মোদি সরকার কেন ভারতের যুবকদের চাকরি দিতে পারছে না?

Unemployment in India: ২০২৩ সালের জুলাই থেকে ২০২৪ সালের জুনের মধ্যে স্ব-নিযুক্তি দেশের মোট শ্রমশক্তির ৫৩ শতাংশ থেকে বেড়ে ৫৮ শতাংশের বেশি হয়ে গিয়েছে৷

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, কীভাবে তাঁর সরকার দেশের তরুণদের জন্য কর্মসংস্থান তৈরি করবে সে সম্পর্কে অনেক দাবি করেছেন। বাস্তবে অবশ্য কিছুই তেমন ঘটেনি বা যেটুকু ঘটেছে তা বলার মতোই নয়। প্রকৃতপক্ষে, গত এক দশকে সরকারের বেশ কয়েকটি পদক্ষেপ দেশে বেকারত্ব বাড়িয়েছে এবং কর্মসংস্থান সংকোচনের হারও বাড়িয়েছে। বিশেষত ২০১৬ সালের নভেম্বরে নোট বাতিল, পরের বছর তড়িঘড়ি করে পণ্য ও পরিষেবা কর (জিএসটি) কার্যকর করা এবং কোভিড-১৯ মহামারীর পরে ২০২০ সালের মার্চ থেকে লকডাউনের ফলে শহর থেকে হাজারে হাজারে পরিযায়ী শ্রমিকের গ্রামে ফিরে যাওয়া পরিস্থিতিকে আরও খারাপ করে তুলেছে।

দেশের তরুণদের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দেওয়াই যে এই মুহূর্তে দেশের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জগুলির অন্যতম– তা নিয়ে কোনও দ্বিমত নেই। কেন? ভারতের প্রায় ১৪৫ কোটি জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেকই ২৮ বছরের নিচে এবং প্রায় দুই-তৃতীয়াংশের বয়স ৩৬ বছরের নীচে।

নন-গভর্নমেন্ট সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকোনমি (CMIE) জানাচ্ছে, যুবকদের বেকারত্ব ২০২২-২৩ সালে রেকর্ড সর্বোচ্চ ৪৫.৪ শতাংশে পৌঁছেছে। তারপর থেকে, কিছুটা কমলেও, তা খুব একটা উল্লেখযোগ্য নয়। ২০১১-১২ এবং ২০২২-২৩-এর মধ্যে, দেশের অর্ধেকেরও বেশি পুরুষ এবং দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি মহিলাকে 'সেলফ এমপ্লয়েড' বা স্ব-নিযুক্ত' হিসাবে দেখানো হয়েছিল। খুব স্বাভাবিকভাবেই বোঝা যাচ্ছে, উপযুক্ত চাকরি খুঁজে না পাওয়ার ফলেই স্ব-নিযুক্তিতে বাধ্য হয়েছেন তাঁরা। অর্থনীতিবিদদের একাংশ স্ব-নিযুক্তিকে 'সবচেয়ে খারাপ' কর্মসংস্থান হিসাবেই বিবেচনা করেন।

ভারত সরকারের জাতীয় পরিসংখ্যান কার্যালয় স্ব-নিযুক্তিকে বিশেষ উন্নয়ন হিসেবে দেখলেও জাতিসংঘের অংশ আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) কিন্তু স্ব-নিযুক্তিকে কর্মসংস্থান হিসাবে বিবেচনাই করে না। ২০২৪ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত সরকারের পর্যায়ক্রমিক শ্রমশক্তি সমীক্ষার (পিএলএফএস) তথ্য বলছে, ২০২৩ সালের জুলাই থেকে ২০২৪ সালের জুনের মধ্যে স্ব-নিযুক্তি দেশের মোট শ্রমশক্তির ৫৩ শতাংশ থেকে বেড়ে ৫৮ শতাংশের বেশি হয়ে গিয়েছে৷

আরও পড়ুন- অতিরিক্ত শুল্ক চাপিয়ে বাণিজ্য যুদ্ধের ডাক ট্রাম্পের? কতটা বিপদের মুখে ভারত?

ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্পে কর্মসংস্থান তৈরির গতি মন্থর হয়েছে এবং সাম্প্রতিক বছরগুলিতে শ্রমশক্তির অংশগ্রহণের হার (এলএফপিআর) হ্রাস পেয়েছে। আইএলও-র ইন্ডিয়া এমপ্লয়মেন্ট রিপোর্ট ২০২৪ বলছে, দেশের কাঠামোগত বদল এখন 'স্থবির'। এলএফপিআর হচ্ছে, মোট শ্রমশক্তিকে মোট কর্মজীবী জনসংখ্যা (অর্থাৎ ১৫ থেকে ৬৪ বছর বয়সি মানুষ) দিয়ে ভাগ করা হলে যে অনুপাতটি পাওয়া যায় সেই সংখ্যা।

গত লোকসভা নির্বাচনে ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) ফলাফল আগের থেকে খারাপ হওয়ার গুরুত্বপূর্ণ কারণগুলির মধ্যে অন্যতম হচ্ছে চাকরি দিতে না পারা বা কর্মসংস্থান তৈরির অক্ষমতা। সরকারের কেন্দ্রীয় নীতি এবং প্রকল্পগুলি ভারতীয় যুব সমাজের জন্য চাকরি তৈরিতে সফল হয়নি কারণ এগুলি মূলত সংগঠিত ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত মালিকানাধীন বড় ব্যবসা এবং কোম্পানিগুলির সদিচ্ছার উপরই নির্ভরশীল হয়ে থেকেছে। এই ধরনের সংস্থাগুলির প্রথম লক্ষ্যই হচ্ছে সর্বাধিক মুনাফা তৈরি, চাকরি তৈরি নয়। তুলনামূলকভাবে কম কর্মচারীর প্রয়োজন এমন প্রযুক্তি দিয়ে যদি উৎপাদনশীলতা বাড়ানো যেতে পারে, তাহলে সংস্থাগুলি সবসময়ই সেই বিকল্প পথই ব্যবহার করে।

অসংগঠিত ক্ষেত্রের ছোট উদ্যোগগুলি অতীতে বড় কর্পোরেট সংস্থাগুলির চেয়েও বেশি কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করেছে। তবে MSMEs (ক্ষুদ্র, ছোট এবং মাঝারি উদ্যোগ) সাম্প্রতিক বছরগুলিতে যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে এবং ২০১৭ সালের ১ জুলাইয়ের পর থেকে নোটবাতিল এবং জিএসটি কার্যকরের কারণে অনেক ক্ষেত্রই ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তারপর থেকে প্রায় সাড়ে ৭ বছরে জিএসটি সম্পর্কিত নিয়মগুলি ৯০০ বারের বেশি সংশোধন করা হয়েছে। জিএসটি 'শ্রম নিবিড়' এমএসএমইগুলিকে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। বিশেষত মাইক্রো এন্টারপ্রাইজগুলি যারা টেক্সটাইল এবং গার্মেন্টস, চামড়াজাত পণ্য যেমন জুতো, কাঠের আসবাবপত্র এবং প্রেসার কুকারের মতো রান্নাঘরের সরঞ্জাম তৈরি করে, তাদের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। সরকারের অ্যানুয়াল সার্ভে অফ ইউনিকর্পোরেটেড এন্টারপ্রাইসেস অনুসারে, ২০০৬ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে, ২৪ লক্ষ ছোট সংস্থা বন্ধ হয়ে গিয়েছে যার ফলে অনানুষ্ঠানিক খাতে শ্রমিকের সংখ্যা ১.৩ কোটি কমেছে।

ভারতীয় অর্থনীতিকে ব্যাহত করে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টিকে বাধাগ্রস্ত করেছিল কোভিড-১৯ মহামারীর পরিপ্রেক্ষিতে ২০২০ সালের ২৪ মার্চ হঠাৎ লকডাউন ঘোষণা করে দেওয়া। মহামারী চলাকালীন অনেক দেশের অর্থনীতি সংকুচিত হলেও, ভারতের অর্থনীতি ৫.৮ শতাংশ (আগের বছরের তুলনায়) সঙ্কুচিত হয়েছিল, যেখানে সারা বিশ্বে গড় সংকোচনের হার ছিল ৩.১ শতাংশ। সাধারণত ভারতে এবং বেশিরভাগ দেশেই, কর্মীরা কাজের সন্ধানে গ্রামীণ এলাকা থেকে শহরে চলে যান। সেবার প্রথম উল্টো অবস্থা দেখা যায়।

