সুরা-মাংস-কবরখানার পথ! যেভাবে বদলে যাচ্ছে পার্কস্ট্রিটের সড়ক বাস্তবতা

Kolkata Park Street: এশিয়াটিক সোসাইটির বাড়ি যেখানে শেষ হচ্ছে, সেখান থেকে দশ-পা এগোলেই ছিল মধ্যবিত্তের আওতায় থাকা, খোলামেলা চিনে রেস্তোরাঁ 'পিপিং'।

শেষবার মদ খেয়েছিলাম পার্ক স্ট্রিটের পানশালায়। 'সিলভার গ্রিল'। সঙ্গে ছিল জয়দেব বসু। ১৯৯০। শীতকাল। কুয়াশায় ধোঁয়া-ধোঁয়া রাস্তাঘাট। গভীর রাতে সে যুগে নেভা-নেভা আলো। প্রথম মদও খেয়েছিলাম অধুনালুপ্ত 'ব্লু ফক্স' রেস্তোরাঁয়। ১৯৮০। আমার এক 'খানদানি' দাদার কল্যাণে। তিনি স্কুলের একেবারে উঁচুর দিকের ক্লাসের ছাত্রটিকে নিয়ে গিয়েছিলেন পরবর্তীকালে গ্র্যান্ড হোটেলের একতলায় ক্ষণজীবী 'রং-মহল' এবং অবশ্যই চাং-ওয়ার কেবিনে। পুরনো কালের চাং-ওয়া। তখনও অবশ্য সুনীল-কাব্যের পঙক্তিতে পঙক্তিতে সেগুলি চিহ্নিত হয়নি। কবি শঙ্খ ঘোষের একেবারেই ভিন্ন প্রসঙ্গে একটি বিখ্যাত উচ্চারণ প্রায় প্রবাদে রূপান্তরিত হয়েছিল — 'এক দশকে সঙ্ঘ ভেঙে যায়'। বিয়ার, হুইস্কি, রাম, ভদ্‌কা, জিনের একান্ত সংলাপে আমিও ওই একদশক! সঙ্ঘ এবং সঙ্গ — দুই-ই ভেঙে গেল। আমার আদিযুগের বন্ধু সব্যসাচী রায়, বহুদিন প্রয়াত, তবু তাঁর গলা অবিকল শুনতে পাই — "এই রাস্তায় যারা থাকে, তারাই বলতে পারেন, মদীয় ভবনে..."। রাস্তার নাম পার্ক স্ট্রিট। এখনও মনে হয়, এই রাস্তায় হাঁটা মানে স্মৃতির হাত ধরে এগিয়ে চলা, রাস্তাও পাল্টে-পাল্টে গেছে, আমিও তো বদলে গেছি আশিরনখর! এই রাস্তায় দেখা হয় ফেলে আসা বন্ধুবান্ধবীদের সঙ্গে, হারিয়ে যাওয়া সম্পর্কের সঙ্গে, ফুস্‌ করে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া সহচরের সঙ্গে, হুল্লোড়ে মেতে ওঠা পুরনো সঙ্গীদের সঙ্গে, আর সবচেয়ে বড় কথা, দেখা হয়, নানা বয়সের নিজের সঙ্গে। সেইসব এলোমেলো পদচারণার সঙ্গে উথলে ওঠে কতশত অতীতকাল। ফুলকি ওড়ে স্মৃতিমন্থনের।

একেবারেই বালক বয়সের ধূ-ধূ স্মৃতি থেকে একেবারে টাটকা ঘটনাবলী বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে পার্ক স্ট্রিট। আমার-তোমার-সবার। সবথেকে প্রাচীন স্মৃতি, আত্মীয়পরিজনের সঙ্গে ছয়ের দশকের শেষদিকে 'ওয়ালডর্ফ'-রেস্তোরাঁয় চাউমিন খাওয়া। সেই ওয়ালডর্ফ রেস্তোরাঁও এখন স্মৃতি। কেননা তার জমজমাট অবস্থান এখন পাল্টে গেছে। এখন যাকে ছোট আকারে দেখা যায় লিট্‌ল রাসেল স্ট্রিটে, সে নেহাৎ অতীতের খুদে সংস্করণ। আমার ছোটবেলার ওয়ালডর্ফ ছিল ক্যামাক স্ট্রিটের দিকে, এখন যেখানে বিরাট 'মার্কোপোলো'। তৎকালের ওয়ালডর্ফ-ও ছিল দোতলা। এশিয়াটিক সোসাইটির বাড়ি যেখানে শেষ হচ্ছে, সেখান থেকে দশ-পা এগোলেই ছিল মধ্যবিত্তের আওতায় থাকা, খোলামেলা চিনে রেস্তোরাঁ 'পিপিং'। এখন সেখানে একটা নতুন হোটেল হয়েছে, রেস্তোরাঁ নেই। সেই বালক বয়সে বাবাকে প্রশ্ন করেছিলাম, 'Peiping' শব্দটা এল কোথা থেকে? বাবা বলেছিলেন, ওটা চিনের রাজধানীর নাম। বিশেষ অঞ্চলের উচ্চারণ। তখন অবশ্য আমরা জানতাম, চিনের রাজধানীর নাম 'পিকিং'। 'পেইপিং' শব্দের অর্থ 'উত্তরের শান্তি' (বর্তমানে অবশ্য রাজধানীর নাম হয়েছে 'বেইজিং', কেউ কেউ বলছেন 'পেইচিং')

