আইএমএফ ঋণের অপব্যবহার: ঋণ নয়, রাষ্ট্রের ছদ্মবেশী যুদ্ধ তহবিল
IMF loan: একাধিক গবেষণা বলছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আইএমএফ বোর্ডে সবচেয়ে বেশি ভোটাধিকার রেখে অনেক সময় রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে তদারকি নীতিতে হস্তক্ষেপ করে।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফ-এর প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ১৯৪৪ সালে বিশ্বযুদ্ধোত্তর বৈশ্বিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার লক্ষ্য নিয়ে। সদস্য রাষ্ট্রদের মধ্যে আর্থিক সংকট দেখা দিলে অথবা দেউলিয়া রাষ্ট্রগুলিকে কাঠামোগত সংস্কারের মাধ্যমে সহায়তা করা। এই সংস্থা স্বল্প বা মধ্যমেয়াদি ঋণ দিয়ে সঙ্কট নিরসনে সহায়তা করে। কিন্তু বাস্তব অভিজ্ঞতা বলে, বহু দেশই এই ঋণের প্রকৃত উদ্দেশ্য থেকে সরে এসে একে নিজস্ব রাজনৈতিক, সামরিক কিংবা কৌশলগত লক্ষ্য পূরণের জন্য ব্যবহার করে থাকে। এসব অপব্যবহার কখনও সরাসরি রাষ্ট্রীয় দুর্নীতি, কখনও সামরিক আগ্রাসন, আবার কখনও জঙ্গি সংগঠনের নীরব পৃষ্ঠপোষণেও রূপ নেয়।
পাকিস্তান এই প্রেক্ষাপটে একটি স্পষ্ট উদাহরণ। দেশটি ১৯৫৮ সাল থেকে এ পর্যন্ত আইএমএফ-এর কাছ থেকে ২২ বার ঋণ নিয়েছে। এর মধ্যে অন্তত ৭ বার ঋণ নেওয়া হয়েছে ২০০১ সালের পর, যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ‘সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ’-এ পাকিস্তানকে মিত্র হিসেবে গণ্য করে। কিন্তু অতীত অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, এই ঋণের বড় অংশই সামরিক খাতের জন্য পরোক্ষভাবে ব্যবহার হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস রিসার্চ সার্ভিস (সিআরএস)-এর একাধিক রিপোর্ট ও The New York Times, Foreign Policy এবং Reuters-এর অনুসন্ধানে দেখা যায়, পাকিস্তান এই তহবিলকে সেনাবাহিনীর দখলে থাকা অর্থনৈতিক প্রকল্পে (যেমন ডিফেন্স হাউজিং অথরিটি, ফৌজি ফাউন্ডেশন ) বিনিয়োগ করেছে এবং আফগান সীমান্তে তালিবান বা লস্কর-ই-তৈবার মতো গোষ্ঠীর প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চালাতে মদত দিয়েছে। ২০০৮-২০০৯ সালের ঋণ পর্বে অর্থনৈতিক সংস্কারের নামে জ্বালানি ভর্তুকি কমানো হলেও, প্রতিরক্ষা ব্যয় একইসঙ্গে বেড়েছিল, যা আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলির প্রশ্নের মুখে পড়ে। ২০০৮ সালে পাকিস্তান যখন ৭.৬ বিলিয়ন ডলারের স্ট্যান্ডবাই ঋণ গ্রহণ করে, তখন অর্থনৈতিক সংস্কারের নামে সরকারি ভর্তুকি কমানো হয়, অথচ একই সময় কাশ্মীর সীমান্তে নতুন সেনা ঘাঁটি নির্মাণ ও গোপনে প্রশিক্ষিত সশস্ত্র গোষ্ঠীকে অর্থায়নের অভিযোগ উঠে। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত রিপোর্ট ও মার্কিন কংগ্রেসের কিছু ব্রিফিং-এ উল্লেখ করা হয়, কীভাবে এই তহবিলের নিরীক্ষা দুর্বল এবং অর্থ কোথায় কীভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে, তা যাচাইয়ের কার্যকর ব্যবস্থা আইএমএফের নেই। পাকিস্তানের অভ্যন্তরে সামরিক ও বেসামরিক প্রশাসনের অস্বচ্ছতা, জবাবদিহির অভাব এবং নিরাপত্তা নীতির নামে রাজনৈতিক বিরোধী দল দমনের প্রবণতা, আইএমএফ ঋণের একটি বড় অংশকে জনগণের চাহিদার বদলে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা সংরক্ষণের কাজে পরিণত করেছে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি প্রভাবশালী ব্যবসায়িক নেটওয়ার্ক রয়েছে, যার মধ্যে আছে আবাসন, নির্মাণ, খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণসহ একাধিক খাত। এই সেনা-পরিচালিত অর্থনৈতিক কাঠামোতে আইএমএফ-এর ঋণের অর্থ পরোক্ষভাবে প্রবেশ করছে বলে অনেক আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক মত দেন। পেন্টাগন ও মার্কিন সিনেটের কিছু তদন্ত রিপোর্টেও এর ইঙ্গিত রয়েছে।
আরও পড়ুন- ৭৭ বছরেও কেন স্থায়ী শান্তির পথে যেতে পারল না ভারত-পাকিস্তান?
