ভিয়েনার ক্যাফেতে: গুলাশ, রাই ব্রেড আর দুই পলিটিক্যাল রিফিউজির কিসসা

Vienna Tour: স্টিভেন্সপ্লাতজের পেছনের গলিতে কোন সরাইখানায় ভালো গুলাশ পাওয়া যায় আলোচনা করতে করতে উঠে এল সেই ক্যাফে দিগ্‌লাসের কথা। যেখানে গতকাল গিয়েছিলুম কফি খেতে।

আজ সকাল থেকে ভিয়েনায় বৃষ্টি। বেশ ঠান্ডা। এইসব দেশের একটা স্যাঁতস্যাঁতে, গম্ভীর, বয়স্ক ঠান্ডা আছে যেটা বৃষ্টি হলে মালুম হয়। এই ভেজা ঠান্ডাটাকে যথাযথ সম্মান দিতে হয়, নাহলে বিপদ। একটা মোটা জ্যাকেট গায়ে চাপিয়েছি। মাথায় টুপি। গলায় স্কার্ফ। আমরা আজ সকালের দিকে গিয়েছিলাম সেইন্ট পিটার্স গির্জায়। সামনের বিস্তৃত চাতালের নাম পিটার্সপ্লাতজ। গির্জা খুবই চমৎকার, তবে এই সব গির্জার ব্যাপারে লিখব পরের কোনও কিস্তিতে। আজ অন্য কথা।

প্রাচীন শহর ভিয়েনা। প্রাচীন তার রাস্তাঘাট। এই রাস্তাঘাটের ছোট ছোট গর্ত কত প্রাচীন তা বলতে পারি না। তবে আছে। জায়গায় জায়গায় ছোট ছোট গর্ত। বিশেষত ওল্ড টাউনে। বৃষ্টিতে সেইসব গর্তে নিমেষেই জল জমে যাচ্ছে। ইংরেজিতে যাকে বলে পাডেল। এমন রোম্যান্টিক একটা বৃষ্টিস্নাত সকালে (ছবি ২.১) হঠাৎ রাস্তার জল নিয়ে পড়লাম কেন, তার একটা ইমিডিয়েট কারণ রয়েছে। দেশে বিদেশে অনেক দিনের সফরে বেরোলেও খুব বেশি কাপড়জামা নিয়ে আসি না। ছোট একটা সুটকেসে যতটুকু আঁটে, বোঝা বইতে তো বের হইনি। যেসব বাসায় থাকি, আগে থাকতে দেখে নিই কাপড় কাচার যন্ত্র আছে কিনা। তবেই ভাড়া করি। মেপে মেপে জামাকাপড়ের ব্যবহার আমার জীবনে এই পথেই শেখা। তা, আজ সকালে একটা পাতলুনের পাট ভেঙেছি সদ্য। তবে সে ব্যাপারে কি আর ভিয়েনার ট্যাক্সিচালক অবগত! বৃষ্টির সকালে কাজের দিনে তার প্রভূত তাড়া। জলভরা গর্তের উপর দিয়ে গাড়ি চালিয়ে আমার পাতলুনের সাড়ে বারোটা বাজিয়ে সে চলে গেছে। না, না, তুলনা আমি মোটেই করছি না, তবে এমন ঘটনা পৃথিবীর আরও অনেক শহরেই ঘটে থাকে। মেজাজটা একটু ব্যাজার হয়ে গেল যা হোক, যতই ভালো বাজনা শুনি না কেন রাস্তায়, অথবা চমৎকার কফি খাই!

রোম্যান্টিক সেই বৃষ্টিস্নাত সকাল (ছবি ২.১)

পড়ুন প্রথম পর্ব- ভিয়েনার দিবারাত্র: মিউজিয়াম, উনিশ শতক আর রোদ্দুরমাখা ক্যাফেটি

পিটার্সপ্লাতজের একটা বেঞ্চিতে বসে এইসব আকাশপাতাল ভাবছি, এর মধ্যে হোয়াটসঅ্যাপে টেলিফোন বেজে উঠল। ওপারে কুণালদা, কুণাল বসু। বলা যায়, দেশ বিদেশ ঘুরে বেড়ানোয় আমার গুরুস্থানীয়।

“কদ্দুর পৌঁছলে?”