মদ এবং খাদ্যের অতীব লোভনীয় সম্ভার এই পথে। কত ধরনের খাবারের আকাঙ্খা! নামও নানারকম। কেউ দিচ্ছে ইতিহাসে টান, কেউ দিচ্ছে ভূগোলে শান, কেউ আবার তুলে আনছে বিশেষ কোনও অঞ্চলের সাংস্কৃতিক পরিচয়। এইসব মিলিয়েই দেখা দেয় পার্ক স্ট্রিট!

আরও পড়ুন- প্রাচীন কলকাতায় এসেছিলেন ক্যাপ্টেন হ্যাডক!

'দেখা দেয়' বললাম ভেবেচিন্তেই। কেননা আদ্যন্ত নাগরিকতায় মোড়া এই রাস্তা, তার আলোছায়া, তার সুর-বেসুর, তার হাসিকান্না নানা রঙে ঝলমল করে। ভরতের নাট্যশাস্ত্রে নবরস আর নব মূলভাবের কথা আছে। পার্ক স্ট্রিট যেন সেই নব-তরঙ্গের নববর্ণালী। আসলে, ভেবে দেখেছি, দর্শকের মন মেজাজই যেন প্রতিবিম্বিত হয়, এই রাস্তায়। কোনও এক প্রেমের ছাড়াছড়িতে বেদনার্ত হৃদয়ে দেখেছি পার্ক স্ট্রিট বিষণ্ণ। আবার উল্লাস আনন্দের মনোভাবে সে রাস্তা মনে হয় ফুর্তিবাজের কাড়ানাকাড়া। কোনওদিন উদাস। কোনওদিন ক্রুদ্ধ। কোনওদিন আনমনা। কোনওদিন ক্ষোভে ফুঁসছে। এর দৈর্ঘ্যটাও কম নয়। চৌরঙ্গী রোড বা জওহরলাল নেহরু রোড থেকে সেই পার্ক সার্কাস পর্যন্ত ডানা মেলে রেখেছে। একদিকে সাহেবি পাড়ার মেজাজ, তো অন্যদিকে মোগল-পাঠান-নবাবি আমলের আভিজাত্য! খাবার দোকানের কিসিমেরও তো অন্ত নেই! চিনা, কোরিয়ান, উত্তর ভারতীয়, মোগলাই, মধ্যপ্রাচ্য, আরবি, ফিউশান, বাঙালি, কন্টিনেন্টাল, আফগানি থেকে বিহারি-গুজরাতি, দক্ষিণ ভারতীয় — এ এক আন্তর্জাতিক খাদ্যমেলা, সঙ্গে হরেক ঝাঁঝের পানীয় তো আছেই। রুটি-সুরা-মাংসের এত বহুবিচিত্র সম্ভার আর কোন রাস্তাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে, আমার জানা নেই। খাদ্য এমন এক চিহ্নক, যে কিনা সারা বিশ্বজুড়ে আজ কপালে চিন্তার ভাঁজ এনে দিয়েছে। খাদ্য, খাদ্যাভ্যাস, রান্না পদ্ধতি, পাকবৈচিত্র্য, স্বাদবিশিষ্টতা, আত্মপরিচয়, সংস্কৃতিমিশ্রণ, ভূগোল, সমাজতত্ত্ব, ইতিহাস, দেশান্তর, অভিবাসী, আদিবাসী — শব্দগুলি মিলেমিশে নতুন নতুন আত্মআবিষ্কার এবং ইতিহাসপ্রবাহ উন্মোচন করেছে। এখানেই স্বাদ পরম্পরা আর খাদ্যবৈশিষ্ট্য খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে উঠেছে, বিশেষত ঐতিহাসিক এবং সমাজতাত্ত্বিকদের পক্ষে। তাঁরা ক্রমাগত রাঁধুনি, স্বাদ, ঐতিহ্য এবং রন্ধনপ্রণালীকে নতুন পথে নতুন অভিজ্ঞতার বহুস্বরে বিচার করতে চাইছেন। বিশেষত উপনিবেশ-উত্তরকালে। 'সংস্কৃতি বিদ্যাচর্চা' যখন গতি পাচ্ছে।

