ত্রাণ দেখিয়ে প্রাণ নেওয়া? যা চলছে গাজায়
Gaza: গাজার ২৩ লাখ মানুষ পুরোপুরি ত্রাণে নির্ভরশীল। আর সমস্যা হল ত্রাণ আসে ইজরায়েল হয়ে। গাজার প্রায় প্রতিটি পরিবারই ঘরছাড়া। এখন গাজার মানুষ প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম খাবার পাচ্ছেন।
গাজায় ত্রাণ নিতে গিয়ে গত দেড় মাসে ৭৯৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। ১১ জুলাই জেনেভায় আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে জাতিসংঘ মানবাধিকার কার্যালয়ের তরফে এ কথা জানানো হয়েছে। জাতিসংঘের মুখপাত্র রাভিনা শামদাসানি বলেছেন, চলতি বছরের ২৭ মে থেকে ৭ জুলাই পর্যন্ত ত্রাণকেন্দ্রে ৭৯৮ জনের মৃত্যুর হিসাব পেয়েছি আমরা। তার মধ্যে ৬১৫ জনই মারা গিয়েছেন গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশনের (জিএইচএফ) ত্রাণ কেন্দ্র থেকে। বাকিদের পার্শ্ববর্তী অন্যান্য মানবাধিকার সংস্থার ত্রাণবহরে মৃত্যু হয়েছে।
মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে ইজরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশনের (জিএইচএফ)-এর কার্যক্রম চালু হয় গাজায়৷ জিএইচএফ-এর পরিচালিত নতুন ত্রাণব্যবস্থায় খাবারের জন্য প্রায় প্রতিদিন কয়েক হাজার মানুষ লাইনে অপেক্ষা করেন৷ তাদের এই কার্যক্রম নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা চলছে৷ জাতিসংঘ অভিযোগ করেছে, খাবারকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের করতে ইজরায়েলের এটি একটি পন্থা।
ইজরায়েলি সেনাবাহিনীর পরিচালিত এই ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রটি নিরপেক্ষতার নীতি অবলম্বন করছে না বলেও অভিযোগ করেছে মানবধিকার সংস্থাটি। জাতিসংঘের নেতৃত্বাধীন ত্রাণ ব্যবস্থা মানে না জিএইচএফ। অন্যদিকে ইজরায়েলের অভিযোগ করে, জাতিসংঘের পাঠানো ত্রাণ হামাসের হাতে পৌঁছায়। যদিও হামাস এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
আরও পড়ুন- যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজা থেকে মুনাফা লুটছে মাইক্রোসফট, অ্যালফাবেট?
মার্চ মাসে ইজরায়েল অস্থায়ী যুদ্ধবিরতি না মানার পর থেকে প্রায় ৭,১৪,০০০ ফিলিস্তিনবাসী বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। তার মধ্যে ২৯ জুন থেকে ৩০ জুন ২৪ ঘন্টার মধ্যে প্রায় ২৯,০০০ জনকে খান ইউনূস ছেড়ে বেরিয়ে যেতে বাধ্য করা হয়েছে। বর্তমানে আশ্রয়কেন্দ্রগুলিতে ভিড় উপচে পড়েছে। পর্যাপ্ত পরিমাণ জল, স্যানিটেশন এবং স্বাস্থ্যবিধি মানার মতোও পরিস্থিতি নেই।
স্বাস্থ্য সংগঠনগুলি জানিয়েছে, ত্রাণশিবিরে ডায়রিয়াতে ভুগছেন প্রায় ৩৯ শতাংশ মানুষ। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে খান ইউনিস এবং গাজা। ঘনবসতিপূর্ণ আশ্রয়কেন্দ্র এবং পরিষ্কার জলের অভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন ফিলিস্তিন বাসীরা।
জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেছিলেন, গাজায় ত্রাণ বিতরণের নতুন ব্যবস্থাটি ‘অনিরাপদ' এবং এই ব্যবস্থায় আরও বেশি মানুষ মারা যাচ্ছে৷ গুতেরেস সাংবাদিকদের বলেন, ‘‘মানুষ নিজের এবং তাদের পরিবারের খাবার জোগাড় করতে গিয়ে হত্যার শিকার হচ্ছেন৷ খাবারের সন্ধান কখনোই মৃত্যুদণ্ড হতে পারে না৷''
