সব কিছুর জন্য নিজেকেই দায়ী করেন? কেন বেড়ে ওঠে 'ভিকটিম' মানসিকতা?
Victim mentality: এই মানসিকতার জন্য সারাক্ষণই নিজের সমালোচনা করে চলেন একজন। মনে করেন, জীবনে কখনও ভালো কোনও জিনিসের যোগ্যই তিনি নন। ভালো কিছু ঘটলে তাতে খুশিও হন না সেই মানুষ।
বন্ধুত্ব ভেঙে যাচ্ছে? অফিসে কাজ করা কঠিন হয়ে উঠছে? সম্পর্কে আর আকর্ষণ বেঁচে নেই? সবার সঙ্গে কথা কাটাকাটি হয়ে যাচ্ছে? ছুটি কাটাবেন ভেবে লাখো পরিকল্পনা করলেন, মনমতো হলো না? রেস্তোরাঁ বেছে গেলেন কিন্তু খাবারের মান পছন্দ হলো না? অনেক ভেবেচিন্তে উপহার কিনলেন কিন্তু তেমন খুশি হলো না প্রিয়জন? জীবনের নানা ক্ষেত্রে নানা সমস্যায় আমাদের প্রধানতম অস্ত্র হয়ে ওঠে দোষারোপ। সবসময়ই সাধারণত অন্য কাউকেই দোষারোপ করে গায়ের ঝাল মেটাই আমরা। কখনও খিটখিটে বস, কখনও দূরত্ব বাড়িয়ে চলা বন্ধু, কখনও বাবা-মা, প্রিয়জন। আরও একজন, অনেকে শুধু সেই মানুষটিকেই আক্রমণ করেন— নিজেকে। যে কোনও ঘটনার জন্য নিজেকে দায়ী করা, নিজেকে দোষী ঠাওরানো এক ভয়াবহ সমস্যা। যে কোনও চ্যুতিতেই মনে হয়, "কেন আমার সঙ্গেই এমনটা হয়?", "আমি জানতাম যা ভাবব তা কখনই হবে না,” "আমারই দোষ"— বলতে থাকা মানুষটি এভাবে ক্রমেই একা হয়ে যায়।
কিছুটা অভিযোগ এবং দোষারোপ করা স্বাভাবিক হলেও, জীবনের নেতিবাচক বিষয়গুলির জন্য সবসময়ই অন্যদের দোষারোপ করার ধারাবাহিক অভ্যাস থাকলে তা ক্রমেই ভিকটিম মানসিকতার আকার নেয়। ভিকটিম মানসিকতার মানুষরা সাধারণত শক্তিহীন হন, বা নানা সময়ে হয়তো তাঁদের সঙ্গে নানা অন্যায় আচরণ করা হয়েছে। বহুকালের সেই আচরণ একসময় ভিকটিম কার্ড খেলার দিকে নিয়ে গেছে এই মানুষদের।
আরও পড়ুন-বাড়িতে বিড়াল আছে? গবেষণা বলছে, এই ভয়াবহ মানসিক রোগের শিকার হতে পারেন আপনি…
ভিকটিম মানসিকতা থাকলেই সেই মানুষটি 'খারাপ' হয়ে যাচ্ছেন এমন নয়, তবে তা তাঁর নিজের জীবনের সমূহ ক্ষতি করতে পারে। মানুষকে নিজের মধ্যেই আটকে রাখে, মানসিক বৃদ্ধিতে বাধা দেয় এবং হতাশায় ঠেলে দেয় এমন মানসিকতা। আর এর সবচেয়ে খারাপ দিক হচ্ছে, নিজের চেয়ে অন্য কারও মধ্যে ভিকটিম মানসিকতা চিহ্নিত করা অনেক সহজ। নিজের মধ্যে সেই সমস্যা বাড়ছে কিনা তা আমরা টেরই পাই না।
আসলে ভিকটিম মানসিকতা মানুষের নিজের সবচেয়ে খারাপ শত্রু। নিজের মানসিক সুস্থতা, ব্যক্তিগত জীবন এবং এমনকী পেশাজগতেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ে এর জন্য। এই মানসিকতার জন্য সারাক্ষণই নিজের সমালোচনা করে চলেন একজন। মনে করেন, জীবনে কখনও ভালো কোনও জিনিসের যোগ্যই তিনি নন। ভালো কিছু ঘটলে তাতে খুশিও হন না সেই মানুষ। সমস্যা তখন আর কেবল সবকিছুর জন্য অন্যদের দোষারোপ করায়, বা নিজেকে দায়ী করায় আটকে থাকে না। ক্রমাগত বাড়তে থাকা চাপের মুখে একসময় সেই ভুক্তভোগী মানুষটি অসহায় হতে থাকেন, প্রতিটি চ্যালেঞ্জকে অসম্ভব বলে মনে করেন এবং উদ্বেগে বাঁচেন। এই সমস্যা ক্রমে পারস্পরিক বিশ্বাস এবং সম্পর্কেরও ক্ষতি করে। বন্ধুবান্ধব এবং পরিবার অবিরাম অভিযোগে ক্লান্ত হতে পারে, যার ফলে দূরত্ব বাড়তে পারে।
