গান্ধি-দেশবন্ধুর শেষ দেখার স্মৃতি! দার্জিলিংয়ের নিরালা সেই বাড়িটি...
Deshbandhu Chittaranjan Darjeeling: রোজ পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথে সকাল-সন্ধ্যায় হাঁটতে বেরোতেন তিনি। শরীর সুস্থ করে নতুন উদ্যমে কাজে ফিরতে হবে কলকাতায়, কিন্তু জ্বর পুরোপুরি সারে না।
বাঙালির কাছে ছুটি কাটানোর জন্য প্রথম তিন গন্তব্যে মধ্যে দিপুদা অর্থাৎ দিঘা, পুরী আর দার্জিলিং — এখনও হট ফেভারিট। এর মধ্যে দ্য ক্যুইন অফ হিমালয়াস, অর্থাৎ কিনা দার্জিলিংয়ের টান সহজে ফিকে হওয়ার না। সাধারণ বাঙালির কাছে দার্জিলিং কখনও সমতলের গ্রীষ্মের দাবদাহ থেকে দূরে গিয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখার সহজ উপায়, কখনও বা স্রেফ নিখাদ আলসে রোদে গা এলিয়ে ম্যাল রোডে বসে বা কেভেন্টার্সের ছাদে হট চকোলেটে চুমুক দিয়ে ছুটি কাটানোর টিকিট। তবে, এর পাশাপাশিই দার্জিলিং শহর বহু বাঙালি মনীষীর স্নেহধন্য — সেকথা আজকাল কেই বা তেমন খোঁজ রাখে! দার্জিলিংয়ের হটস্পট যে ম্যাল রোড, তার গা বেয়ে চৌরাস্তা থেকে নীচের দিকে একটু নামলেই দেখা মিলবে একটি ব্রিটি স্থাপত্য শৈলীতে নির্মিত দোতলা সাদা বাড়ির, নাম 'Step Aside'।
এই সাদা বাড়িটির সঙ্গে এক কীর্তিমান বাঙালির নাম জড়িয়ে। ১৯২৫ সালের জুন মাসের ১৬ তারিখ দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ এই বাড়িতেই দেহত্যাগ করেছিলেন। ২০০৭ সালে এই বাড়িটিকে সংগ্রহালয় হিসেবে উদ্বোধন করা হলেও বাইরের ফলক অনুযায়ী ২০১২ সালে এটির মধ্যে স্থায়ী এক্সিবিশনটি উদ্বোধন করেন বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী। তবে এর পরে প্রবল বৃষ্টি ও বজ্রপাতের সময় একটি গাছ বাড়িটির ছাদে পড়ে যাওয়ায় বাড়িটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দোতলা বাড়িটির সম্পূর্ণ মেরামতি করে মিউজিয়ামটি ২০২৪ সালের অক্টোবর মাসে সাধারণ মানুষের জন্য খোলা হয়েছে। বাড়িটির একতলাতে দেশবন্ধুর ছবি ও স্মারক নিয়ে তৈরি স্থিরচিত্র প্রদর্শনী, দোতলায় তাঁর ব্যবহৃত আসবাব, রেডিও ইত্যাদির পাশাপাশি সেই সময়ের ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের তথ্যাদি সমূহ সুন্দরভাবে তুলে ধরা হয়েছে যা পর্যটকদের নিঃসন্দেহে উনিশ শতকের সেই সময়ে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে।
‘Step Aside’ ভিলাটির আসল মালিক ছিলেন এক বিদেশি, যার কাছ থেকে বাংলার অ্যাডভোকেট জেনারেল তথা গভর্নর জেনারেলের কাউন্সিলের ল’ মেম্বার স্যার নৃপেন্দ্রনাথ সরকার বাড়িটি কিনে নেন। সেই সময় জাতীয় রাজনীতিতে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ পুরোধা। একদিকে কলকাতা কর্পোরেশনের নবনির্বাচিত মেয়র পদের গুরুভার, অন্যদিকে জাতীয় রাজনীতির বিভিন্ন কর্মসূচি। বিপুল কর্মভারে জর্জরিত হয়ে দেশবন্ধুর শক্তিক্ষয় হয়। এই সময়েই ডাক্তারের পরামর্শে কাঞ্চনজঙ্ঘার কোলে শৈলশহরে ভগ্ন স্বাস্থ্য উদ্ধারের জন্য ও কিছুদিন বিশ্রামের আশায় এই বাড়িতে আসা। মে মাসের ১১ তারিখে ‘Step Aside’ ভিলার মালিক নৃপেন্দ্রনাথ সরকার তাঁর ব্যবস্থাপককে চিঠি লিখে সস্ত্রীক দেশবন্ধুর আসার কথা জানান, তার পাশাপাশি জানান এক আশঙ্কার কথা, “শরীরটা এবারে তাঁর খুবই খারাপ, মনে হয় না আর খুব বেশিদিন বাঁচবেন”। লতাপাতায় ঘেরা সাদা বাড়িতে দেশবন্ধু এলেন ১৬ মে। রোজ পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথে সকাল-সন্ধ্যায় হাঁটতে বেরোতেন তিনি। শরীর সুস্থ করে নতুন উদ্যমে কাজে ফিরতে হবে কলকাতায়, কিন্তু জ্বর পুরোপুরি সারে না। তখনকার দার্জিলিং শহর এত জমজমাট হয়নি, কিন্তু এই শহরে তাঁর মনের মণিকোঠায় জায়গা করে নিল কিছুদিনের মধ্যেই। কাছাকাছি একটি বাড়ি কেনার কথাও ভাবছিলেন। ইতিমধ্যে অ্যানি বেসান্ত দেশবন্ধুকে দেখতে এসেছেন, ‘commonwealth of India Bill’ নিয়ে আলোচনা করে গিয়েছেন। জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে এলেন স্বয়ং গান্ধিজি। উঠলেন ‘Step Aside’ বাড়িটিরই দোতলার শেষ ঘরটিতে। সেই ঘর এখনও একইভাবে মহাত্মার স্মৃতিরেণু নিয়ে বসে আছে এক কোণে।