গাজায় ইজরায়েল ও মার্কিন-সমর্থিত বিতর্কিত ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রে নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করা প্রাক্তন এক কর্মী বিবিসি-কে জানিয়েছেন, ফিলিস্তিনিদের উপর গুলি চালানো হয়েছে। তাঁর কথায়, কয়েকজন নারী, শিশু ও বয়স্ক ব্যক্তি ত্রাণশিবির থেকে একটু দূরে, শুধুমাত্র একটু ধীরে চলায় ওয়াচ টাওয়ার থেকে ইজরায়েল বাহিনী গুলি চালায়।
এই পরিস্থিতিতে অক্সফাম, সেভ দ্য চিল্ডরেন-সহ আরও ১৩০টি প্রতিষ্ঠান ও এনজিও জিএইচএফ-কে বলেছে, তারা যেন ত্রাণশিবির বন্ধ করে দেয়। কারণ, ওই ত্রাণশিবিরে হাজার হাজার মানুষ মারা যাচ্ছেন। কিন্তু জিএইচএফ-এর চেয়ারম্যান জনি মুর ব্রাসেলসে সাংবাদিক সম্মেলন করে বলেছেন, ত্রাণশিবির বন্ধ করা হবে না। ব্রাসেলসে দাবি করেন, তারা এখনো পর্যন্ত পাঁচ কোটি ৫৫ লাখ মিল বিতরণ করেছেন।
ইজরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনী(আইডিএফ) একাধিকবার বলেছে, ত্রাণ নিতে গিয়ে মানুষজন সামরিক ব্যারিকেডের খুব কাছে চলে এলে, সতর্ক করতে গুলি চালানো হয়। তবে এর ফলে এত দিনে ঠিক কতজনের মৃত্যু হয়েছে সেই সংখ্যা তারা জানায়নি।
আরও পড়ুন-২৩০০ টাকা দিয়ে সন্তানের মুখে পার্লে-জি! যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজার এই বাবার কাহিনি স্তব্ধ করে দেয়
এর আগে ২ জুলাই জাতিসংঘের মানবিক বিষয়ক বিভাগ (OCHA) জানিয়েছিল, ইজরায়েলি কর্তৃপক্ষ খান ইউনিসের দুটি এলাকায় রাতারাতি বাস্তুচ্যুতির নির্দেশ দেয়। এখানে প্রায় ৮০,০০০ মানুষ বাস করতেন। বাস্তুচ্যুতির নির্দেশের পর থেকে দক্ষিণ গাজার খান ইউনিসের জলাধার ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। এতে শহরের বিভিন্ন স্থানে জল সরবরাহের সমস্যা হচ্ছে। জল সরবরাহের একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র- এই আল সাতার জলাধার।
গাজার ২৩ লাখ মানুষ পুরোপুরি ত্রাণে নির্ভরশীল। আর সমস্যা হল ত্রাণ আসে ইজরায়েল হয়ে। গাজার প্রায় প্রতিটি পরিবারই ঘরছাড়া। এখন গাজার মানুষ প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম খাবার পাচ্ছেন। ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে অন্তত ৫৭ হাজার গাজার মানুষ মারা গিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে প্রায় এক-চতুর্থাংশই শিশু। চলতি বছরের মে মাসের সমীক্ষায় উঠে এসেছে, ৯৩ শতাংশ মানুষ খাদ্যসংকটে ভুগছেন।
উল্লেখ্য, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইজরায়েলে হামাসের হামলার পর এই সংঘর্ষ শুরু হয়। ওই দিন থেকে ইজরায়েল গাজায় নির্বিচার বোমা হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। ইজরায়েলি সেনার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে শিশুদের উপর সরাসরি হামলার পাশাপাশি খাদ্য ও চিকিৎসা পরিষেবায় বাধা দেওয়ার প্রমাণও পেয়েছে রাষ্ট্রপুঞ্জ। এর আগে ২০২৪ সালে ইউনিসেফের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, গাজার প্রতি ১০ ফিলিস্তিন শিশুর ৯ জনই ‘ভয়াবহ খাদ্য সঙ্কটে’ রয়েছে। ক্ষুধা, পিপাসা এবং মারাত্মক অপুষ্টির কারণে অনেক ফিলিস্তিন শিশুই মারা গিয়েছে। ওই বছরই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছিল, গাজার প্রতি ৫ শিশুর ৪ জনই প্রতি তিন দিনে অন্তত এক দিন পুরো দিন না খেয়ে থাকে। আর কত দিন চলবে এই নৃশংসতা? সেই প্রশ্ন থাকছেই।