কোন আচরণ সঠিক কোনটা ভুল ঠিক করে দেবে কে?
Rights of LGBTQ: নারীর 'পুরুষালি' আচরণ এবং কোনও পুরুষের 'মেয়েলি' স্বভাব তো আজকের নয়। সভ্যতার আদিকাল থেকেই রয়েছে। তাহলে তা বৃহত্তর সমাজ আজও মেনে নিতে পারল না কেন?
কোনটা সঠিক আচরণ আর কোনটা ভুল— তা ঠিক করে দেয় কে? সামাজিক যুক্তিবোধ। কিন্তু সামাজিক যুক্তিবোধ সব সময় সঠিক পথের হদিশ দেয় কি? সামাজিক যুক্তির বোধকে অনেক অংশেই নিয়ন্ত্রণ করে সমাজ নিজে। বলা বাহুল্য, সমাজ কোনও একক ব্যক্তি নয়, একটি বহুল ধারণার সমষ্টিমাত্র। আর, ‘ধারণা’ শব্দটিকে নিয়েই যত অসুবিধা।
কারণ, বোধ ও ধারণার বাইরের নতুন কোনও জিনিসকে গ্রহণ করতে সমাজ দ্বিধাগ্রস্থ হয়। আরও গভীরে গেলে বোঝা যায়, অনেক ক্ষেত্রেই দ্বিধার বদলে যা কিছু নতুন তাকে বুঝতেই চায় না সমাজ। কিন্তু নারীর 'পুরুষালি' আচরণ এবং কোনও পুরুষের 'মেয়েলি' স্বভাব তো আজকের নয়। সভ্যতার আদিকাল থেকেই রয়েছে। তাহলে তা বৃহত্তর সমাজ আজও মেনে নিতে পারল না কেন?
আরও পড়ুন-
পরিবার-সমাজ উপেক্ষা করে বিয়ে, যে উদাহরণ তৈরি করল কলকাতার এই সমপ্রেমী যুগল
মেয়েলি ও পুরুষালি কথাটি ধারণ করে আছে নারী ও পুরুষের নিজস্ব পরিচয়চিহ্নকে। ‘মেয়েলি’ মানে মেয়ের মতন। আবার, পুরুষালি কথাটি আসছে পুরুষের দেহভঙ্গিমা থেকে। এখানে দুটি বিষয় আগে স্পষ্ট করে নেওয়া প্রয়োজন। এক, মনের যৌনপরিচয় আর শারিরীক লিঙ্গ পরিচয় এক জিনিস নয়। মনের যৌনইচ্ছা অনেকের ক্ষেত্রেই পরিবর্তনশীল। কেউ শরীরীভাবে ‘মেয়ে’ বলে মানসিকভাবেও তাকে মেয়ে হতেই হবে, এমন কোনও কথা নেই। এমনকী, ভিন্ন যৌনতার মধ্যেও পালটে-পালটে যেতে পারে যৌনইচ্ছা। বিষয়টা স্পষ্ট করে বললে এমন বলা যায়, একজন পুরুষালি নারীর একজন কোমল ধরনের মেয়েকে ভালো লাগছে, একইসঙ্গে কালকে থেকে তাঁর নিজের মতো কোনও পুরুষালি মেয়েকেও কিংবা একটি ছেলেকেও ভালো লাগতে পারে। এর মধ্যে কোনও অন্যায় তো নেই-ই বরং এটা তাঁর স্বাধীনতা। মাথায় রাখা উচিত, মনের যৌন ইচ্ছাই ব্যক্তির অন্যতম লিঙ্গপরিচয়। এ-বিষয়ে কথা বলার কোনও অধিকার নেই সমাজের।

ভিন্ন যৌনতার উদযাপন
আমার দ্বিতীয় বক্তব্যটি হল, সমাজে যাঁরা প্রান্তিক, রাস্তায় যাঁদের ‘মেয়েলি’ বা ‘পুরুষালি’ বলে রসিকতা সহ্য করতে হয়, তাঁদেরকে কিন্তু অনেক সময়েই এক অদ্ভুত ধরনের হেটেরোসেক্স্যুয়াল সাইকোলজির সামনে দাঁড়াতে হয়। একজন ভিন্ন স্রোতের ব্যক্তিকে ‘মেয়েলি’ বলে ঠাট্টা-তামাশা করে নারী-পুরুষ উভয়েই। অনেক মনোবিদের মতে, মূল স্রোতের পুরুষদের সাইকোলজিতে নারীসুলভ ব্যক্তিদের প্রতি এমন একটি মনোভাব কাজ করে যে, তাঁদের তথাকথিত ‘মেয়েলি’ আচরণ পৌরুষের গরিমাকে লঘু করে দিচ্ছে। তাই, প্রান্তিক মানুষগুলির সঙ্গে ঠাট্টা তামাশার করার সময় একটা আক্রমণের মনোভাব পুরুষদের মধ্যে মিশে থাকে। আবার মেয়েরাও তাঁদের যৌনতার ভূমিতে এক ভিন্ন লিঙ্গের মানুষ প্রবেশ করছে দেখে বিরক্ত হয় এবং একইভাবে আক্রমণ করে।
এখানে প্রাসঙ্গিক, ‘সংবাদ প্রতিদিন’-এর 'রোববার' পত্রিকায় ঋতুপর্ণ ঘোষ একটি লেখায় বলেছিলেন:
‘নারী ও পুরুষের মধ্যে রয়েছে এক অসীম প্রান্তর। সেখানে বাস করে অর্ধনারীশ্বরতার নানান প্রতিভু।’
ঋতুপর্ণ ঘোষ একজন সফল ও বিখ্যাত পরিচালক ছিলেন। তা সত্ত্বেও আজীবন তাঁকে নিজের নারীসুলভ আচরণের জন্য বহু কটাক্ষের শিকার হতে হয়েছে। বিস্মিত হই, মৃত্যুর পর এখনও সেই কটাক্ষের বান তাঁর প্রতি সমানে বর্ষিত হয়। যাঁরা এখনও তাঁর সম্পর্কে কুরুচিকর মন্তব্য করেন তাঁদের মূল সমস্যা ঋতুপর্ণ-র ‘মেয়েলি’ আচরণ। বিনীতভাবে বলতে চাই, নারীসুলভ আচরণ কিংবা পুরুষসুলভ আচরণ একজন ব্যক্তির নিজস্ব অধিকার। আমরা কেউ নই এ-বিষয়ে কথা বলার!

