মুর্শিদাবাদ: হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে কাঁটাতারের বেড়া আর কি কাটা যাবে না?
Murshidabad Violence: এ তো রাজনীতির খেলা। নয়ত ওয়াকফ আইনের বিরোধিতা করতে গিয়ে কেন পুলিশের গাড়ি জ্বালাতে হবে বা মুসলমানরা কেন হিন্দুদের আক্রমণ করবে তা সাধারণের বোধগম্য হওয়ার কথা নয়।
প্রতি বছর শীত বা গরমকাল এলেই মনে হয় এবারের মতো ঠান্ডা বা গরম আর কোনও বছর পড়েনি। প্রকৃতির খেলা (যার পোশাকি নাম ক্লাইমেট চেঞ্জ) দেখে মনে হয়, এই গরম তো আরও বাড়তে থাকবে বছরের পর বছর। মুর্শিদাবাদের সাম্প্রদায়িক হিংসা দেখে এরকমই কিছু বোধ হচ্ছে। মনে হচ্ছে, ২০২৫ সালের এপ্রিল মাস থেকে পশ্চিমবঙ্গটা একদম বদলে গেল। ২০১৬-১৭ থেকে যে পরিবর্তন চোখে পড়ছিল, তার বৃত্ত যেন সম্পূর্ণ হতে চলেছে। বছরের পর বছর এই বদল আরও বাড়বে!
পশ্চিমবঙ্গ 'দাঙ্গা' দেখেনি এমনটা নয়। স্বাধীনতার আগে থেকে শুরু করে ২০২৫ — বহু ছোট বা বড় সাম্প্রদায়িক হিংসা এই বাংলার মানুষ দেখেছেন। গত এক দশকেও কম সাম্প্রদায়িক হিংসা হয়নি। বসিরহাট থেকে শুরু করে উলুবেড়িয়া হয়ে, আসানসোল, ভাটপাড়া, রিষড়া, কালিয়াচক — হাতে গুনে শেষ করা যাবে না।
তাহলে মুর্শিদাবাদের সাম্প্রদায়িক হিংসা নিয়ে এত কথার কী আছে? বরাবরই আমি বিশ্বাস করে এসেছি যে, বাংলার জনগণ যতই নিজেদের উদারবাদী ভাবুক না কেন, অধিকাংশ মানুষের মনের গভীরে একটি সাম্প্রদায়িক মানসিকতা গাঁথা রয়েছে। তা সে নিজের অভিজ্ঞতা থেকে হোক বা অন্যের কাছে গল্প শুনেই হোক। সেই 'সাঁকো' নাড়ানোর জন্য কিছু ইন্ধন দরকার ছিল। ২০১১ সাল থেকে হিজাব পরা নেত্রীর ছবিই হোক বা ইমামদের দিয়ে রাজনৈতিক সভা আলোকিত করা হোক বা ১০১৭ সাল থেকে রামনবমীর অস্ত্র মিছিলের বাড়বাড়ন্তই হোক সেই 'সাঁকো' নাড়ানো হয়ে গেছে।
তবুও, অনেকে বুক চিতিয়ে 'বাংলার মাটি দুর্জয় ঘাঁটি' ইত্যাদি বলে মনে মনে হিন্দু-মুসলামনের মধ্যে তীব্র বিভাজন ঠেকিয়ে রেখেছিলেন। ২০১৯ সালে লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির অপ্রত্যাশিত ফলাফলের পরেও ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূলের সরকারে প্রত্যবর্তনকেও অনেকে উদারবাদী বাঙালির সাফল্যের চাবিকাঠি হিসেবে দেখেছিলেন। সে সময়ে অনেকে তৃণমূলের ২১৫ আর বিজেপির মাত্র ৭৭ আসনকে কে সাম্প্রদায়িক শক্তির পরাজয় ভেবে উল্লসিত হয়েছিলেন। তাঁরা হয়তো জেনে বুঝেও অস্বীকার করছিলেন যে, এই বাংলা থেকে কংগ্রেস ও বামপন্থীরা সাফ হয়ে গিয়ে বিজেপি প্রধান বিরোধী দলের জায়গা করে নিয়েছে। যার রাজ্যের প্রধান নেতা মুখ্যমন্ত্রীকে 'বেগম' বলেই সম্বোধন করেন। এ রাজ্যের ৩০ শতাংশ মুসলমান জনগণকে নিজেদের ভোট অঙ্কের হিসাবের বাইরে রাখেন।
আরও পড়ুন-ওয়াকফ আইন আসলে কী? কেন ক্ষুব্ধ মুসলিম সমাজ?