খানিকক্ষণ বাতচিতের পর একটা হালকা গলা খাঁকারি দিয়ে কুণালদা বলল, “বুঝলে, আমি আর সুস্মিতা ভাবছিলাম তোমাদের এ যাত্রায় খানিক সঙ্গ দেব। তোমাদের আইটিনেরারিটা একটু বল দেখি”। কুণালদা গরমকালে অক্সফোর্ডের বাড়িতেই থাকে। ইউরোপ চলে আসা যায় টুক করে। আমাদের মতো অত দিনক্ষণ মাপতে হয় না। বললাম আমাদের সম্ভাব্য যাত্রাপথ। শুনে বলে, “হুম। দেখছি।” আরও খানিকক্ষণ কথা হলো। বললাম, ভিয়েনার বৃষ্টি আর আমার সদ্য ঘটা বিপর্যয়ের কথা। ওপার থেকে সুস্মিতাদির গলা, “ওঁদের বলো, এই ঠান্ডায় খানিক হাঙ্গেরিয়ান গুলাশ (Hungarian goulash) আর রাই ব্রেড (rye bread) খেতে। (ছবি ২.২) ভালো লাগবে”।

গুলাশ আর রাই ব্রেড। অন্যদিকে ভিয়েনার বিখ্যাত স্নিটজেল (Schnitzel), ক্যাফে দিগলাসে (ছবি ২.২)

স্টিভেন্সপ্লাতজের পেছনের গলিতে কোন সরাইখানায় ভালো গুলাশ পাওয়া যায় আলোচনা করতে করতে উঠে এল সেই ক্যাফে দিগ্‌লাসের কথা। যেখানে গতকাল গিয়েছিলুম কফি খেতে।

আরও খানিক এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি করে খানিক বেলা বাড়ল। বৃষ্টিও। ছাতা মাথায় দিয়ে টুকটুক করে হাঁটতে হাঁটতে আরেকবার পৌঁছে গেলাম ক্যাফে দিগ্‌লাস। আজ বাইরে কেউ বসে নেই, ভিতরে বেশ ভিড়, যদিও মোটের উপর ছড়ানো জায়গা। দুটো চেয়ার পাওয়ার জন্য বেশ খানিকক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো। তারপর জায়গা মিলল বটে, তবে চারজনের জায়গা। ওয়েটার ছেলেটি খুবই বিনীতভাবে আমাদের আর আরেক যুগলকে বলল, “তোমাদের দুটো আলাদা টেবিল দিতে পারি, তবে খানিক গায়ে গায়ে। চলবে?” দু'পক্ষই মাথা নাড়লাম। বসে গুলাশ অর্ডার দেওয়া গেল। পাশের দম্পতির বেশ বয়স, পরে কথা বলে বুঝলাম অশীতিপর। ওঁরা দেখলাম কুমড়োর স্যুপ অর্ডার করলেন। এত কাছাকাছি বসেছি, আলাপ হয়েই যায়। কানাডার ক্যালগ্যারি শহরে বাস। নাম বোহদান আর হানা। ওঁদের গল্প আমার সাহিত্যপাঠ আর শিক্ষকতার সঙ্গে কেমন ওতপ্রোত জড়িয়ে গেল, ভাবলে ভারী অবাক লাগে।

বোহদান আর হানা আদতে প্রাগের বাসিন্দা। ১৯৬৮ সালে দেশ ছেড়ে কানাডায় চলে গিয়েছিলেন। সালটা শুনেই আমি আর নন্দিনী এঁকে অপরের দিকে তাকালাম, তারপর দু'জনেই ওঁদের দিকে,

“প্রাগ স্প্রিং?”

“ইয়েস”, হানা মাথা নাড়েন।

“আমাদের তখন চব্বিশ-পঁচিশ বছর বয়েস। আমাদের সন্তানের বয়স তিন বছর। রাশিয়ান আক্রমণে আচমকাই জীবন তছনছ হয়ে গেল! তখন কানাডা আমাদের আপন করে নিয়েছিল, পলিটিকাল রিফিউজি। আশ্রয় দিয়েছিল, ভাষা শিখিয়েছিল, চাকরি দিয়েছিল।”

গুলাশের কথা ভুলে গিয়েছি ততক্ষণে। গোগ্রাসে গিলছি ওঁদের জীবনের গল্প। কানাডার প্রতি ওঁদের অশেষ কৃতজ্ঞতা। বললেন, “খুব ভালো আছি আমরা কানাডায়।” প্রতি বছর নিয়ম করে প্রাগে ফেরেন, তবে আর থেকে যাওয়ার কথা ভাবেন না। সে সময়ের ঘটনাচক্রে আচমকা ছেড়ে যাওয়া দেশকে আর আপন করতে পারেন না। তবু আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে দেখা করতে আসেন, যেমন এসেছেন এইবারেও। গতকাল গাড়ি চালিয়ে ভিয়েনা এসেছেন, বেড়াতে, আবার আগামীকাল ফিরে যাচ্ছেন।

