ভিয়েনার বৃষ্টিদিন: ক্যাফে কামু আর সাশার নিজের দেশ
Vienna Tour: যুবতী কবি। একটু নার্ভাস। সঙ্গে সম্ভবত তাঁর প্রেমিক। মাঝেমধ্যে সে কবির চুলে আলতো হাত বুলিয়ে দিচ্ছে, কখনও আবার হালকা চুম্বনে আশ্বস্ত করছে।
সেদিন রাতে বাজনা শুনে বেরিয়েই একটা চমৎকার ক্যাফে আবিষ্কার করেছিলাম। এলিজাবেথস্ট্রাসা আর এসখেনবাখগাসা, দুই রাস্তার মোড়ে। খাবার টুকটাক পাওয়া যায় বটে, তবে মূলত পানীয়। নাম ক্যাফে কাম্যু। রাস্তায় যেমন চেয়ার টেবিল পাতা, তেমন ভেতরেও অনেকটা বসার জায়গা। গমগম করছে। ক্যাফের নামের সঙ্গে যেন একটা সঙ্গতি রেখেই বিভিন্ন বয়সের আঁতেলরা আড্ডা জমিয়েছে। মেনুকার্ডে কাম্যুর ছবি। হালকা জ্যাজ চলছে ভিতরে। সত্যি বলতে কী জায়গাটা বেশ মনে ধরেছে। (ছবি ৩.১)।
ইতিমধ্যে আমাদের সেই গাড়ির চালক সাশা দোরদেভির সঙ্গে বেশ আলাপ জমে গিয়েছে। এ ক'দিন ভিয়েনা থেকে এদিক ওদিক যাওয়ার জন্য যখনই বেরিয়েছি বাস বা ট্রেন স্টেশনে আমাদের স্বল্প ভাড়ায় পৌঁছে দিয়েছে সাশা। সে বেশ গপ্পে মানুষ। নানা কথা বলে নিজের জীবন নিয়ে, আমাদের কথাও জিজ্ঞাসা করে। ভিয়েনাকে বিদায় জানানোর সময় হয়ে এসেছে, এরপর যাব স্লোভেনিয়া, সাশার সঙ্গে কথা হয়েই রয়েছে যে সে আমাদের বাস স্টেশনে পৌঁছে দেবে যথারীতি। ওর নিজের তিনটে গাড়ি, তিনটেই ভাড়ায় চলে। নিজে চালায় একটা বেশ বিলাসবহুল কালো রঙের মার্সিডিজ, আর অন্য দুটো চালায় অন্য লোকে। তবে তারাও আদতে বসনিয়ার বাসিন্দা। যদিও এরা অনেকেই এখন অস্ট্রিয়ার নাগরিক, নিজের পুরনো দেশের প্রতি একটা স্বাভাবিক টান রয়ে গিয়েছে বুঝতে পারি। সাশার আর দুই গাড়ির চালকের মধ্যে একজনের সঙ্গে আলাপও হয়েছে। নেহাত যুবক। নাম ফেরি। তার জন্মও ভিয়েনাতে। তবু নিজেদের মধ্যে এরা বসনিয়ার ভাষাতেই কথা বলে। আইডেন্টিটি ভারী মজার জিনিস।