অন্যদিকে যাঁরা তৃণমূলকে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির প্রতিভূ বলে মনে করতেন, তাঁরাও বুঝে গেছেন নিশ্চয়ই যে বিজেপি বা বৃহত্তর রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের সঙ্গে আদর্শগত লড়াইয়ের এক ফোঁটা ধক্ও তৃণমূলের নেই। না থাকার কারণ হচ্ছে দলটি 'যখন যেমন তখন তেমন' পদ্ধতিতে চলে। নয়তো যে দল ২০১৭ সালে রামনবমীর আগ্রাসী অস্ত্র মিছিলের বিরোধিতা করে হনুমান জয়ন্তীর ঢল নামায় এবং ২০২৫-এ এসে নিজেরাই রামনবমীর মিছিল বের করে এবং সর্বশেষ সংযোজন হিসেবে ৩০ এপ্রিল সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় জগন্নাথ মন্দিরের উদ্বোধন করতে চলেছে — তারা তো আরএসএস-এর বহমান স্রোতে গা ভাসিয়েছেন। এ নিয়ে কারও মনে কোনও সন্দেহ থাকার কথা নেই।
পাশাপাশি রাস্তার মোড়ে মোড়ে যে হিজাব পরা ছবির পোস্টার দেখা যেত, সেগুলি নেমে গেছে বটে। মঞ্চ থেকে ইমামরাও নেমে গেছেন। কিন্তু সংখ্যালঘু মহল্লায় স্থানীয় নেতাদের হাত খুলে রাখা আছে। নয়তো, সিদ্দিকুল্লাহ চৌধুরীর মতো মন্ত্রী কলকাতার রাস্তায় দাঁড়িয়ে এই উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে নিজেদের ক্ষমতা প্রদর্শনের জন্য ওরকম বক্তৃতা করেও পার পেতেন না। স্থানীয় নেতাদের প্রশ্রয় ছাড়া কার হিম্মত রয়েছে বেপাড়া থেকে গুন্ডারা এসে হিন্দুদের ঘরবাড়ি, দোকান, মন্দির লুঠপাঠ, ভাঙচুর করে দিয়ে চলে যাবে! পুলিশ ও প্রশাসনের হাত পাও বাঁধা থাকে হয়তো। না হলে এই মুর্শিদাবাদ সাম্প্রদায়িক হিংসার প্রত্যক্ষদর্শীরা যেমনটা বলছেন যে, বারবার ফোন করেও এই হিংসার পরিস্থিতিতে স্থানীয় থানার সাহায্য পাওয়া যায়নি, হয় তাঁরা আসেননি, নয়তো তাঁরা বলেছেন যে ওই এলাকায় তাঁরা ঢুকতে পারছেন না। আবার স্থানীয় নেতাদের হাত থেকেও যে উগ্র মনোভাবাপন্ন মুসলমানদের নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা চলে গেছে, তাও প্রকট হয়েছে মুর্শিদাবাদের ঘটনায়।
আসলে শাসক দলের ভাবটা এমন যে, সংখ্যালঘুরা আমাদের ভোট না দিয়ে যাবে কোথায়! আমরাই ওদের রক্ষা করতে পারি। এ কথা তো ঠিক যে বামেরা ও কংগ্রেস এই বাংলা থেকে হাওয়া হয়ে গিয়েছে। যতই নিজেদের কমরেডরা মারা গিয়েছেন বলে পরিবারের কাছে গিয়ে সমবেদনা জানান না কেন, তৃণমূল স্তরে বামেদের এই সাম্প্রদায়িক বিভাজন আটকানোর সামর্থ নেই। 'মুর্শিদাবাদের বাদশা'-ও লোকসভা ভোটে সবক শিখে গেছেন যে মাটি কামড়ে পড়ে থাকলেও, এই মাটির ছেলে হলেও, তাঁর এলাকাতেও এখন সাম্প্রদায়িক লাইনেই ভোট হয়।
এ তো রাজনীতির খেলা। নয়তো ওয়াকফ আইনের বিরোধিতা করতে গিয়ে কেন পুলিশের গাড়ি জ্বালাতে হবে বা মুসলমানরা কেন হিন্দুদের আক্রমণ করবে তা সাধারণের বোধগম্য হওয়ার কথা নয়। তাই সাম্প্রদায়িক হিংসায় ঘরছাড়াদের রিলিফ ক্যাম্পে (এই বাংলায় আমার দেখা এমন প্রথম রিলিফ ক্যাম্প) বসে হিন্দু মহিলারা বলছেন, তাঁরা জানেন না কেন তাঁদের উপর হামলা হলো। আবার একদল মুসলমান বাসিন্দারাও নিজেদের গ্রামে দাঁড়িয়ে বলছেন, তাঁরাও বুঝতে পারছেন না কেন মুখ গামছায় ঢেকে কারা এই হামলা করে চলে গেল।
আরও পড়ুন-ভারতীয় মুসলিমকে ‘পাকিস্তানি’ বলা কি আইনের চোখে অপরাধ?