মহাত্মা গান্ধি ন্যাশনাল রুরাল এমপ্লয়মেন্ট গ্যারান্টি অ্যাক্টের (MNREGA) অধীনে প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য বাজেট বরাদ্দ কয়েক বছর ধরে বাড়ছে। মজার বিষয় হচ্ছে, এই প্রকল্পটিই ২০১৫ সালে প্রধানমন্ত্রী মোদির লোকসভায় সমালোচিত হয়েছিল। মোদি সরকার একে বিরোধী কংগ্রেস দলের চাকরি প্রদানে ব্যর্থতার প্রতীক হিসাবে তুলে ধরেছিল। যাইহোক, লকডাউনের ফলে গ্রাম থেকে শহরাঞ্চলে পরিযায়ী শ্রমিকদের এই বিপরীতমুখী সফরের পরে, সরকারের কাছে স্পষ্টতই স্বীকার করা ছাড়া আর কোনও উপায় ছিল না যে মনরেগা এমন একটি প্রকল্প যা গ্রামীণ এলাকায় দরিদ্রদের ভীষণ সাহায্য করেছে। এমনকী অর্থ প্রদানে দেরি হওয়া এবং ছোটখাট দুর্নীতি সত্ত্বেও এটি গুরুত্বপূর্ণই থেকেছে।

আরও পড়ুন- শুধু প্রসাদ বিতরণ নয়, লাগবে কর্মসংস্থান

MNREGA-এর জন্য ২০২৪-২৫ বাজেট বরাদ্দ (২০২৫ সালের ৩১ মার্চ শেষ হওয়া অর্থবর্ষের হিসেবে) ছিল এখনও পর্যন্ত সর্বোচ্চ ৮৬,০০০ কোটি টাকা। এই একই পরিমাণ টাকা আগের অর্থবর্ষে অর্থাৎ ২০২৩-২৪-এ ব্যয় করা হয়েছিল। এই পরিমাণ টাকাও চলতি আর্থিক বছরের (২০২৫-২০২৬) জন্য বাজেটে বরাদ্দ করা হয়েছে। তিন বছর আগে, ২০২২-২৩ সালে, লকডাউনের কারণে শহর থেকে গ্রামে শ্রমিকদের চলে আসার কারণে MNREGA প্রকল্পের প্রকৃত ব্যয় ছিল ৯০,০০০ কোটি টাকার বেশি।

সরকারি অর্থনীতিবিদরা নানা সময়ে দাবি করেছেন যে, দেশের কর্মসংস্থান পরিস্থিতি এতটা খারাপ নয় এবং ভারত বিশ্বের 'দ্রুত বর্ধনশীল' বৃহৎ অর্থনীতি হওয়ায় আরও কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। উল্লেখ্য, কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়ানোর জন্য অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে জনসংখ্যার মধ্যে সমানভাবে ছড়িয়ে দিতে হবে। অথচ ১৪০ কোটির বেশি জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ দৈনিক ১০০ টাকার কম খরচে বেঁচে থাকে। টমাস পিকেটি সহ বহু অর্থনীতিবিদ বলছেন, ভারত বর্তমানে আয় এবং সম্পদ বণ্টনের ক্ষেত্রে বিশ্বের সবচেয়ে অসম রাষ্ট্রের অন্যতম।

কংগ্রেসের তৈরি একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারতে বেকারত্ব সংকট "মারাত্মক আকার নিয়েছে।" ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যু এবং আত্মহত্যার রিপোর্ট অনুসারে, ২০১৮ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে, বেকারত্বের কারণে ১৫,৮৫১ জন আত্মহত্যা করেছেন দেশে।

কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য বেসরকারি খাতে আর্থিক অনুদান দেওয়া নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ। তবে নতুন বিনিয়োগ না করলে এবং গৃহস্থালির ব্যয় গত ২০ বছরের সর্বনিম্ন অবস্থা থেকে না বাড়লে চাকরি আপনা আপনিই তৈরি হবে না। ভারতে যুবকদের শিক্ষার মাত্রা বেড়েছে এবং ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এখন অনেক শিক্ষিত যুবকই আর কৃষিকাজ করতে চায় না। মোদি সরকারের বিশ্বাস ছিল যে ধনী পুঁজিপতিরা, মুকেশ আম্বানি এবং গৌতম আদানি কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে এবং যুবকরা স্ব-নিযুক্ত হবে। এমন বিশ্বাস মিথ্যায় প্রমাণিত হয়েছে। যতক্ষণ না এই মানসিকতার পরিবর্তন হবে, ভারতের বেকারত্বের সঙ্কট সামান্যও কমবে না।

More Articles