মেনুকার্ডে কাম্যুর ছবি (ছবি ৩.১)
পড়ুন প্রথম পর্ব- ভিয়েনার দিবারাত্র: মিউজিয়াম, উনিশ শতক আর রোদ্দুরমাখা ক্যাফেটি
যাইহোক, যা বলছিলাম। এর মধ্যে বারকয়েক সাশার সঙ্গে আড্ডা দেওয়ার প্রসঙ্গ উঠেছে। প্রথমে ভদ্রতাবশতই বলেছিলাম, তারপর মনে হলো, বসলেই হয়। এমন অভিজ্ঞতা আগে হয়নি। সাশাকেও যথেষ্ট ইচ্ছুক মনে হলো। টেলিফোনে কথা হলো, আজ সন্ধ্যায় ক্যাফে কাম্যুতে বসা হবে খানিকক্ষণ। আজ সাশার অফ ডে, নিজেই নিজেকে ছুটি দিয়েছে, বিকেল পাঁচটায় দেখা হবে কথা হলো। আমরা ওল্ড টাউন থেকে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গিয়েছি বেশ খানিক আগে। ঠান্ডা বেশ, তাই ভিতরেই বসেছি। ঢুকে দেখি আজ সেখানে একটা বই প্রকাশের অনুষ্ঠান। চেয়ার পাতা হয়েছে একদিকে সার দিয়ে, এক কোণায় মাইক্রোফোন, সামনে দুটো চেয়ার আর একটা ছোট গোল টেবিল (ছবি ৩.২)। টেবিলে দুটো ওয়াইন গ্লাস রাখা। যাঁর বইয়ের প্রকাশ হবে তাঁকেও দেখলাম। যুবতী কবি। একটু নার্ভাস। সঙ্গে সম্ভবত তাঁর প্রেমিক। মাঝেমধ্যে সে কবির চুলে আলতো হাত বুলিয়ে দিচ্ছে, কখনও আবার হালকা চুম্বনে আশ্বস্ত করছে। প্রেম ঘোষণার এই সোচ্চার আর পাবলিক প্র্যাকটিস ইউরোপের সর্বত্র, রেস্তোরাঁ অথবা রাজপথে, রণে, বনে, জলে, জঙ্গলে নিতান্তই স্বাভাবিক। এই খোলামেলা ভাবটা আমার মন্দ লাগে না মোটে। যা হোক, যা বলছিলাম, একে তাকে জিজ্ঞাসা করে বুঝলাম তরুণ কবির বই উন্মোচনে তাঁর প্রকাশকের সঙ্গেই তাঁর কথোপকথন। চেয়ার ভরলেই অনুষ্ঠান আরম্ভ হবে। কিন্তু, চেয়ার তো আর ভরে না। বিকেল চারটের সময় অনুষ্ঠান আরম্ভ হওয়ার কথা, ঘড়িতে প্রায় পৌনে পাঁচ। এসেছেন সাকুল্যে পাঁচ-সাত জন। তাঁরাও যা বুঝলাম, কবির পরিচিত সুজনদা, মুনুমাসি, অথবা রিংকুদিদি। কবিতা বোধহয় আজকাল কম লোকেই পড়ে, অথবা পড়লেও এইসব প্রকাশ অনুষ্ঠানে খুব উৎসাহ নেই। আবার নিজের শহরের কথা মনে পড়ে গেল অযথাই।

বই প্রকাশের অনুষ্ঠান (ছবি ৩.২)
সাশার আসতে দেরি হলো পাক্কা আধঘণ্টা। জিভ-টিভ কেটে বসে একটা বিরাট জাগ ভর্তি বিয়ার অর্ডার দিল। আমরা চাইলাম এপেরল স্প্রিত্জ (Aperol Spritz), ইউরোপের বেশ চলতি একটা পানীয়। সঙ্গে এ দেশের বিখ্যাত মিষ্টি, আপেলের পুর দিয়ে তৈরি, আপফেলস্ত্রুডেল (Apfelstrudel) (ছবি ৩.৩)। মিষ্টি খাওয়া আমাদের দু'জনেরই বারণ, তবে বিদেশে নিয়ম নাস্তি।

এপেরল স্প্রিত্জ

এ দেশের বিখ্যাত মিষ্টি, আপেলের পুর দিয়ে তৈরি, আপফেলস্ত্রুডেল (ছবি ৩.৩)
সাশা আজ খুবই উত্তেজিত হয়ে রয়েছে। সে গিয়েছিল ডাক্তারের কাছে, হাঁটুর চিকিৎসা করতে। হাঁটুতে ব্যথা অনেকদিন। দেখলাম, এখানকার ডাক্তারদের প্রতি বিন্দুমাত্র আস্থা নেই তার। “একটা চক্র বুঝলে, একটা ভয়ানক চক্র, ইন্সিওরেন্স আর ডাক্তারের চক্র!” “কীরকম?” জিজ্ঞেস করতে যা বুঝলাম, লিখছি। অস্ট্রিয়াতে সস্তার সরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থার গায়ে গায়েই রয়েছে ব্যয়বহুল বেসরকারি চিকিৎসার ব্যবস্থা। যে ডাক্তার সকালে সরকারি ক্লিনিকে চিকিৎসা করেন, বিকেলে তিনিই আবার নিজস্ব ক্লিনিক চালান। সকালে তাঁকে দেখাতে গেলে পরের অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাওয়া যায় এক মাস, কখনও দুই মাস পর। এত দেরি কেন জিজ্ঞেস করলে সহজ উত্তর, “কাল অ্যাপয়েন্টমেন্ট চাই? আমার চেম্বারে চলে এসো।” সাশার আজ সেরকম ব্যাপার হয়েছে বুঝলাম। তাই মেজাজ খুব শরিফ নয়।
পড়ুন দ্বিতীয় পর্ব- ভিয়েনার ক্যাফেতে: গুলাশ, রাই ব্রেড আর দুই পলিটিক্যাল রিফিউজির কিসসা
এই হতাশার কথা বলতে বলতেই সাশা কেমন আপনমনে বসনিয়ায় ফিরে গেল। সেই আইডেন্টিটি। সেখানকার শিক্ষা ব্যবস্থা কত ভালো অস্ট্রিয়ার তুলনায়। “জানো, আমার মেয়ে তো এখানকার ইস্কুলে পড়ে, কিচ্ছু শেখে না। শুধু যে প্রফেশনে যাবে, সিস্টেমটা সেই প্রফেশনের দিকে ঠেলে দিতে চায় ইস্কুল থেকেই। যে অঙ্ক করবে সে কবিতা পড়বে না, যে ডাক্তার হবে সে বিশ্বের রাজনীতি বিষয়ে কিছুই জানবে না। আসলে এইখানকার দণ্ডমুণ্ডের কর্তারা চান না যে নাগরিকরা সব বিষয়েই কিছু কিছু জানুক, তাহলে এদের বিপদ।” চুপ করে শুনছি সাশার কথা। মনে হয়, এইসব কথা ও ওর এখানকার সমাজে কোথাও খুব সহজে বলতে পারে না। আমাদের মতো বিদেশি পেয়ে মনের ক্ষোভ উজাড় করে দিচ্ছে। ফিরে আসে ডাক্তারির কথায়। “এখানকার ডাক্তারগুলো সব নিয়ম ধরে চিকিৎসা করে। কোনও রোগ নিয়ে গেলে ভাবতে চায় না মোটে, বিবিধ পরীক্ষার ফিরিস্তি ধরিয়ে দেয়। ইনস্টিঙ্কট বলে কিছু নেই। থাকলেও ব্যবহার করে না।”