এ থেকে তৃণমূল ও বিজেপি উভয় পক্ষের ভোটের অঙ্কে লাভ হলেও, দলীয় রাজনীতির বাইরে শঙ্কা অন্য জায়গায়। সেই একই প্রশ্নে ফিরে আসি। মুর্শিদাবাদের সাম্প্রদায়িক হিংসা কেন চিন্তায় ফেলছে যে ২০২৫ সালের এপ্রিল মাস বাংলাকে একদম বদলে দিয়ে গেল।
মুর্শিদাবাদের ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে দেখতে পাচ্ছি যাঁরা এই বাংলায় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কথা বলতেন, যাঁরা স্বপ্ন দেখতেন একটি উদারবাদী সমাজের, যাঁরা হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে ভেদাভেদের বিপক্ষে ছিলেন, তাঁদের মধ্যে এক ধরনের মুসলমান-ভীতি তৈরি হয়েছে। কেউ প্রকাশ্যে বা কেউ ব্যক্তিগত পরিসরে এ কথা বলছেন। যিনি পার্ক সার্কাসে ছোটবেলা কাটিয়েছেন, যাঁরা ১৯৯২ সালের বাবরি-ধ্বংসের পরবর্তী সময়ের দাঙ্গাতেও কলকাতায় বা শহরতলিতে থেকেছেন, যাঁরা সোচ্চারে গুজরাত দাঙ্গার বিরোধিতা করেন, যাঁরা বিজেপি-আরএসএস-এর আদর্শের বিপরীতমুখী — তাঁরাও ভয় পাচ্ছেন।
এমনিতেই মুসলমান মৌলবাদীদের কার্যকলাপ, ছোট যুবক, এমনকী যুবতীদের মাথা খাওয়ার প্রকল্প, ধর্মের নামে জঙ্গি আগ্রাসন আমাদের হিন্দু জনগণের মনে পুরো সম্প্রদায় সম্পর্কেই একটা বিরূপ ধারণা তৈরি করেছে। এছাড়াও 'মুসলমান পাড়া', 'মোল্লা পাড়া' নাম দিয়ে তাঁদেরকে আমরা বরাবরই একটু খাটো চোখেই দেখেছি। পার্ক সার্কাস, রাজাবাজার, খিদিরপুর , মেটিয়াবুরুজের নাম শুনলেই আমাদের চোখে একটা বিশেষ চিত্র ফুটে ওঠে।
এর পরও আমরা ধীরে ধীরে সাধারণ মুসলমানদের এক ঘরে করেছি। আজকাল মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষ ট্রেনে কোনও টিফিন বাক্স বা মুরগির মাংস নিয়ে উঠতেও ভয় পান। বাড়ি ভাড়া চাইতে গেলে অনেককে পরিচয় গোপন করতে হয়। হিন্দু বন্ধুদের কাছে তাঁদের 'ভালো মুসলমান' সাজতে হয়। পাকিস্তানের (হালে বাংলাদেশেরও) সঙ্গে ভারতের ক্রিকেট ম্যাচ হলে সবাই তাঁদের প্রতিক্রিয়ার জন্য বন্ধুরাই অপেক্ষা করে থাকে। মন্দিরের সামনে ফলের পসরা নিয়ে বসার অধিকার তাঁরা হারাচ্ছেন।
আমরা কেউই এই পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য যথেষ্ট যত্ন নিইনি। বরং ওঁদের মহরমে যদি অস্ত্র প্রদর্শন হয়, তাহলে আমাদের রামনবমীতে কেন অস্ত্র প্রদর্শন হবে না — এই যুক্তিতে নেমে গেছি। ওঁরা যদি মিছিল করে কলকাতার রাজপথ স্তব্ধ করতে পারে, তাহলে আমরা কেন জোর করে গাড়িতে গেরুয়া ঝাণ্ডা বেঁধে দিতে পারি না — এই লড়াই শুরু করেছি। একজন মুসলমান সাংসদ না থাকলেও, শুধু সংখ্যার জোরে সেই সম্প্রদায়ের ভালো মন্দ বিচার করে রায়দান করতে রাজনৈতিক দল দ্বিধা করেনি। আমাদের মনে হয়েছে, ওঁদের 'বাড়াবাড়ি' বন্ধ করতে এরকম দাওয়াই ভাল।
সেই 'বাড়াবাড়ি' বন্ধ করতে না মুসলমান সমাজের নেতৃস্থানীয়রা উদ্যোগী হয়েছেন, না সংখ্যাগুরুরা মানবিক ভাবে, স্বাভাবিক বোধ বুদ্ধি দিয়ে এর সমাধান করতে চেয়েছেন। আমরা উপর উপর সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দু'চারটে গল্প বলেই কাজ শেষ হয়ে গেছে বলে ভেবেছি। বছরের পর বছর একে অপরকে জড়িয়ে ধরার থেকে কাঁটাতারের বেড়া তুলতেই আমরা বেশি উদ্যোগী হয়েছি। মুর্শিদাবাদের ঘটনার পরে চারিদিকে তাকিয়ে মনে হচ্ছে সেই কাঁটাতার আর বোধহয় কাটা যাবে না! শুধু ভাবছি, আমার লেখা এই বাক্য মিথ্যা হোক।