মোদি থাকতে কেন ট্রাম্প তড়িঘড়ি যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করে দিলেন?
Donald Trump ceasefire: ভারত কিন্তু দীর্ঘকাল ধরে বলে এসেছে যে, পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের দ্বন্দ্ব দ্বিপাক্ষিক বিষয় এবং ভারত অন্যের মধ্যস্থতা চায় না।
ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে পহেলগাঁও হামলা পরবর্তী আঘাত প্রত্যাঘাত পর্বের একেবারে গোড়ার দিকে আমেরিকা দুই দেশকেই ফোন করে নিরামিষ মিটমাটের কথা বলেছিল। কূটনৈতিক সৌজন্যে এটুকু অবশ্যকর্তব্য। দ্বন্দ্ব বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমেরিকার উপরাষ্ট্রপতি জেডি ভ্যান্স বলে বসেন, বিষয়টা নিয়ে আমেরিকার কিচ্ছু করার নেই। ফক্স নিউজকে এক সাক্ষাৎকারে ভ্যান্স বলেছিলেন, “আমরা এমন যুদ্ধের মাঝামাঝি জড়াতে চাইবই না যেটা নিয়ে আমাদের কিছু করারই নেই। এটি আমেরিকার লড়াই নয়।" তবুও ভ্যান্স এবং মার্কো রুবিও আমেরিকাকে অন্ধ করে প্রলয়ের কর্মকাণ্ড চলতে দিতে পারেননি। ভারত পাকিস্তানের সংঘর্ষের তীব্রতাকে ক্ষণে ক্ষণে মেপে গিয়েছেন তাঁরা। অপারেশন সিঁদুরের জবাবে যখন পাকিস্তান লাগামহীন ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্রের প্রয়োগ করতে থাকে, সরাসরি নাক গলায় আমেরিকা। ভারত বা পাকিস্তান নয়, আগেভাগে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করে দেন ডোনাল্ড ট্রাম্প!
শনিবার বিকেলে দেখা যায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি বার্তা পোস্ট করেছেন। লিখেছেন, "আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতার দীর্ঘ রাত্রিব্যাপী আলোচনার পরে, আমি এই ঘোষণা করতে পেতে আনন্দিত যে ভারত ও পাকিস্তান সম্পূর্ণ এবং তাত্ক্ষণিক যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছে।" এর আধঘণ্টা পরে ভারত সরকার যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই বিদেশ সচিব বিক্রম মিশ্রি বলেন, “উভয় পক্ষই স্থল, আকাশ ও জলপথে গুলি চালানো সহস সমস্ত সামরিক পদক্ষেপ বন্ধ করে দেবে।"
প্রশ্ন হচ্ছে, লড়াই করছে ভারত আর পাকিস্তান। দুই দেশই স্বাধীন, খামোখা অন্য একটি দেশ আগেভাগে কেন ঘোষণা করে দিল যে পহেলগাঁও সন্ত্রাসী হামলার পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের সশস্ত্র বাহিনী পাকিস্তানের সঙ্গে আর সংঘাতে যাবে না? কেন নরেন্দ্র মোদি তা ঘোষণা করলেন না? হতে পারে মোদি এবং ট্রাম্পের সখ্য গভীর, তা বলে ভারত কি আমেরিকার উপনিবেশ?
