কাশ্মীরে নিরস্ত্র পর্যটকদের উপর মর্মান্তিক হামলার নেপথ্যে TRF! কারা এই গোষ্ঠী?
Pahalgam Terrorist attack TRF: টিআরএফ সোশ্যাল মিডিয়ায় মগজধোলাইয়ের কাজটি করে। ভারতের বিরুদ্ধে গিয়ে এমন সন্ত্রাসবাদী দলে যোগ দেওয়ার জন্য মানুষদের উস্কানি দেয় টিআরএফ, জানিয়েছিল মন্ত্রক।
সাম্প্রতিককালে এত ঘৃণ্য হামলা ভারত দেখেনি। ৩৭০ ধারা বিলোপ, কাশ্মীরকে নতুন পরিচয় দেওয়া, বিধিনিষেধ শিথিল করার পরে, সাধারণ ভারতবাসী ভেবেছিল ভূস্বর্গ নিরাপদ। জীবনের অমূল্য সঞ্চয় বিনিয়োগ করে বিশ্বের অন্যরতম শ্রেষ্ঠ সুন্দর এই অঞ্চলে ঘুরতে যেতে চেয়েছিলেন তাঁরা। মূল্য দিলেন জীবন দিয়ে। বেছে বেছে, গুলি করে হত্যা করা হলো নিরস্ত্র পর্যটকদের। মঙ্গলবার দক্ষিণ কাশ্মীরের পহেলগাঁওয়ের বৈসরনের তৃণভূমিতে পর্যটকদের উপর সন্ত্রাসবাদী হামলায় কমপক্ষে ২৬ জন নিহত হয়েছেন। অভিযোগ উঠেছে, হত্যার আগে প্রতি পুরুষের ধর্মীয় পরিচয় যাচাই করেছিল জঙ্গিরা। আর এই হামলার দায় স্বীকার করেছে দ্য রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট (টিআরএফ)। নিষিদ্ধ পাক সন্ত্রাসবাদী সংগঠন লস্কর-ই-তৈবার (এলইটি) একটি শাখা গোষ্ঠী এই টিআরএফ।
২০২৩ সালের জানুয়ারি মাসে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক টিআরএফ-কে বেআইনি কার্যকলাপ (প্রতিরোধ) আইনের অধীনে সন্ত্রাসী কার্যকলাপ, সন্ত্রাসীদের নিয়োগ, সন্ত্রাসীদের অনুপ্রবেশ এবং পাকিস্তান থেকে জম্মু ও কাশ্মীরে অস্ত্র আর মাদক পাচারের প্রচারের অভিযোগে 'সন্ত্রাসবাদী সংগঠন' হিসেবে ঘোষণা করে। তখন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের জারি করা একটি বিজ্ঞপ্তি থেকে জানা যায়, ২০১৯ সালে এলইটির একটি ছায়া সংগঠন হিসাবে অস্তিত্ব প্রকাশ করে দ্য রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক জানিয়েছিল, দ্য রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের উদ্দেশ্যে অনলাইনে যুবকদের নিয়োগ করছে। সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের প্রচার, সন্ত্রাসবাদীদের নিয়োগ, সন্ত্রাসবাদীদের অনুপ্রবেশ এবং পাকিস্তান থেকে জম্মু কাশ্মীরে অস্ত্র ও মাদকদ্রব্য পাচারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত রয়েছে দ্য রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট। টিআরএফ সোশ্যাল মিডিয়ায় মগজধোলাইয়ের কাজটি করে। ভারতের বিরুদ্ধে গিয়ে এমন সন্ত্রাসবাদী দলে যোগ দেওয়ার জন্য মানুষদের উস্কানি দেয় টিআরএফ, জানিয়েছিল মন্ত্রক।
কেন টিআরএফ-এর জন্ম?
