মানুষের ভুয়ো আতঙ্কই কি পশ্চিমবঙ্গে বাঘরোলের মৃত্যুর কারণ? যা বলছে গবেষণা
Fishing cat: সারা রাজ্যজুড়ে বাঘরোলের সংখ্যা কমে যাওয়ার নেপথ্যে খাদ্যাভাবের থেকেও বেশি কাজ করছে পথদুর্ঘটনা।
খুব বেশিদিন আগে না, এই তিরিশ-বত্রিশ বছর আগের কথা, যখন কলকাতা শহরকে ‘ক্যাট-ল্যান্ড’ বলে উল্লেখ করা হতো। কারণ তখনও কলকাতার আনাচে-কানাচে মেছোবিড়াল বা বাঘরোল, জাঙ্গল ক্যাট, লেপার্ড ক্যাট দেখা পাওয়া যেত। শুধু তাই নয়, পূর্ব কলকাতার
জলাভূমি অঞ্চল ছিল বাঘরোলের বেঁচে থাকার আদর্শ জায়গা। কিন্তু কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ও দেরাদুনের ওয়াইল্ডলাইফ ইনস্টিটিউট অফ ইন্ডিয়ার অতি-সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে, কলকাতা বাঘরোলের টিকে থাকার জন্যও অযোগ্য একটি জায়গা। পূর্ব কলকাতার জলাভূমি অঞ্চল, বানতলা, অর্থাৎ শহরের একদম প্রান্তের দিকে সরে গেছে মেছোবিড়ালরা। এই গবেষণার সঙ্গে যুক্ত ডঃ সম্রাট চক্রবর্তী জানাচ্ছেন,
“তবে রাজারহাট, নিউটাউন, ভাঙড়ের মতো জায়গা, যেগুলো বৃহত্তর কলকাতার অংশ হিসেবে ধরা হয় বর্তমানে, সেখানে যদি ঠিকমতো পরিসংখ্যান চালানো হয়, তাহলে কিন্তু বেশ ভালো সংখ্যায় ফিশিংক্যাট পাওয়া যাবে বলেই মনে করা হচ্ছে। কারণ সেখানে যথেচ্ছ মাছের ভেড়ি রয়েছে। মেছোবিড়ালের বেঁচে থাকার জন্য যা আদর্শ।"
কলকাতার বাইরে অন্য জেলায় বাঘরোলের অবস্থা
তবে শুধু কলকাতা নয়, দক্ষিণবঙ্গের যেটুকু অংশ বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ অঞ্চলের আওতায় পড়ছে, তার বাইরেও বাঘরোলের অবস্থা বেশ শোচনীয়। পশ্চিমবঙ্গের ‘স্টেট অ্যানিম্যাল’ বাঘরোল, আর তাকে সংরক্ষণের চেষ্টা পশ্চিমবঙ্গের যে ৪,৫৫০ স্কোয়ার কিলোমিটার সংরক্ষিত অঞ্চলে হয়, তার বাইরেও ৩৩ শতাংশের বেশি অঞ্চল বাঘরোলের বেঁচে থাকার জন্য আদর্শ। এই তালিকায় রয়েছে হাওড়া, পূর্ব মেদিনীপুর, নদিয়া, উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা, পূর্ব বর্ধমান এবং মুর্শিদাবাদ। এই জেলাগুলিতে এখনও ক্যামেরাট্র্যাপ বসিয়ে বাঘরোলের দেখা পেয়েছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ও ওয়াইল্ডলাইফ ইনস্টিটিউট অফ ইন্ডিয়ার গবেষকরা।
সম্প্রতি দিঘার পর্যটকহীন জায়গা, রামনগর অর্থাৎ মেদিনীপুরের উপকূলবর্তী অঞ্চল যেখানে যথেচ্ছ ভেড়ি রয়েছে, সেখানেও তাঁরা লক্ষ্য করেছেন বাঘরোলের আনাগোনা। এছাড়াও বাঘরোলের দেখা মিলেছে পূর্ব মেদিনীপুরের মহিষাদল ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চল, দক্ষিণ ২৪ পরগনার হেনরি দ্বীপে। কিন্তু এই অঞ্চলের কোনওটিতেই প্রায় বাঘরোল সংরক্ষণের জন্য কোনও উদ্যোগই নেওয়া হয় না। গবেষকদের মতে, এই জেলাগুলিতে, সর্বোপরি গাঙ্গেয় সমতলভূমিতে বাঘরোল সংরক্ষণের উদ্যোগ দ্রুত নেওয়া জরুরি।
কেন কমছে বাঘরোলের সংখ্যা?
