কেন শমীকের হাতে গুরুদায়িত্ব অর্পণ করল বিজেপি?
WB BJP: যখন তৃণমূল থেকে আগত শুভেন্দু অধিকারীকেও কট্টর হিন্দুত্বের লাইন ধরতে দেখা গেছে, শমীকের বক্তব্যে উঠে এসেছে সংখ্যালঘুদের উন্নয়নের কথা। তাঁর কথায়, দল যত কট্টরপন্থী অবস্থান নেবে সংখ্যালঘুরা ততই একজোট হয়ে তৃনমূলকে ভোট...
বঙ্গ বিজেপির নতুন রাজ্য সভাপতি হয়েছেন শমীক ভট্টাচার্য। সাংগঠনিক দায়িত্ব সামলাতে কেন বিজেপির পছন্দের পাত্র শমীক? তাঁর কোন বৈশিষ্ট্য নজর কেড়েছে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, বিজেপির রাজ্য সভাপতি পদে আসীন হয়েছেন সাধারণত সংঘ পরিবারের ঘনিষ্ঠরাই। সেই ক্রাইটেরিয়া শমীক ভট্টাচার্যের সঙ্গে মিলে যায়। রাজনীতিতে আসার আগে ১৯৭৪ সাল থেকেই হাওড়ার মন্দিরতলা এলাকায় আরএসএস-এর শাখায় যাতায়াত শমীকের। পরে রাজনীতিতে যোগদান।
২০০২ সালে তথাগত রায় বিজেপি রাজ্য সভাপতি হন। সেই সময় থেকেই বঙ্গ বিজেপিতে উত্থান শমীকের। তখনই রাজ্যের সাধারণ সম্পাদক হন তিনি। রাহুল সিনহা সভাপতি হওয়ার পরেও ওই পদে আসীন ছিলেন শমীক ভট্টাচার্য। ২০০৬ সালে প্রথম বিজেপির টিকিটে শ্যামপুকুর বিধানসভা কেন্দ্র থেকে ভোটে লড়েন, কিন্তু হেরে যান। এরপর দিলীপ ঘোষ রাজ্য সভাপতি হলে দলের প্রধান মুখপাত্র হন শমীক ভট্টাচার্য। সেই সময়েই বাংলায় বিজেপির উত্থানের শুরু। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে দিলীপের নেতৃত্বে ১৮টি আসন জিতে হেডলাইনে ছেয়ে যায় গেরুয়া শিবির। ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনে যদিও আশানুরূপ ফল করতে পারেনি তারা। এরপর ২০২৪-এর নির্বাচনে কট্টর হিন্দুত্বের লাইন ধরে সারা দেশের পাশাপাশি ভরাডুবি হয় বাংলাতেও। ৬ আসন কমে গিয়ে, পশ্চিমবঙ্গের ১২টি সংসদ এলাকায় জয়লাভ করে বিজেপি।
অনেকের মতে দলে একসময় কোণঠাসা করা হয়েছিল শমীককে। কিন্তু বরাবরই নিষ্ঠার সঙ্গে নিজের দায়িত্ব পালন করে গেছেন তিনি। তার পুরস্কারও পেয়েছেন। গত বছরই বিজেপি শমীককে রাজ্যসভার সাংসদ করেছে। আর বছর ঘুরতেই, বিধানসভা নির্বাচনের আগে দলের সাংগঠনিক দায়িত্ব তাঁর কাঁধে। মূলত শহরের হিন্দু ভোট, বুদ্ধিজীবী মহলে ভাঙন ধরানো এবং বহুত্ববাদী সেকুলার সমাজে প্রবেশের উদ্দেশ্যে রাজ্য সভাপতি পদে শমীক ভট্টাচার্যকে বিজেপি বেছে নিয়েছে বলে মনে করছে রাজনৈতিক মহলেরে একাংশ। কারণ বিজেপির প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার সংঘ পরিবারের ঘনিষ্ঠ হলেও, তিনি ছিলেন দক্ষিণ দিনাজপুরের বালুরঘাটের ভূমিপুত্র। অন্যদিকে যার আমলে বঙ্গ বিজেপির উত্থান, সেই দিলীপ ঘোষও ছিলেন ঝাড়গ্রামের ভূমিপুত্র। বিজেপির বর্তমান বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর শিকড়ও পূর্ব মেদিনীপুরে।
আরও পড়ুন-বঙ্গ বিজেপির কাহিল অবস্থা বেআব্রু সংঘের রিপোর্টে, বড় বিপদ অপেক্ষা করছে?
