বোয়িং ৭৮৭-৮ ড্রিমলাইনরার ভেঙে পড়া বিমানটির অন্দর আসলে কেমন?
Boeing 787-8 Dreamliner : ২০১১ সালে চালু হওয়ার পর থেকে বোয়িং ৭৮৭-৮ ড্রিমলাইনারের কোনো মারাত্মক দুর্ঘটনার রেকর্ড নেই, সেই কারণেই বিমানটির প্রতি নির্ভরতা বেড়েছে।
সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে উড়ানের কিছুক্ষণ পরেই মেঘানীনগরের কাছে ভেঙে পড়ল যাত্রীবাহী বিমান। এই বিমানটি ছিল বোয়িং ৭৮৭-৮ ড্রিমলাইনার। ২৩০ জন যাত্রী এবং ১২ জন ক্রু সদস্যসহ মোট ২৪২ জনকে বহন করছিল বিমানটি। বোয়িং ৭৮৭-৮ ড্রিমলাইনার এর আগে এত বড় দুর্ঘটনার মুখে পড়েনি। এই ঘটনা মডেলটির নিরাপত্তা নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন তুলেছে।
বোয়িং ৭৮৭-৮ ড্রিমলাইনার কী?
বোয়িং ৭৮৭-৮ ড্রিমলাইনার হল একটি মাঝারি আকারের, দুই ইঞ্জিনের, ওয়াইড-বডি জেট বিমান, যা লম্বা দূরত্বের উড়ানের জন্যেই ডিজাইন করা হয়েছে। ২০০৯ সালে প্রথম উড়ান শুরু হয় এই মডেলটির। ২০১১ সালে বাণিজ্যিক পরিষেবায় প্রবেশের পর থেকে এটি যাত্রী স্বাচ্ছন্দ্যের জন্যেই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এই বিমানের প্রায় ৫০ শতাংশ কাঠামো কার্বন ফাইবার-রিইনফোর্সড পলিমার দিয়ে তৈরি, ফলে অ্যালুমিনিয়াম বিমানের তুলনায় হালকা এবং জ্বালানিও সাশ্রয়ী করে। প্রায় ২০ শতাংশ কম জ্বালানি খরচ করে এয়ার ইন্ডিয়ার এই বিশেষ উড়ান। খরচ কমায় বলেই এয়ারলাইন্সগুলির পছন্দ এই বিমান।
এয়ার ইন্ডিয়া, ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ, কাতার এয়ারওয়েজ এবং ইউনাইটেড এয়ারলাইন্সের মতো বড় বড় এয়ারলাইন্স এই মডেল ব্যবহার করে।
বিমানটি যাত্রীদের আরামের জন্য বিশেষভাবে ডিজাইন করা হয়েছে। এতে বড় বড় জানালা রয়েছে, ইলেকট্রনিক ডিমিং রয়েছে যাতে যাত্রীরা আলো নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। এছাড়া, কেবিনের উচ্চতা ৬,০০০ ফুটে রাখা হয়, যা সাধারণ বিমানের তুলনায় কম। আর্দ্রতার মাত্রা ও উন্নত এয়ার পিউরিফায়িং সিস্টেম যাত্রীদের ক্লান্তি কমায়। এই বিমানে আলোর ব্যবস্থা এমনভাবে সেট করা যায় যা প্রাকৃতিক আলোর ধরণ অনুকরণ করে, যা জেট ল্যাগ কমাতে সাহায্য করে।
প্রযুক্তিগত বৈশিষ্ট্য
বোয়িং ৭৮৭-৮ সাধারণত দুই-শ্রেণিতে ২৪২ জন যাত্রী বহন করতে পারে এবং এর যাত্রাক্ষমতা প্রায় ১৩,৫৩০ কিলোমিটার (৭,৩০৫ নটিক্যাল মাইল)। এটি আহমেদাবাদ থেকে লন্ডনের মতো দীর্ঘ পথের জন্য উপযুক্ত। বিমানটিতে জিই এয়ারোস্পেস বা রোলস-রয়েসের ইঞ্জিন ব্যবহৃত হয়। দুর্ঘটনায় জড়িত বিমানটিতে জিই ইঞ্জিন ছিল। এটি উন্নত নেভিগেশন সিস্টেম এবং সিন্থেটিক ভিশন সিস্টেম (এসভিএস) দিয়ে সজ্জিত, যা পাইলটদের কম দৃশ্যমানতার পরিস্থিতিতেও সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তা করে।
২০১১ সালে চালু হওয়ার পর থেকে বোয়িং ৭৮৭-৮ ড্রিমলাইনারের কোনো মারাত্মক দুর্ঘটনার রেকর্ড নেই, সেই কারণেই বিমানটির প্রতি নির্ভরতা বেড়েছে। তবে, এই মডেলটি অতীতে কিছু প্রযুক্তিগত সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে, যেমন ২০১৩ সালে লিথিয়াম ব্যাটারি অতিরিক্ত গরম হওয়ার ঘটনা সামনে আসে। ২০২১-২০২৩ সালে উৎপাদন মানের সমস্যার কারণে ডেলিভারি স্থগিত রাখা হয়। সম্প্রতি, ২০২৪ সালে বোয়িংয়ের প্রকৌশলী স্যাম সালেহপুরের অভিযোগে উৎপাদন প্রক্রিয়ায় শর্টকাট পদ্ধতি অবলম্বন করা হচ্ছে। এই দুর্ঘটনার তদন্তে এই বিষয়গুলো পরীক্ষা করা হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
এআই-১৭১-এর পাইলটরা উড়ানের পরপরই একটি মে-ডে কল জারি করেছিলেন, কিন্তু এরপর এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ফ্লাইটরাডার২৪-এর তথ্য অনুযায়ী, বিমানটি সর্বোচ্চ ৬২৫ ফুট উচ্চতায় পৌঁছেছিল এবং তারপর প্রতি মিনিটে ৪৭৫ ফুট হারে নিচে নামতে শুরু করে। বিমানটি একটি মেডিকেল কলেজের হোস্টেলে আছড়ে পড়ে, যার ফলে বেশ কয়েকজন মেডিকেল ছাত্রের মৃত্যু হয়। প্রাথমিক প্রতিবেদনে কমপক্ষে ৩০ থেকে ১৭০ জনের মৃত্যুর কথা বলা হলেও, শেষ পাওয়া খবরে মাত্র একজন বিমানযাত্রীই জীবিত থাকতে পারেন। বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন একাধিক পাখির ধাক্কায় ইঞ্জিন বিকল হতে পারে বিমানদুটির।
ভারতের ডিরেক্টরেট জেনারেল অফ সিভিল এভিয়েশন (ডিজিসিএ), বোয়িং এবং এয়ার ইন্ডিয়ার কর্মকর্তারা এই দুর্ঘটনার তদন্ত শুরু করেছেন। ফ্লাইট ডেটা রেকর্ডার এবং ককপিট ভয়েস রেকর্ডারের তথ্য বিশ্লেষণ করা হবে। বোয়িং একটি বিবৃতিতে বলেছে, "আমরা এয়ার ইন্ডিয়ার সঙ্গে যোগাযোগে আছি এবং তাদের সহায়তা করতে প্রস্তুত।" প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ এবং অন্যান্য নেতারা ত্রাণ ও উদ্ধার কাজে সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এয়ার ইন্ডিয়া একটি হটলাইন নম্বর (১৮০০ ৫৬৯১ ৪৪৪) চালু করেছে যাত্রীদের পরিবারের জন্য তথ্য প্রদানের জন্য।