আমি দীর্ঘদিন ক্লাসে কুন্দেরার দ্য আনবেয়ারেবল লাইটনেস অফ বিয়িং পড়াই (ছবি ২.৩)। প্রাগ বসন্তের রাজনৈতিক ভিত্তিতে লেখা উপন্যাস। টমাস, টেরেসা, সাবিনা, ফ্রানজ্‌-এর গল্প। পালিয়ে যাওয়ার গল্প, আবার থেকে যাওয়ার গল্পও বটে। ফিরে আসার গল্প। জটিল বুনন সেই উপন্যাসের। বোহদান আর হানার দিকে তাকিয়ে আমি ওই চরিত্রদের খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করি। ইতিহাসের পাতা যেন কেউ অকস্মাৎ আমার সামনে মেলে ধরেছে। আমার পড়া, আমার পড়ানো মিলিয়ে নিতে বলছে এই সশরীর চরিত্রদের সঙ্গে। আমি জিজ্ঞাসা করি, “কুন্দেরা আর ভাসলাভ হাভেল সম্বন্ধে তোমাদের কী মতামত?” একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন বোহদান, “হাভেল অসাধারণ মানুষ। চেকোস্লোভাকিয়াকে আরেকবার ঘুরে দাঁড়াতে শিখিয়েছিলেন। কোনও হিংসা ছাড়া।” ওঁর চোয়াল আজও শক্ত হয়ে যায় খেয়াল করি,

“আমার হাতে ছেড়ে দিলে সব কমিউনিস্টদের শেষ করে দিতাম। হাভেল তা করেননি। ওঁর দূরদর্শিতায় দেশটা সেদিন বেঁচে গিয়েছিল। আমরা তো পালিয়ে গেলাম”।

থামেন বোহদান। কুমড়োর স্যুপে চুমুক দেন। কপালে ভাঁজ পড়ে। বুঝতে পারি মুহূর্তের জন্য আমরা ওঁদের ওই সময়ে নিয়ে ফেলেছিলাম। বিস্মৃতির চেষ্টা আর বিস্মৃতির মধ্যের ফারাকটুকু ওই খানিক নৈঃশব্দ্যের মধ্যে ধরা থাকে। “আর কুন্দেরা?” নন্দিনী জিজ্ঞেস করে। “সে-ও তো চলে গেল। আমার মনে হয় কুন্দেরার সবচেয়ে সৎ উপন্যাস ইগনোরেন্স। তবে জটিল চরিত্র। ওঁর সম্বন্ধে আমার মতামত আমার কাছেই থাক।”

কুন্দেরার দ্য আনবেয়ারেবল লাইটনেস অফ বিয়িং (ছবি ২.৩)

বোহদান আর হানাকে বিদায় জানিয়ে যখন ফিরছি তখন ঘড়িতে সন্ধ্যা ছ'টা। বৃষ্টি ধরেছে, তবে মেঘলা। আর দিনের আলো ফটফট করছে। অপেরা হাউসের পাশ দিয়ে যাচ্ছি, এক নাটকীয় পোশাকে সজ্জিত সুদর্শন যুবক পথ আটকাল। “বাজনা শুনবে?” টুরিস্ট ট্র্যাপ জেনেশুনেও পা দিয়েই ফেললাম। বেশ খানিক গাঁটের কড়ি খসিয়ে দুটো টিকিট কিনেই ফেললাম। কাছেই প্যালেস এসখেনবাখ্‌। সেখানে ঘণ্টা দেড়েকের কনসার্ট। বিথোভেন, মোৎসার্ট, স্ট্রাউস সব কিছুর একটা মিলমিশ (ছবি ২.৪)। এ বছর স্ট্রাউসের দুশো বছর, তাই তিনি খানিক বেশি। এইসব কনসার্ট নিয়ে ভিয়েনিজ আঁতেলরা নাক কুঁচকোবেন নিশ্চিত। তবে আমাদের সন্ধ্যা মন্দ কাটল না।

এসখেনবাখে কনসার্ট (ছবি ২.৪)

More Articles