সংরক্ষিত অঞ্চলের বাইরের এই ৩৩ শতাংশ অঞ্চলের মধ্যে আবার প্রায় ৮৯ শতাংশ অঞ্চল মনুষ্যবসতির মধ্যে। নতুন এই গবেষণা বলছে, সেই সমস্ত অঞ্চলে যথেষ্ট পরিমাণে চাষের জমি, জলাভূমি, পুকুর ও ভেড়ি রয়েছে। কিন্তু সেখানে মানুষ-প্রাণীর সংঘাত
(ম্যান-অ্যানিম্যাল কনফ্লিক্ট) আর পথদুর্ঘটনার কারণে বেঘোরে মারা পড়ে প্রচুর বাঘরোল। উপরন্তু যেভাবে বেলাগাম ও অপরিকল্পিত নগরায়ণ ঘটছে, তাতে জলাভূমি বোজানোর মতো ঘটনা আকছার ঘটে। আর যেহেতু বাঘরোলের প্রধান খাবার মাছ, কাঁকড়া ও সাপ, আর যাদের বেঁচে থাকার জন্য জল অত্যাবশ্যক, সেই জলাভূমি না থাকলে বাঘরোল খাবে কী!
কলকাতার কথাই ধরা যাক। সময়ের সঙ্গে-সঙ্গে পৌরসভার গাফিলতি ও জনসাধারণের সচেতনতার অভাবে কলকাতার নদী বদ্ধ, পূতিগন্ধময় নালায় পরিণত হয়েছে। পাশাপাশি কেবল ১৯৯০ থেকে ২০১১ সালের মধ্যেই পূর্ব কলকাতার জলাভূমি সংলগ্ন অঞ্চলের বেলাগাম নগরায়ণ হয়েছে। এই সময়ের মধ্যেই জলাভূমির ১৭ বর্গকিলোমিটার অংশ বুজিয়ে ইমারত গজিয়ে উঠেছে। যে বাঘরোলের বেঁচে থাকার জন্য মাছ আবশ্যক, আর মাছের জন্য আবশ্যক জল, কলকাতায় আজ সেই জলাভূমির আকাল। স্রেফ খাবারের অভাবেই, যে সামান্য সংখ্যক বাঘরোল ছিল, তারাও কলকাতা শহরের প্রান্তের দিকে সরে যেতে বাধ্য হয়েছে। কিন্তু গবেষকদের মতে, সারা রাজ্যজুড়ে বাঘরোলের সংখ্যা কমে যাওয়ার নেপথ্যে খাদ্যাভাবের থেকেও বেশি কাজ করছে পথদুর্ঘটনা।
যে পথে দুর্ঘটনা বেশি
গবেষকরা খেয়াল করেছেন, ১২ নম্বর জাতীয় সড়কপথ আর মুর্শিদাবাদের পলাশি-রেজিনগর এবং ভগবানগোলার উপর দিয়ে প্রসারিত ৩১২ নম্বর জাতীয় সড়ক পথদুর্ঘটনা-প্রবণ এলাকা। যেখানে গাড়ির ধাক্কায় বেঘোরে মারা পড়ে প্রচুর বাঘরোল। এদিকে বেলডাঙার নিকটবর্তী ১৪ নম্বর রাজ্য সড়ক, তেহট্ট ঘাট রোড, নবদ্বীপ রোড, বেতাই অঞ্চলের কাছে ১১ নম্বর জাতীয় সড়কে বাঘরোলের মৃত্যু ব্যাপকহারে ঘটে।
অন্যদিকে রয়েছে সোদপুর থেকে শ্যামনগর অবধি কল্যাণী এক্সপ্রেসওয়ের অংশ, বারাসাত রোড, বাদুড়িয়া রোড, দক্ষিণ ২৪ পরগনার বারুইপুর-ক্যানিং রোড, বাসন্তী হাইওয়ে, বারুইপুর সংলগ্ন ডায়মন্ড হারবার রোড, ভাঙড় রোড, যেখানে ঘনঘন পথদুর্ঘটনার কারণে মৃত্যু হয় প্রচুর সংখ্যক বাঘরোলের।