আরও পড়ুন-আইএমএফ ঋণের অপব্যবহার: ঋণ নয়, রাষ্ট্রের ছদ্মবেশী যুদ্ধ তহবিল
একটি উত্তর সহজ এবং প্রায় সকলেরই জানা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বরাবরই এই উপমহাদেশের দুই প্রতিবেশীর মধ্যে শান্তিসমঝোতায় মধ্যস্থতা করার কৃতিত্বের জন্য মরিয়া। মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর তো বিবৃতিতে বলেইছে যে এটি আসলে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে মার্কিন-মধ্যস্থতায় আসা যুদ্ধবিরতি।
ভারত কিন্তু দীর্ঘকাল ধরে বলে এসেছে যে, পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের দ্বন্দ্ব দ্বিপাক্ষিক বিষয় এবং ভারত অন্যের মধ্যস্থতা চায় না। তাহলে মোদি সরকার এই মার্কিন বিবৃতিকে প্রশ্ন করল না কেন? কেন মেনে নিল মার্কিন সমঝোতা? কাশ্মীর ভারতের দীর্ঘদিনের বিবাদের বিষয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিবৃতিতে থেকে সাফ বোঝা যাচ্ছে, কাশ্মীর আন্তর্জাতিক সমস্যা হিসাবে উঠে আসছে। রবিবার, ট্রাম্প আরও একটি বিবৃতিতে বলেছিলেন, "কাশ্মীর বিষয়ে একটি সমাধান আসতে পারে"। এর আগে মার্কো রুবিও দাবি করেছিলেন যে ভারত ও পাকিস্তান নিরপেক্ষভাবে এই নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা শুরু করতে সম্মত হয়েছে। অথচ নয়াদিল্লি বারেবারেই বলে এসেছে ইসলামাবাদ সন্ত্রাসের পথ না ছাড়লে এই নিয়ে ভারত কোনও কথা বলবে না। ১৯৮১ সালের যুদ্ধে ইন্দিরা গান্ধি প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন ভারতের কাছে পাকিস্তানের সেনা আত্মসমর্পণ করেছিল। এবার এল যুদ্ধবিরতি, তাও আমেরিকার 'নির্দেশে'।
তাহলে আমেরিকা এমন গাঁয়ে মানে না আপনি মোড়ল সাজতে ব্যাকুল কেন?
নিউইয়র্ক টাইমসে রবিবার, ১১ মে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ডেভিড ই স্যাঙ্গার, জুলিয়ান ই বার্নস, ম্যাগি হবারম্যানের লেখা ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী, শুক্রবার গভীর রাতে যখন ইসলামাবাদ সংলগ্ন গ্যারিসন সিটিতে নূর খান বিমান ঘাঁটিতে ভারতের আঘাতের পর আমেরিকার উদ্বেগ আরও ঘন হয়।
নূর খান বিমান ঘাঁটি হচ্ছে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এক কেন্দ্র। পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর কেন্দ্রীয় পরিবহন কেন্দ্রগুলির মধ্যে একটি হচ্ছে এই কেন্দ্র এবং এখান থেকে বিমানের জ্বালানি ভরা হয়। এটি পাকিস্তানের কৌশলগত পরিকল্পনা বিভাগের সদর দফতর থেকে কিছুটা দূরে অবস্থিত। এটি দেশের পারমাণবিক অস্ত্রাগারের তদারকি ও সুরক্ষার কাজে বহাল করে। পাকিস্তানের বক্তব্য, তাদের হাতে ১৭০ বা ততোধিক নিউক্লিয়ার ওয়ারহেড আছে।
Trump has posted again about India and Pakistan—and this time he says he will work with them to seek a “solution” on Kashmir.
— Michael Kugelman (@MichaelKugelman) May 11, 2025
Wow.