LGBTQ-র রেনবো পতাকা
কিন্তু এ-বিষয়ে কথা আমরা বলি। বলে চলি। কথা নয়, ঠাট্টা-বিদ্রুপ-তামাশা। শুধু কি তাই? না। ব্যক্তিগতভাবে পরিচিত একজন ভিন্ন যৌনতার মানুষ আমাকে বলেছিলেন তাঁর জীবন-অভিজ্ঞতার কথা। সে থাকে একটি গ্রামে। বিকেল-সন্ধের পর, তাঁকে গ্রামের কয়েকটি ছেলে মিলে অনেক বার মাঠের মধ্যে তুলে নিয়ে গেছে। সেখানে তার অপর চলেছে শারীরিক অত্যাচার। কিছুই করতে পারেনি সে। 'সমাজ' নামক বিষয়টির আতঙ্ক ও পরিহাস হল, সেই ভিন্ন যৌনতার মানুষটি পরদিন সকালে যখন কাজে বেরয়, রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকে তাঁকে মাঠে তুলে নিয়ে যাওয়া ছেলেগুলি। এবং ভিন্ন যৌনতার মানুষটির ‘মেয়েলি’ আচরণ নিয়ে তাঁরা তখন হাসাহাসি করে। এই সামাজিক অত্যাচারের কোনও প্রতিকার করতে পারেন না সেই প্রান্তিক মানুষটি।
আরও পড়ুন-
নয়ের দশকের স্মৃতি ও একটি সমকামী ভালবাসার পরিণতি
সমস্যা হল, পরিবার থেকেই আক্রমণের ধারাটি জন্ম নেয়। নিজের মা-বাবাও অনেক সময় ভিন্ন যৌনতার মানুষদের আচরণকে বুঝতে তো পারে না এবং তাঁদের ওপর অত্যাচার চালান। ভাববার মতো বিষয় হল, আমাদের দেশে এই অত্যাচারের তেমন কোনও আইনি প্রতিকার নেই। একজন মেয়েকে যদি রাস্তায় কেউ অপমান করে সে পুলিশের কাছে যেতে পারে, কিন্তু একজন নারীসুলভ পুরুষ সেই একই অপমানের অভিযোগ নিয়ে গেলে অনেক সময়েই পুলিশ স্টেশনে তাঁকেই হেনস্থা হতে হয়। ২০১৭ সালের একটি সমীক্ষা অনুযায়ী, ভারতের পুলিশ স্টেশনগুলিতে প্রান্তিক যৌনতার মানুষদের হেনস্থার হার ৯০ শতাংশেরও বেশি। কারণ, পুলিশ কর্মীদের মধ্যেও যৌনতার ধারণাগুলি একেবারেই স্বচ্ছ নয়।
ফলে, বেশির ভাগ ভিন্ন যৌনতার মানুষদের কাছে এই সমাজ নামক বস্তুটি আসলে এক বিস্তৃত কারাগারের সমার্থক। কিন্তু আমাদের মনে রাখা উচিত, ‘সামাজিক বোধ’ কথাটির মধ্যে 'সমাজ' যেমন আছে, তেমনই আছে ‘বোধ’ শব্দটিও। প্রত্যেক ব্যক্তির শরীরী আচরণ সেই ব্যক্তির মনেরই প্রতিফলন-দৃশ্য। আমাদের এ-বিষয়ে কথা বলার কোনও অধিকারই নেই। কখনো থাকবেও না। এই তথ্যটুকু সামাজিক বোধের মধ্যে ধরা দেবে যেদিন, সেদিন হয়তো প্রান্তিক মানুষগুলির বেঁচে থাকার খোলা আকাশকে আমরাও দেখতে সক্ষম হব।