ফলে, নানাভাবে পার্ক স্ট্রিট গবেষণার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠছে। কখনও কখনও হেডবাবুর্চিদের সাক্ষাৎকার থেকেও জানা যাচ্ছে নব নব তথ্য। আশ্চর্য সব কাহিনি। এই ধরনের একটি কাজের সঙ্গে আমার যুক্ত থাকার সুযোগ হয়েছিল বছর তিরিশ আগে। তখন 'ওয়েসিস' রেস্তোরাঁর প্রধান রাঁধুনি আর্শাদ আলি বুঝিয়েছিলেন, লখনউ বিরিয়ানি আর হায়দরাবাদি বিরিয়ানি রন্ধনের মূল পার্থক্য ঠিক কোথায়। তিনি কি এখনও জীবিত আছেন? তবে, বিরিয়ানি নিয়ে আমার বিখ্যাত গবেষক বন্ধু নীলাঞ্জন হাজরাকে জিজ্ঞেস করতে হবে, কলকাতায় উচ্চমানের হায়দরাবাদি বিরিয়ানি ঠিক কোথায় পাওয়া যাবে? বিরিয়ানি নিয়ে কথা বলতে বলতে এতই মশগুল হয়ে আছি যে বলতেই ভুলে গেছি, ফ্লুরিজের পাশে প্রায় দশবছর রমরমিয়ে চলা 'মিউজিক ওয়ার্ল্ড'-এর কথা। কত ধরনের গানবাজনা এই দোকান থেকে দ্রুতগতিতে নাচতে নাচতে আমাদের সনাতন-চিরন্তন শহরে ঢুকে পড়েছে সে তালিকা দীর্ঘ। এই তো মনে হয় সেদিন, এক বান্ধবীর উপরোধে ঢুকে পড়লাম, আর তাঁকে কিনে দিতে হলো সুরসম্রাজ্ঞী সুনন্দা পট্টনায়কের সিডি। দিন বড় দ্রুত যায়! পার্ক স্ট্রিট নিজেও বদলে যেতে যেতে পিছন ফিরে দেখে নেয়, কে কোথায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। অনিঃশেষ সংগীতের সমৃদ্ধ ভাণ্ডার সহ সেই 'মিউজিক ওয়ার্ল্ড' এখন নিশ্চিহ্ন!

আরও পড়ুন- এ কলকাতার মধ্যে আছে চৈনিক কলকাতা

ইতিহাস অবশ্য নানা আজব তথ্য মাঝে মাঝেই খুলে দেয়! নথিপত্র জানাচ্ছে, এই পার্ক স্ট্রিট জুড়ে একসময় ছিল স্যার এলাইজা ইম্পের 'ডিয়ার পার্ক'। হরিণের দল হয়তো আঁকাবাঁকা শিঙ উঁচিয়ে হেঁটে বেড়াত, আজ যেখানে অক্সফোর্ড বুক স্টোর, সেখানে! এই রাস্তা বা এলাকার আদিচিহ্ন পাওয়া যাচ্ছে, সিপাহি বিদ্রোহের পরপর। এটা স্পষ্ট হচ্ছে, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কলকাতা দখলের পর থেকেই এই অঞ্চলে সাহেব-মেমদের নজর। এই তল্লাট এবং পথঘাটের নামও বদলে গেছে বিস্তর। এই এলাকায় একাধিক কবরখানা, একাধিক সমাধিক্ষেত্র। একসময় সে কারণে রাস্তার নাম ছিল, 'গোরস্থান কা রাস্তা' কিংবা 'বেরিয়াল গ্রাউন্ড রোড'। শ-দুয়েক বছর আগেও এই জায়গাটা বাসস্থান হিসেবে কোনও স্বাভাবিক গৃহস্থ বেছে নিতে চাইতেন না। পুরনো মানুষজন, এমনকী বয়স্ক অ্যাংলো ইন্ডিয়ান পরিবারে গিয়ে শুনেছি, পার্ক স্ট্রিট ঘিরে কত তটস্থ করে দেওয়া গা-ছমছমে ভৌতিক কাহিনি। গভীর রাতে এখনও নাকি লোরেটো কলেজের দিকটায় প্রেতাত্মাদের দেখা যায়, শোনা যায় তাদের হাসির শব্দ। তারা পুরুষ না স্ত্রী, অর্থাৎ ভূত না পেত্নি, সেটা কিন্তু হলফ করে বলা যায় না!