এদিকে শমীকের উত্থান শহরের রাজনীতি থেকেই। কলকাতা ও কলকাতার বাইরেও দলে গ্রহনযোগ্যতা রয়েছে তাঁর। শহুরে মধ্যবিত্ত বাঙালির মন বুঝতে শমীকের জন্য সহজ হবে। তাছাড়া গত লোকসভা নির্বাচনের ফলাফলের দিকে তাকালেই দেখা যাবে যে, কলকাতায় ভোট কমেছে তৃণমূলের। এই নিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও বেশ চিন্তিত। অন্যদিকে শহর কলকাতায় তুলনামূলক ভালো ফল করেছে বিজেপি। ফলে শহুরে ভোটারদের দৃষ্টি আকর্ষণের সুযোগ আরও বাড়ছে। এই পরিস্থিতিটাকে কাজে লাগাতে চায় বিজেপি।
যখন তৃণমূল থেকে আগত শুভেন্দু অধিকারীকেও কট্টর হিন্দুত্বের লাইন ধরতে দেখা গেছে, শমীকের বক্তব্যে উঠে এসেছে সংখ্যালঘুদের উন্নয়নের কথা। তাঁর কথায়, দল যত কট্টরপন্থী অবস্থান নেবে সংখ্যালঘুরা ততই একজোট হয়ে তৃনমূলকে ভোট দেবে। বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দু নির্যাতন, মুর্শিদাবাদ, মালদা, মহেশতলার ঘটনা নিয়ে হিন্দুত্বাবাদী প্রচারে শান দিয়েছিল বিজেপি। কিন্তু রাজ্য সভাপতি হয়েই শমীক ভট্টাচার্য তাঁর প্রথম ভাষণে বলেছেন, বিজেপি দেশ ও বাংলার সংখ্যালঘুদের 'প্রকৃত উন্নয়ন'-এর জন্য সক্রিয়। বিজেপি সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে কোনো যুদ্ধ ঘোষণা করেনি। সূত্রের খবর, শমীকের বক্তব্যে একমত বিজেপিও। শমীক সপাপতি হওয়ার পর বিজেপির প্রথম সাংগঠনিক বৈঠকে দলের কৌশল সংক্রান্ত বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। যেখানে সুনীল বনশল, মঙ্গল পাণ্ডে-র মতো কেন্দ্রীয় নেতারা শমীকের বক্তব্যের সঙ্গে সহমত পোষণ করেছেন।
আরও পড়ুন- বাংলায় আবার শূন্য থেকে শুরু! শাহি পরিকল্পনায় সিঁদুরে মেঘ দেখছেন বঙ্গ বিজেপির দাপুটে নেতারাই
কিন্তু সংখ্যালঘু প্রশ্নে কেন সুর বদলাচ্ছে বিজেপি? সাম্প্রতিক কালীগঞ্জ বিধানসভা উপনির্বাচনের ফলাফলের দিকে তাকালেই পাওয়া যাবে সেই উত্তর। কালীগঞ্জ বিধানসভার ১১০টি হিন্দু-প্রধান বুথ থেকে বিজেপি লিড পেয়েছে। কিন্তু সংখ্যালঘু-প্রধান ১৫৪টি বুথে প্রায় এককাট্টা ভোট পেয়েছে তৃণমূল, দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছে বাম সমর্থিত কংগ্রেস প্রার্থী। আর পদ্ম শিবিরের প্রাপ্ত ভোট সেখানে ৫০-এর নীচে। সংখ্যালঘুদের প্রতি বিজেপির নরম মনোভাব তাদের ভোটবাক্সে মুসলিম ভোট না আনলেও, সেই ভোট ভাগ করে তৃণমূলের নিশ্চিত ভোটব্যাঙ্কে ভাঙন ধরানো যাবে।
এছাড়া হিন্দি বলয়ের বিজেপির প্রচারের কট্টর সুর পছন্দ নয় বাঙালির। তাই বাংলার বহুত্ববাদী সেকুলার সমাজের মন জয় করতে বঙ্গ বিজেপির কাছে শমীক আদর্শ মুখ। রাজ্য সভাপতি হয়েই শমীক তাঁর বক্তব্যে বহুত্ববাদ-এর বার্তায় দিয়েছেন। তারই সঙ্গে বাজিয়ে দিয়েছেন নির্বাচনী লড়াইয়ের ময়দানে নামার ঘন্টা। রাজ্য সভাপতি হয়েই বাংলার মানুষের উদ্দেশ্যে শমীকের আহ্বান, "আগামী নির্বাচন বাংলা থেকে লগ্নি বেরিয়ে যাওয়া আটকানোর নির্বাচন। বাংলায় উপযুক্ত কর্মসংস্থান তৈরি করে রাজ্য থেকে নিরন্তর মেধা বহির্গমন রোখার নির্বাচন। হিন্দু বাঙালির অস্তিত্ব রক্ষার্থে এই নির্বাচন শেষ সুযোগ। সেই কথাটা মাথায় রেখেই মানুষ নির্বাচনে যাবেন। অন্য সবকিছু গৌণ।" এখন দেখার আগামী দিনে নির্বাচনী প্রচারে এসে কী বার্তা দেন নরেন্দ্র মোদী, অমিত শাহ-রা।