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের মতে, পাকিস্তান কর্তৃক এলইটি-কে দেওয়া এক নতুন নাম ছিল টিআরএফ। লস্কর এবং জইশ-ই-মহম্মদের সঙ্গে একটা ধর্মীয় অর্থ জড়িয়েছিল। পাকিস্তান তা চায়নি। কাশ্মীরের এই জঙ্গিবাদকে স্বতন্ত্র হিসাবে দেখাতে চেয়েছিল এই পাক সন্ত্রাসী গোষ্ঠী তাই, 'প্রতিরোধ' শব্দটিকেই বেছে নেয় তাঁরা। রেজিস্ট্যান্স বা প্রতিরোধ শব্দটির এক অন্য অভিঘাত রয়েছে সার বিশ্বেই। মন্ত্রকের বিজ্ঞপ্তি থেকে আরও জানা যাচ্ছে, টিআরএফ কমান্ডার শেখ সাজ্জাদ গুলকে ইউএপিএর চতুর্থ তফশিলের অধীনে সন্ত্রাসবাদী হিসাবে মনোনীত করা হয়েছে। সাউথ এশিয়া টেরোরিজম পোর্টাল বলছে, টিআরএফ-এর নেতৃত্বে ছিলেন সাজিদ জাট, সাজ্জাদ গুল এবং সেলিম রেহমানি – সবাই এলইটি-র সঙ্গে যুক্ত। টেলিগ্রাম, হোয়াটসঅ্যাপ, টুইটার, ফেসবুক, ট্যামটাম, চিরপওয়ারের মতো সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলির মাধ্যমে এরা মৌলবাদ প্রচার করে এবং কমবয়সি যুবকদের নিয়োগও করে।
টিআরএফ-এর বিরুদ্ধে ভারতের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বের ক্ষতি করার উদ্দেশ্যে জম্মু কাশ্মীরের নিরাপত্তা কর্মী ও সাধারণ নাগরিকদের হত্যার পরিকল্পনা, নিষিদ্ধ সন্ত্রাসবাদী সংগঠনকে সমর্থন করার জন্য অস্ত্রের জোগান দেওয়ার অভিযোগে প্রচুর মামলা আছে। উল্লেখ্য, কাশ্মীর উপত্যকার কয়েকটি গণমাধ্যমকে 'বিশ্বাসঘাতক' বলে দাগিয়ে দিয়ে হুমকি জারি করেছিল টিআরএফ। এই ঘটনার পরে বেশ কয়েকজন সাংবাদিক চাকরি ছেড়ে দিতে বাধ্য হন।
'প্রতিরোধ' শব্দটির ব্যবহার
টিআরএফ অনলাইনে সক্রিয় হয়ে ওঠে ৩৭০ ধারা বাতিল হওয়ার পরেই। অনলাইনে ক্রমেই প্রচার বাড়াতে বাড়াতে প্রায় ছয় মাস পরে, টিআরএফ লস্কর ছাড়াও তেহরিক-ই-মিলাৎ ইসলামিয়া, ঘজনবি হিন্দ সহ বিভিন্ন সংগঠনের সংমিশ্রণ হিসাবে সরাসরি কাজ শুরু করে। কেন নিজেদের এমন নবরূপে প্রকাশ করতে হলো লস্করদের? ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকশন টাস্ক ফোর্সের (এফএটিএফ) ধরপাকড় ও পরীক্ষা থেকে বাঁচতে এমন এক আড়াল দরকার ছিল যাতে বোঝা যায় এই নামের সঙ্গে ইসলামিক ধর্মীয় উগ্রবাদের সম্পর্ক নেই। এ আসলে জনগণের আন্দোলন। অন্যান্য আরও ছায়া সংগঠনকে এভাবেই মাঠে নামানো হলেও সবচেয়ে সক্রিয় ছিল টিআরএফ। ভারতীয় নিরাপত্তাকর্মীদের মতে, ২০১৯ পরবর্তী কাশ্মীরে, নিরপেক্ষ চেহারার আড়ালে থেকে কাজ করতেই 'প্রতিরোধ' শব্দটিকে সামনে আনা হয় যাতে ইসলামিক নাম থেকে দূরত্ব বজায় রাখা যায়।
২০২০ সালে ঘটা বিভিন্ন হামলার দায় নিতে শুরু করে টিআরএফ৷ উপত্যকায় বিভিন্ন আক্রমণ চলেছে। আগে এই ধরনের হামলা হলেই দায় স্বীকার করতে দেখা যেত লস্কর-ই-তৈবা, জইশ-ই-মহম্মদ এবং হিজবুল মুজাহিদিনের মতো জঙ্গিগোষ্ঠীদের৷ এখন অন্যরা হামলা চালালেও সমস্ত হামলার দায় শুধুমাত্র টিআরএফ-ই স্বীকার করে। টিআরএফ যে ক্রমেই শক্তিশালী হচ্ছে তা প্রথম টের পাওয়া যায় যখন জম্মু ও কাশ্মীরের পুলিশ সোপোরে এবং কুপওয়ারার কাছে ওভার গ্রাউন্ড ওয়ার্কারদের (OGWs) একটি ছক ফাঁস করে দেয়। আগে এই শহর ছিল লস্কর-ই-তৈবার ঘাঁটি। তারপর হিজবুল মুজাহিদিন এবং জইশ-ই-মহম্মদ এখানে দাপট বাড়ায়৷ পুলিশ কেরানে নিয়ন্ত্রণ রেখার (এলওসি) কাছে জঙ্গিদের ফেলে দেওয়া অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার করে। গ্রেফতার হওয়া ওভার গ্রাউন্ড ওয়ার্কাররা জানায়, টিআরএফ-এর জন্য যুবকদের নিয়োগ করছিল তাঁরা। তখন পুলিশ জানিয়েছিল, ২০২২ সালে উপত্যকায় সর্বাধিক সংখ্যক জঙ্গি নিহত হয়েছে টিআরএফ-এর।
২০২৩ সালের মার্চ মাসে, রাজ্যসভায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক জানায়, সেই বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চতুর্থ তফশিল এবং ইউএপিএর প্রথম তফশিলের অধীনে ৫৪ জন সন্ত্রাসবাদী এবং ৪৪টি সন্ত্রাসবাদী সংগঠনকে নিষিদ্ধ করেছে মন্ত্রক। টিআরএফ-সহ চারটি সংগঠনকে সেই বছর ইউএপিএ-র অধীনে সন্ত্রাসবাদী সংগঠন হিসাবে তুলে ধরা হয়।