সাশা দোরদেভির সঙ্গে
সাশা নাগাড়ে বলে চলে ওর অভিজ্ঞতার কথা। বছর পাঁচেক আগে ওর কিডনিতে পাথর হয়েছিল। অসহ্য যন্ত্রণা। গিয়েছে হাসপাতালে। সেখানে তরুণী চিকিৎসক ওকে একটা পেইনকিলার জাতীয় ওষুধ দিয়ে বসিয়ে রেখেছে। ধীরে ধীরে ব্যথা কমেছে। ব্যথা কম শুনে চিকিৎসক বলে বাড়ি চলে যেতে। “কী ভাগ্য সেখানে একজন সিরিয়ান ডাক্তার ছিলেন। তাঁর কাগজপত্র নেই। তাই ঠিকার ডাক্তার, প্রেসক্রিপশন লিখতে পারেন না। অধিকার নেই। তিনি শুধু আমার সিম্পটম শুনে আর পেটে হাত দিয়ে বলে দিলেন সম্ভবত কিডনি স্টোন। তারপর খসখস করে প্রেসক্রিপশন লিখে দিলেন, কিন্তু সই করলেন এই অস্ট্রিয়ান ডাক্তার। আমার বসনিয়াতেও এরকম ডাক্তার রয়েছে। তোমার ইন্ডিয়াতেও এমন ডাক্তার আছেন নিশ্চিত। এদের এখানে নেই।” আমি মাথা নাড়ি। আমি নিজে হাইপোকন্ড্রিয়াক। বিশ্বের অনেক জায়গায় ডাক্তারখানায় গিয়েছি। সত্যি বলতে কী, ভারতের ডাক্তারের মতো প্রথম বিশ্বের কোন দেশের ডাক্তারদের প্রতি তেমন ভরসা হয়নি। ক্লিনিক্যাল আই ব্যাপারটায় একটা তফাৎ আছে মনে হয় যেন! এই ব্যাপারে সাশার সঙ্গে আমি সম্পূর্ণ সহমত।
তবে কিনা, আদত কথা ওই “আমার বসনিয়া”। এত বছর পরেও নিজের দেশের প্রতি টানটা সাশার রয়ে গিয়েছে। এর মনস্তত্ত্ব জটিল। গবেষণা করা যায় এই নিয়ে, তবে মাপা যায় না। যা আমার তা ঠিক কেন আমার, সবসময় খুব গুছিয়ে বলা যায় না। ভিয়েনায় সাশার জীবন নিশ্চিতভাবেই বসনিয়ায় তাঁর জীবন যেমন হতে পারত তার থেকে ভালো। তবু, ভালো থাকার মাপ হয়, ভালোবাসার মাপ হয় না। আড্ডার মাঝে বৃষ্টি থেমে গিয়ে রোদ উঠেছে ঝলমলে। আমরাও বাইরে এসে বসেছি সিগারেট খাব বলে। ভিতরে কবিতার বই প্রকাশের কী হলো আর খোঁজ নেওয়া হয়নি (ছবি ৩.৪)।

সেই যুবতী কবি, সঙ্গে সম্ভবত তাঁর প্রেমিক (ছবি ৩.৪)