয়েছিলেন বা কেন চেয়েছিলেন। রবীন্দ্রভাবধারার এমত বিসর্জন কি সত্যিই কাঙ্খিত ছিল?

আরও পড়ুন-পর্যটনের বহর প্রবল! তবু ভালো হাসপাতাল, রাস্তা নেই সাধের শান্তিনিকেতনে

প্রকৃতপক্ষে বোলপুর মহকুমায় যতটা জমি আছে তার বিশ গুণ আছে জমির কারবারি মায় দালাল। রাস্তাঘাটে কারও সঙ্গে দেখা হলেই বলে, "সস্তার জমি আছে। কেউ নিলে বলবেন।" এই দালালরাই আবার একটাই জমি পাঁচজনকে বেচে দিচ্ছে। তা নিয়ে বিস্তর অশান্তির সৃষ্টি হচ্ছে।

অন্যদিকে কলকাতা শহরের লোকজনদের সঙ্গে কথা হলেই বলে, "সন্ধানে কোনও জমি আছে?" কেউ কিন্তু এখানে থাকতে চায় না। চায় একটা বিনোদন গৃহ তৈরি করতে। কেন যে শান্তিনিকেতনে এসেই আমোদ প্রমোদে গা ভাসাতে হবে ঠিক বুঝতে পারি না। একটা শ্রেণির অনেক টাকা। তারা ফুর্তির জন্য খরচ করতে চায়। কিন্তু ওই যে লিখলাম, কেন শান্তিনিকেতন বা বোলপুরেরই সর্বনাশ করতে হবে তার কোনও যথাযথ কারণ আজও বুঝে উঠতে পারলাম না। ইতিমধ্যেই কিন্তু কয়েক হাজার বাড়ি বাবুরা তালাবন্ধ করে ফেলে রেখেছে। বছরে কচ্চিৎকদাচিৎ আসেন আমোদ প্রমোদের নিমিত্তে।

আরও পড়ুন-মদ, মাংস এবং … হোটেল-রিসর্টময় শান্তিনিকেতন এখন যেখানে দাঁড়িয়ে

বল্লভপুরের অন্তর্গত যে খেলেডাঙ্গা গ্রাম, তার পাশ দিয়ে জমি চলে গেছে নদী বরাবর। সেখানে নির্বিশেষে নামে-বেনামে চাষের জমি, খাস জমি আর আদিবাসীদের জমি লুটপাট হয়ে যাচ্ছে। এখানকার প্রভাবশালী জমি মাফিয়ারা নদীর চর কব্জা করে ফ্ল্যাট বাড়ি, রিসর্ট আর কটেজ তৈরি করছে। এতে নদীর নাব্যতা খর্ব হচ্ছে। কিছুদিনের মধ্যেই চূড়ান্ত এক বাস্তুতান্ত্রিক বিপর্যয়ের মধ্যে পড়বে এই বিস্তীর্ণ অঞ্চল। কিছু বলার নেই, কিছু করার নেই। সামগ্রিকভাবে যে সুন্দর লালমাটির রাস্তা ছিল বোলপুর তথা শান্তিনিকেতনের বৈশিষ্ট্য, আজ আর তার কোনও অস্তিত্বই নেই। আচ্ছা, এই যে লালমাটির রাস্তা তা কি 'হেরিটেজ' নয়?

তা নিয়ে কি প্রশাসনের কোনও মাথাব্যথা আছে? না কি শুধুই কামিয়ে নেওয়ার পন্থা হিসেবে সিমেন্ট আর পিচের রাস্তা তৈরি হলো?
এর কোনও উত্তর নেই। ফলে এভাবেই চলবে গাছ কাটা, জমি মাফিয়াদের বাড়বাড়ন্ত চলবে, আদিবাসীদের জীবনযাত্রা পাল্টে যাবে, শহর বাসযোগ্য থাকবে না। তাহলে এভাবেই চলতে থাকবে? এর উত্তরও জানা নেই। হয়তো তাহারা বা উহারা বলতে পারবে। আর অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে থাকব আমরা।

More Articles