হাওড়ার বাগনান-আমতা রোড, আমতা-রানিহাটি রোড, পাঁচলা-সংলগ্ন ৪৫ নম্বর রাজ্য সড়কও রয়েছে এই তালিকায়। এছাড়াও দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুর বহুল আশঙ্কা রয়েছে হুগলির ১৫ নম্বর জাতীয় সড়ক, সিঙ্গুর-সংলগ্ন ১৬ নম্বর ও ১৯ নম্বর জাতীয় সড়কে।
বাঘ, চিতা, হাতি ইত্যাদি স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মতোই বাঘরোল একসঙ্গে বিছিন্নভাবে ছড়িয়ে থাকা এক-একটি অঞ্চল বা হ্যাবিট্যাটে বাস করে। এই আপাত বিছিন্ন অঞ্চলগুলির মধ্যেও বাঘরোলের যাতায়াত বজায় থাকে ছোট-ছোট করিডোরের মাধ্যমে। হয়তো দেখা গেল, সেই
করিডোরের উপর দিয়েই গিয়েছে বড় কোনও সড়কপথ, যেখানে ভারী থেকে হালকা যানবাহনের চলাচল লেগেই রয়েছে। আবার দেখা গেল, একটি অঞ্চলের বাঘরোলদের রাস্তা পেরিয়ে খাদ্যের সংস্থানে যেতে হচ্ছে। হয়তো রাস্তা পেরোলে ভেড়ি বা পুকুর রয়েছে, যেখানে সে মাছ পাবে। তাই যানবাহনে ভরা সড়কপথে প্রাণ হারাচ্ছে এরা। যে অঞ্চলের প্রায় পুরোটাই পড়ছে বন্যপ্রাণীদের জন্য সংরক্ষিত অঞ্চলের বাইরে।
সচেতনতার অভাব এবং সংবাদ ও সমাজমাধ্যমের গাফিলতি
“পশ্চিমবঙ্গে অধিকাংশ মানুষই জানেন না যে আমাদের স্টেট অ্যানিম্যাল বাঘরোল বা মেছোবিড়াল। যেহেতু সাধারণ বিড়ালের আকারের প্রায় দ্বিগুণ বা তিনগুণ আর গায়ে চিতাবাঘের মতো ছোপ রয়েছে, তাই আমজনতার মতে এরা হলো বাঘের বাচ্চা”, আক্ষেপ করে জানালেন ডঃ চক্রবর্তী। তিনি বলছেন, “তবে অন্ধকারে হঠাৎ চোখে পড়লে যে কারওই বাঘের বাচ্চা ভেবে ভুল হবে।"
আমজনতার এই অজ্ঞতার পেছনে সামাজিক মাধ্যম, এমনকী সংবাদমাধ্যমের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। ডঃ চক্রবর্তী জানাচ্ছেন, “কোনও গ্রামে বাঘরোল দেখা গেলে বড় বড় সংবাদমাধ্যম থেকে শুরু করে, ছোটখাটো ভ্লগার পর্যন্ত প্রচার করে 'ভয়ঙ্কর অজানা জন্তুর' দেখা মিলেছে। এরকম ঘটনা সাধারণ মানুষের মনে আতঙ্কের সঞ্চার করে। মানুষও সন্ত্রস্ত হয়ে এবং খানিকটা সচেতনতা ও শিক্ষার অভাবে বাঘ ভেবে বাঘরোলকে মেরে ফেলে।"
পুকুর বা ভেড়ির আশেপাশে ক্যামেরা ট্র্যাপ বসালে, সেটি নজরে রাখার জন্য এলাকার বাসিন্দাদের সাহায্য লাগে। গবেষকদের পক্ষে সপ্তাহের পর সপ্তাহ সেখানে বসে ক্যামেরা ট্র্যাপ পাহারা দেওয়া সম্ভব নয়। সেক্ষেত্রে সরকারের পরে ভরসার জায়গা সাধারণ মানুষই। “বাঘরোল নিয়ে মানুষের উদাসীনতা ও সহযোগীতার অভাবের জন্য উত্তরবঙ্গেও সার্ভে করতে সমস্যা হয়েছে। ফলে উত্তরবঙ্গে আমরা নানা প্রতিকূলতার জন্যে বাঘরোল গণনার কাজ চালাতে পারিনি”, জানাচ্ছেন ডঃ চক্রবর্তী।