This goes further than his earlier offers, during his first term, of mediation on Kashmir if both sides want it. pic.twitter.com/gUVah8blvK
শুক্রবার এই ঘটনার পরে শনিবার বিকেলে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ঘোষণা করেন যে, দুই দেশ যুদ্ধবিরতিতে রাজি হয়েছে। পাকিস্তানের পারমাণবিক কর্মসূচি বিষয়ে দীর্ঘকাল কাজ করছেন এমন এক প্রাক্তন আমেরিকান আধিকারিক জানান, পাকিস্তানের গভীরতম ভয় হচ্ছে যে, পাকিস্তানের পারমাণবিক নিয়ন্ত্রণকে হ্রাস করা হচ্ছে। নূর খানের উপর ক্ষেপণাস্ত্র হামলা করে ভারত বুঝিয়ে দিয়েছে, পাকিস্তানের পারমাণবিক দাপট সামলাতে তারা প্রস্তুত।
নিউইয়র্ক টাইমসে ডেভিড ই স্যাঙ্গার, জুলিয়ান ই বার্নস, ম্যাগি হবারম্যানের লেখা ওই প্রতিবেদনেই আরও বলা হচ্ছে যে, ৯০ মিনিটের মধ্যে, ভারত রাওয়ালপিন্ডিতে নুর খান বিমান ঘাঁটি, শোরকোটের রাফিকি বিমান ঘাঁটি, পঞ্জাবের মুরিদ বিমান ঘাঁটি, সিন্ধুর সুক্কুর বিমান ঘাঁটি, সিয়ালকোট বিমান ঘাঁটি, পাসরুর এয়ারস্ট্রিপ, সারগোধ বিমান ঘাঁটি, স্কার্ডু বিমান ঘাঁটি, করাচির কাছে ভোলারি বিমান ঘাঁটি এবং জাকোবাবাদ বিমান ঘাঁটিতে হামলা করে।
আরও পড়ুন-ঝাঁ চকচকে হবে ধ্বংসস্তূপ! গাজাকে নিয়ে যা পরিকল্পনা ডোনাল্ড ট্রাম্পের
ব্রহ্মস, হ্যামার এবং স্ক্যাল্প ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে ১০টি পাকিস্তানি বিমান ঘাঁটিকে প্রত্যাঘাত করার জন্য ভারত উঠেপড়ে লেগেছিল। যা অবধারিতভাবেই পারমাণবিক যুদ্ধের দিকেই নিয়ে যেত ভারত ও পাকিস্তানকে। ভারত সরকারের শীর্ষ সূত্রের খবর বলছে, পাকিস্তানি বিমান ঘাঁটি গুঁড়িয়ে দিতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যে প্রতিশোধমূলক আক্রমণের অনুমোদন দিয়েছিলেন তা অপারেশন সিঁদুরের চেয়েও বৃহৎ এবং পাকিস্তান বুঝতে পেরেছিল এই আঘাত ঠেকানো মুশকিল।
তবে পাকিস্তানের পারমাণবিক কাঠামোর কাছে কোনও স্থানে ভারতের প্রত্যাঘাতের জল্পনা উড়িয়ে দিয়েছেন উত্তরে এয়ার মার্শাল এ.কে. ভারতী। ১২ মে তিনি জানিয়েছেন, ভারতীয় বিমান বাহিনী কিরানা পাহাড়ে আঘাত করেনি। “কিরানা পাহাড়ে কিছু পারমাণবিক স্থাপনা রয়েছে তা আমাদের জানানোর জন্য আপনাদের (সংবাদমাধ্যম) ধন্যবাদ। আমরা এটি সম্পর্কে জানতাম না। আমরা কিরানা পাহাড়ে আঘাত করিনি,” জানিয়েছেন ভারতী।
তাহলে ভারতীয় সেনার তরফেই যদি কোনও তথ্য না থাকে, যে পারমাণবিক জল্পনা চলছে, তাতে সিলমোহর দিল কে? প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে, পাকিস্তান যদি আইএমএফ-এর তহবিল ব্যবহার করে সন্ত্রাসকে সমর্থন করার নীতি অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্তই নেয়, তাহলে এই যুদ্ধবিরতি কি ভারতের জন্য কঠিন সিদ্ধান্ত হয়ে গেল না? দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ আগেও বলেছেন যে, অতীতে যুদ্ধবিরতির কারণেই পাক অধিকৃত কাশ্মীর ভারত দখল করতে পারেনি। এক্ষেত্রেও কি তাঁর যুক্তি একই থাকবে? দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর এভাবেই কি ট্রাম্প সমগ্র বিশ্বের রাজনীতির গডফাদার হয়ে উঠতে চাইছেন? শুধু ভারত-পাকিস্তানের এই সংঘাত নয়, সাম্প্রতিক সময়ে রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধেও তিনি নির্ণায়কের ভূমিকায় আসতে চেয়েছেন, গাজা নিয়েও নিজের পরিকল্পনা ব্যক্ত করেছেন। বিশ্ব রাজনীতির রাশ কি তাহলে সত্যিই ট্রাম্পের হাতে?