দেশবন্ধু ও গান্ধিজির মধ্যে স্বরাজ দল এবং কংগ্রেসের আগামী দিনের রূপরেখা নিয়ে আলোচনা এগোল। এই মিউজিয়ামের দেওয়ালে ভারতের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের দুই পুরোধার দার্জিলিঙের চড়াই উৎরাই পথ বেয়ে হাঁটার ছবি এখনও অমলিন। ইন্দিরা দেবী চৌধুরাণীর স্মৃতিচারণ অনুযায়ী, মহাত্মাজির গায়ে গরম পোশাক যথাস্থানে রাখার দিকে দেশবন্ধু ভীষণ মনোযোগী ছিলেন আর তিনি নিজে লম্বা চাপকান পোশাক পরতেন।
গান্ধিজির দেশবন্ধুকে দেখে ভালোই লেগেছিল, আশা করেছিলেন হয়তো খুব তাড়াতাড়ি কলকাতায় ফিরে যাওয়া সম্ভব হবে। কিন্তু সে আর হয়ে ওঠেনি। ১৪ জুন আবার জ্বর এল, ধীরে ধীরে চেতনা শক্তি হারিয়ে নাড়ির স্পন্দন খাদের কিনারে এসে দাঁড়াল। ১৬ জুন বিকেলে এই প্রিয় জন্মভূমি থেকে চিরবিদায় নিলেন দেশবন্ধু। এই মর্মান্তিক খবর ছড়িয়ে পড়তেই অগণিত গুণমুগ্ধের দল শেষ দেখা দেখতে ভিড় জমান ‘Step Aside’ বাড়িতে, দার্জিলিংয়ের আকাশ-বাতাসে তখন মনখারাপের মেঘ। পরদিন সকালে কফিনবন্দি হয়ে দেশবন্ধু পাড়ি দিলেন স্টেশনের দিকে, তাঁর প্রিয় কলকাতার উদ্দেশ্যে। নতুনভাবে নির্মিত ‘Step Aside’-এর এঘর-সেঘর ঘুরে দেখার সময় অসংখ্য পুরনো ছবি, দেরাজ, সাদা বালিশ, আর দেওয়ালের সাদা রং সুদূর ১৯২৫-এর জুন মাসে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। দেশবন্ধুর মৃত্যুর কিছুদিন পরেই বাসন্তী দেবীকে (দেশবন্ধুর সহধর্মিণী) লেখা দেশবন্ধুর ভাবশিষ্য নেতাজি সুভাষের (সেই সময় তিনি কারাবন্দি ছিলেন) চিঠি পড়ে মন উদাস হয়ে যায়, সে চিঠির ছত্রে ছত্রে যন্ত্রণার গন্ধ যেন এখনও ছাতিম ফুলের গন্ধের মতোই তীব্র।
এই ঘোরের মধ্যেই স্তব্ধতা খান খান করে কাঠের সিঁড়িতে পায়ের আওয়াজ পেয়ে তাকিয়ে দেখি, বাড়ি তথা মিউজিয়াম দেখাশোনার ভারপ্রাপ্ত মানুষটি দরজায় দাঁড়িয়ে। তিনিই টিকিট কাটছেন, আবার ট্যুর গাইড হিসেবে আগত পর্যটকদের এই বাড়ির গৌরবময় ইতিহাসের গল্পও করছেন। ওঁর কাছে শুনলাম এই বাড়ির সঙ্গে জড়িত আর এক বিতর্কিত বাঙালির কথা — তিনি ভাওয়ালের সন্ন্যাসী রাজা, কিন্তু এই বাড়ি থেকে তাঁর মরদেহ বেরলেও রহস্যাবৃত নায়কের মতো নিশ্চিত যমদুয়ার থেকে তিনি ফিরে আসেন। সে গল্প এখনও বাঙালির মনে সমান রোমাঞ্চ সৃষ্টি করে। আরও বললেন যে, বাড়িটি মিউজিয়াম হিসেব নবনির্মিত হওয়ার পাশাপাশি এর ওপরের তলাটিতে দেশবন্ধু নামাঙ্কিত একটি ছোট শিশু ও নারী কল্যাণ কেন্দ্র আছে। প্রাণোচ্ছল দার্জিলিং শহরের প্রাণকেন্দ্র ম্যালের ঠিক নীচে একা দাঁড়িয়ে থাকা ‘Step Aside’ মনে পড়িয়ে দেয় দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের প্রয়াণের পরিপ্রেক্ষিতে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের সেই অমোঘ কথাগুলি, “এনেছিলে সাথে করে মৃত্যুহীন প্রাণ, মরণে তাহাই তুমি করে গেলে দান”। একশো বছর পরে ‘Step Aside’ শুধুমাত্র স্থাপত্য হিসেবে নয়, দেশের প্রতি এক গভীর ও চিরন্তন ভালোবাসা, দায়িত্ব তথা এক মহান প্রাণের চিহ্ন বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আজও।