সরকারি গাফিলতি
ডঃ চক্রবর্তীর মতে বাঘরোল নিয়ে সরকারের উদাসীনতা স্পষ্ট। “যার ফলে নিউটাউন, রাজারহাট, ভাঙড় বা তার আশেপাশের অঞ্চলগুলিতে আমরা সার্ভে করতে পারিনি। সরকারের তরফ থেকে কোনও প্রকল্প নেই। যা না থাকলে গবেষণা এগোনো আমাদের পক্ষে
সম্ভব নয়”, আক্ষেপ করলেন তিনি।
এছাড়াও উত্তরবঙ্গে সমীক্ষা চালানোর সময় যে প্রতিকূলতার মুখোমুখি হন গবেষকরা, তা মাথায় রেখে তাঁরা প্রস্তাব দিয়েছিলেন কেবল উত্তরবঙ্গের কথা মাথায় রেখেই মালদা, দুই দিনাজপুর, কোচবিহার, জলপাইগুড়ি এবং অবশ্যই তরাই অঞ্চলকে সামনে রেখে সমীক্ষা
করার কথা। কিন্তু বোর্ড বা বনদফতর কারও তরফ থেকেই কোনও সাহায্য পাওয়া যায়নি। ফলে উত্তরবঙ্গে সম্ভাব্য অঞ্চলগুলিও বাদের খাতায় থেকে গেছে। যার প্রভাবে এই অঞ্চলের মানুষদেরও বাঘরোল নিয়ে আর সচেতন করা সম্ভব হচ্ছে না।
বাঘরোলে সংরক্ষণের জন্য পদক্ষেপ দরকার
এই গবেষণা উল্লেখ করছে,সংরক্ষিত অঞ্চলগুলিতে বাঘরোল নিরাপদে আছে। বিশেষ নজর দরকার সংরক্ষিত অঞ্চলের বাইরে, যে অঞ্চলের বিস্তার সংরক্ষিত অঞ্চলের থেকেও বেশি। তাই সবার আগে প্রয়োজন মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানো। গবেষকদের মতে, সড়কপথে দুর্ঘটনাপ্রবণ অঞ্চলগুলিতে স্পিড ব্রেকার এবং সাবধানবাণী লিখে কমানো যেতে পারে দুর্ঘটনা। ঠিক যেমনটা হাতি, হরিণ, নীলগাই বা অন্যান্য বন্যপ্রাণী অধ্যুষিত জায়গাগুলিতে করা হয়। এছাড়াও নির্দিষ্ট কিছু অঞ্চলে যানবাহনের গতিবেগ বেঁধে দিয়েও আটকানো যেতে পারে বাঘরোলের মৃত্যু।
ডঃ চক্রবর্তীর মতে, “সংবাদমাধ্যম থেকে শুরু করে সমাজমাধ্যম, সবাইকে দায়িত্ব নিয়ে আমজনতার মাঝে বাঘরোল নিয়ে সচেতনতা বাড়াতে হবে, ভুয়ো খবর বা আতঙ্ক না ছড়িয়ে।" বাঘরোল মাছ খেয়ে যায় বলে বহু মানুষের রোষ থাকে এদের উপর। কিন্তু প্রকৃতিতে মানুষ যে সবার উর্ধ্বে নয়, সবাইকে নিয়েই যে প্রকৃতি এবং প্রাকৃতিক সম্পদে যে সমস্ত জীবের অধিকার রয়েছে, এ কথা বিশ্বায়ন মানুষকে ভুলিয়ে দিয়েছে। প্রাণী ও প্রকৃতিবিদ ডঃ জেন গুডঅল নিজের নব্বইতম জন্মদিনে ‘মঙ্গাবে’-র একটি পডকাস্টে উল্লেখ করেছিলেন, “প্রকৃতিকে বাঁচানোর জন্য সমস্ত জীব-জগতের উপর মানুষের সহানুভূতির প্রয়োজন”। বাঘরোল সংরক্ষণের প্রসঙ্গে ঠিক একই কথাই
প্রতিধ্বনিত হলো ডঃ চক্রবর্তীর কথাতেও।