এই মানসিকতা কোনও গঠনমূলক সমালোচনায় বাধা দেয়। ফলে ভুক্তভোগী সেই মানুষ নিজের ত্রুটিগুলির প্রকৃত সমাধান করতে পারেন না। বাড়িতে সামান্য কোনও কারণে যখন কেউ তাঁর গাফিলতি চিহ্নিত করেন, তখন এই ভুক্তভোগী মানুষ তাদের উপর হয় চিৎকার করেন বা নিজের ব্যক্তিগত জীবনের নানা লড়াইয়ের কথাই তুলে ধরেন। যাদের এমন ভিকটিম মানসিকতা থাকে, প্রাপ্তবয়স্ক হলেও জীবনের পূর্ণ দায়িত্ব নিতে তাঁদের অসুবিধা হয়। নিজেদের স্বাচ্ছন্দ্যের পরিসর বা কমফোর্ট জোন থেকে বেরিয়ে এসে কিছু করতে তাঁদের প্রচণ্ড সমস্যা হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অন্যদের দোষারোপ করলেও, একজন অভ্যন্তরীণ সমালোচকের সঙ্গেও ক্রমাগত লড়াই করে যেতে হয় তাঁদের, যা আবার তাঁদের আত্মমর্যাদা নষ্ট করে। শুধু তাই না, ভিকটিম মানসিকতার মানুষ ছোট ছোট ভুলের জন্যও কারও বিরুদ্ধে প্রবল কঠোর হয়ে যান, অন্যদের বিশ্বাস করাই তাঁর কাছে কঠিন হয়ে যায়।
আরও পড়ুন-অন্য ধর্মের প্রতি ঘৃণা আসলে মানসিক অসুখ, কীভাবে দানা বাঁধে এই রোগ?
মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মন স্বাভাবিকভাবেই এমন প্রমাণ খোঁজে যা আমরা ইতিমধ্যেই যা বিশ্বাস করি এমনকিছুকেই নিশ্চিত করে। তাই তাঁকে অপমান করা না হলেও ভিকটিম মানসিকতার ব্যক্তিরা সামান্য কিছুকেও সহজেই অপমান হিসেবে মেনে নেন। তাঁদের কাছে সাফল্য ছোট মনে হয় এবং হতাশাকেই বড় বলে মনে হয়। দোষারোপ করা ভিকটিম মানসিকতার আরেকটি শক্তিশালী দিক। আপনি যা ভুল করেছেন তার প্রতিটির জন্য আপনার কাছে সম্ভবত একটি যুক্তি প্রস্তুত রয়েছে, তা সময়মতো কর্মক্ষেত্রে পৌঁছতে না পারা হোক, বা প্রিয় বন্ধুর দুর্বল মুহূর্তে পাশে না থাকা হোক। নিজের ভুল আচরণকে ন্যায্য প্রমাণের জন্য সবসময়ই তাঁদের যুক্তি প্রস্তুত থাকে।
আসলে ভিকটিম মানসিকতার ব্যক্তিরা পুরনো আঘাত মনে ধরে রাখেন এবং সেই ভিত্তিতেই বর্তমান সিদ্ধান্ত নেন, যেমন কাউকে বিশ্বাস না করা কারণ কোনও এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু একবার তাঁর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল, অথবা স্বপ্নের পিছনে না ছোটা কারণ ইতিমধ্যেই তিনি একবার ব্যর্থ হয়েছেন। এই মানসিকতা ভুক্তভোগী ব্যক্তিকে জীবনকে আটকে দেয়।
মুশকিল হলো, যখন কেউ সাহায্য করার চেষ্টা করেন বা সমাধানের উপায় প্রস্তাব করেন, তখনও এই ব্যক্তিরা তা গ্রহণ করেন না। কারণ তাঁরা মনে করে, তাঁর সমস্যা কোনও কিছুই ঠিক করতে পারবে না। এবং তিনি নিজে ছাড়া তাঁর পরিস্থিতি আর কেউই বুঝবে না। অনেকে মনে করেন, পরিস্থিতি থেকে পালানো বা দোষ এড়ানোর জন্যই এই ব্যক্তিরা এমন করেন। কিন্তু আসলে ভিকটিম মানসিকতা অনেকের কাছেই বেঁচে থাকার এক কৌশল।