ওদিকে, ইম্পের ডিয়ার পার্ক থেকেই পার্ক স্ট্রিট নাম কিনা সেটাও নিশ্চিত করে কেউ জানে না। অনেক প্রাচীন পুঁথিতে অবশ্য উল্লেখ আছে, এ জায়গাটার নাম ছিল বাদামতলা, তখন জঙ্গল থেকে সহজেই ঢুকে পড়ত জানোয়ার। এ স্থান ছিল বন্য পশুদের স্বাভাবিক চারণক্ষেত্র। এখন যেখানে 'সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ' এবং 'সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুল' — সেখানে একদা ছিল সাহেবদের সাঁ সুজি থিয়েটার! শীতকালে রাতবিরেতে ওই রাস্তা জুড়ে নাকি পথবাসীরা, প্রহরীরা স্পষ্ট শুনেছেন ঘোড়ার খুরের শব্দ আর আবছা নানা ঘোড়ার গাড়ি, হই-হল্লার ভাঙা ভাঙা আওয়াজ!

খাদ্যের যেমন হরেক পশরা, তেমনই পার্ক স্ট্রিটের দুই ফুটপাত জুড়ে নানা কিসিমের দোকান! এইসব দোকান ঘুরতে ঘুরতে দেখা যায়, বিলিতি সিগারেট, পারফিউম, আতর এসব যেমন আছে, তার সঙ্গে সঙ্গে আছে বেশ কিছু বইয়ের দোকান। ঘণ্টার পর ঘণ্টা এইসব দোকানে বই হাতড়াতাম। একবার বন্ধুদের সঙ্গে বাজি ধরে ইন্দ্রাশিস একটি বহুমূল্য বই দিনেদুপুরে চুরি করে, নিঃশব্দে, বইয়ের নাম 'Complete Works of Shakespeare' এবং পরের দিন, সমস্ত অপরাধ কবুল করে, বইটি আবার দোকানির কাছে ফিরিয়ে দিয়ে আসে। সালটা সম্ভবত ছিল ১৯৮৬। ইন্দ্র বেশ কিছু বছর ইংল্যান্ডে ছিল, তারপর চাকরি করত পুনেতে, অমৃতাকে বিয়ে করেছিল, এখন বছর দশ-বারো জানি না কোথায় আছে! বাজি জেতার টাকায় আমরা 'কোয়ালিটি' রেস্তোরাঁয় পেটপুরে খেয়েছিলাম, সেটা মন থেকে মুছে যায়নি! 

আরও পড়ুন- আলিপুর চিড়িয়াখানায় দুপুর কাটাতেন জীবনানন্দ

পার্ক স্ট্রিটের ফুটপাথেই একটা বই দেখেছিলাম ২০০৪ বা ২০০৫ সালে, তার নাম ছিল 'Street Reality'। লেখকের নাম স্মৃতি হাতড়েও মনে পড়ল না। বাংলা করলে দাঁড়ায় 'সড়ক বাস্তব'। আজ একথাও মনে পড়ছে না, সে বই হাতে তুলে দেখেছিলাম কিনা। গাঢ় সবুজে সাদা-হলুদ কারুকাজে নামটা আবছা মনে আছে। সে হাতড়ে লাভ নেই। 'সড়ক বাস্তব' শব্দটাই বেশ মায়াময়। কতরকমের ইশারা লুকিয়ে আছে। পার্ক স্ট্রিটের সূত্রেই ভাবতে থাকি। এই বাস্তবতাকে ঘরে বা গৃহে খুঁজে পাওয়া যাবে না। এর টানেই গৃহস্থ আনমনা হয়, ভবঘুরে হয়, নতুন নতুন বাস্তব ছবিতে আলোড়িত হয়। পথের টানে বেরিয়ে পড়ে। পার্ক স্ট্রিটের জৌলুশ, রং বাহারি দৃশ্যসমূহ। মদিরা আর ঔজ্জ্বল্য, মনে হয় হাতছানি দিয়ে ডাকে। বেশ ভোরের পার্ক স্ট্রিট দেখার সুযোগ হয়েছে ফ্লুরিজে প্রাতরাশ খেতে গিয়ে। সে কয়েক দশক আগে। রাত দুটো আড়াইটেয় পার্ক স্ট্রিট থেকে ফেরত আসার অভিজ্ঞতা বেশ কয়েকবার। দুপুর-বিকেল-সন্ধেয় তো অহরহ পার্ক স্ট্রিট গেছি। এ মুখ থেকে ও মুখ। মনে হয়েছে ট্রামরাস্তায় এসে থমকে গেছে যে পার্ক স্ট্রিট, তার যে সাহেবিকতা আর স্যুটবুটের কসমোপলিটান সংস্কৃতি, রাস্তা পেরোলেই তার বাসিন্দা, ভাষা, চালচলন, জীবন-জীবিকা দুম করে যেন অনেকটাই পাল্টে গেল। পাল্টে গেল 'সাংস্কৃতিক' পরিমণ্ডল। যাকে বলছি 'সড়ক বাস্তব'। সিরাজ গোল্ডেন রেস্তোরাঁ থেকে পার্ক সার্কাস সাত মাথার মোড় পর্যন্ত দৃশ্য-গন্ধ-স্বাদ বেশ অনেকটাই এপারের থেকে আলাদা। এটাই হল 'সড়ক বাস্তবতা'-র মোদ্দা বুনিয়াদ। এই টুকরো-টুকরো দৃশ্য, মানুষজন, বাড়ির আকারপ্রকার, শব্দ-গন্ধ, স্থাপত্য এবং দোকান-দোকানির রকমসকম, আলো-আঁধারি, এমনকী রাস্তাঘাট - সবই এই 'সড়ক বাস্তব'। ছেঁড়া-ছেঁড়া এমন কতশত দৃশ্যে পথের আলো! পথের শ্বাস! পথের কথকতা! আড্ডা-চর্চা-গুঞ্জন থেকে পোশাক কিংবা চায়ের দোকানের আলো - সবের সঙ্গে 'সড়ক বাস্তব' শব্দটা মিশে আছে। পার্ক স্ট্রিট সেই দিক থেকেও আজব বহুস্তরিক ক্ষেত্র!

আমাদের অল্পবয়সে পার্ক স্ট্রিটে অনেক রেস্তোরাঁ ছিল যার চিহ্ন পর্যন্ত আজ মুছে গেছে। যেমন, দুটোর কথা বলি। ভাবলেই বুক টনটন করে ওঠে। একটার নাম ছিল T3। সেখানে পেল্লাই একটা ঘরে দারুণ চা, একটু স্ন্যাক্স আর পেস্ট্রি খাওয়া যেত। ঠিক ফ্রি-স্কুল স্ট্রিট পার্ক স্ট্রিটের সংযোগে। যে বাড়িতে এখন অলিয়ঁস ফ্রঁসেজ আর ম্যাক্সমুলার ভবন, তারই একতলায়। সেখানে বন্ধু-বান্ধবীদের সঙ্গে নিশ্চিন্তে অনেকক্ষণ বসে থাকা যেত। একাও বসে নিরীক্ষণ করা যেত চলমান, দ্রুত-মন্থর, মেঘলা-রোদে পোড়া - বৃষ্টিমুখর পার্ক স্ট্রিট আর নানা বয়সের নানা ধরনের নানা চেহারার, মানুষের আনাগোনা! আমরা সকলেই জানি এই ধরনের ক্যাফের জন্য বিখ্যাত হলো ফ্রান্সের প্যারিস শহর! বিশ্ববিশ্রুত দার্শনিক, চিন্তাবিদ এবং লেখক জাঁ পল সার্ত্র এমনই এক ক্যাফেতে বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত সঙ্গীসহ বা সঙ্গীহীনভাবে বসে থাকতে এবং সবাইকে প্রায় প্রত্যেক বিকেলে অবলোকন করতে ভালোবাসতেন। নাগরিক চর্যার পশ্চাৎপট হিসেবে কাজ করত ক্যাফে আর সড়ক বাস্তব! টি-থ্রি তেমনই এক আমেজ এনে দিত হামেশাই।

অনেক কথা বলা এখনও বাকি রইল। পার্ক স্ট্রিটের সমাধিক্ষেত্রে আমার দেখা হয়েছিল এক ভূতের সঙ্গে। সত্যিই কি দেখা হয়েছিল? সেসব কথা জড়ো হয়ে ঘিরে ধরবে পরবর্তী কিস্তিতে। ততক্ষণের জন্য বিরতি। চলুন, এর মধ্যে একদিন পার্ক স্ট্রিট ঘুরে আসি।

More Articles