একই ধরনের অভিজ্ঞতা দেখা যায় মিশরে। ২০১৬ সালে আইএমএফ মিশরকে ১২ বিলিয়ন ডলারের ঋণ অনুমোদন করে। সেই অর্থ খরচের লক্ষ্য ছিল আর্থিক সংস্কার, দারিদ্র্য হ্রাস এবং বিনিয়োগ আকর্ষণ। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, সেই তহবিলের একটি অংশ ব্যবহার করা হয় রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত মেগা-প্রকল্পে, যার বেশিরভাগ নিয়ন্ত্রণ ছিল মিশরীয় সেনাবাহিনীর হাতে। যার মধ্যে ছিল ৪৫০০ কিলোমিটার নতুন হাইওয়ে এবং সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে ‘নতুন রাজধানী’ নির্মাণ। Human Rights Watch ও Carnegie Endowment-এর একাধিক বিশ্লেষণে উঠে আসে, এই তহবিল গোপন নজরদারি প্রযুক্তি ও রাষ্ট্রীয় দমননীতিতে ব্যবহার হয়েছে, আইএমএফ-এর নীতিমালার সম্পূর্ণ পরিপন্থীভাবে। পাশাপাশি নিরাপত্তা খাতে বড় অঙ্কের অর্থ ব্যয় হয়, যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল নজরদারি প্রযুক্তি, বিরোধী দলের ওপর নির্যাতন মূলক কৌশল এবং সংবাদমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর মতে, এই সমস্ত ব্যয় আইএমএফের নীতিমালার পরিপন্থী হলেও কার্যত নজরদারির অভাবে এগুলো চলে এসেছে অর্থনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে।
আর্জেন্টিনার ঘটনাও উল্লেখযোগ্য। ২০১৮ সালে IMF ইতিহাসের বৃহত্তম ঋণচুক্তির আওতায় দেশটিকে ৫৭ বিলিয়ন ডলার বরাদ্দ দেয়। Bloomberg ও BBC অনুসারে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মাউরিসিও মাকরির সরকার এই অর্থ দিয়ে অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার প্রতিশ্রুতি দিলেও, পরে জানা যায় যে নির্বাচনপূর্ব ব্যয়ের চাপ মেটাতে এবং মুদ্রাস্ফীতি সাময়িকভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখতে এই ঋণের একটা বড় অংশ ব্যবহার করা হয়। ফলস্বরূপ, ঋণের টাকায় কাঠামোগত সংস্কার তো ঘটেনি, বরং ঋণ বোঝা আরও বেড়ে যায় এবং দেশটি ২০২০ সালের মধ্যে আবারও ঋণ খেলাপি হয়ে পড়ে।
আফ্রিকার বহু দেশেও আইএমএফ ঋণ পরবর্তী সময়ে হয়ে উঠেছে রাজনৈতিক ক্ষমতা সংহত করার এক ‘দৃষ্টিনন্দন’ উপকরণ।কেনিয়া, জিম্বাবুয়ে, অ্যাঙ্গোলা কিংবা নাইজেরিয়ার মতো দেশগুলোতে দেখা যায়, এই তহবিল চলে যায় প্রেসিডেন্টের অফিস, ক্ষমতাসীন দলের পৃষ্ঠপোষক প্রকল্প বা ব্যক্তিগত বিলাসের পেছনে। Transparency International ও The Africa Report-এর তথ্যমতে, অ্যাঙ্গোলায় আইএমএফ ঋণ থেকে অর্জিত অর্থ প্রেসিডেন্ট পরিবার-নিয়ন্ত্রিত তেল কোম্পানিতে ঢুকে পড়েছিল, নাইজেরিয়াতে এই অর্থ গিয়েছিল ‘ghost project’-এ, যা কখনও বাস্তবায়িতই হয়নি। এতে করে ঋণভিত্তিক উন্নয়নের নামে গড়ে ওঠে একধরনের রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষণতন্ত্র, যা অদৃশ্য থাকে আন্তর্জাতিক আলোচনার বাইরে।
এই ধরনের অপব্যবহারের প্রধান কারণ হচ্ছে আইএমএফের ফলো-আপ বা নজরদারি কাঠামো দুর্বল ও রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত। যেসব দেশ কৌশলগত দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপিয় মিত্র, সেসব দেশের ক্ষেত্রে আইএমএফ অনেক সময় সুশাসন বা দুর্নীতির প্রশ্নে চুপ থাকে। আইএমএফ বোর্ডে সব থেকে বেশি ভোটাধিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের, ১৬.৪৯ শতাংশ। তারপরেই জাপান, ৬.১৪ শতাংশ। ভারত, বাংলাদেশ, ভুটান এবং শ্রীলঙ্কা সম্মিলিতভাবে ৩.০৫ শতাংশ ভোট। একাধিক গবেষণা বলছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আইএমএফ বোর্ডে সবচেয়ে বেশি ভোটাধিকার রেখে অনেক সময় রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে তদারকি নীতিতে হস্তক্ষেপ করে। ২০১০ সালে Wikileaks ফাঁস হওয়া এক মার্কিন কেবল দেখায়, পাকিস্তানকে দেওয়া আইএমএফ ঋণের ওপর কঠোর নজরদারি না রাখার জন্য মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর চাপ প্রয়োগ করেছিল, কারণ তারা আফগান যুদ্ধক্ষেত্রে পাকিস্তানের ভূমিকাকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করত। মার্কিন মিডিয়া হাউস 'দ্য ইন্টারসেপ্ট' দাবি করেছে যে, পাকিস্তান আইএমএফ ঋণ পাওয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে গোপন অস্ত্র চুক্তি করেছে। এই চুক্তির আওতায় পাকিস্তান থেকে অস্ত্র কিনে তা ইউক্রেনে পাঠানো হয়েছে, যার বিনিময়ে পাকিস্তান আইএমএফ ঋণ পেয়েছে। বলা হয়েছে, "পাকিস্তান থেকে ৯০০ মিলিয়ন ডলারের অস্ত্র কিনে তা ইউক্রেনে পাঠানো হয়েছে, এবং এর বিনিময়ে পাকিস্তান আইএমএফ থেকে ঋণ পেয়েছে।"
আরও পড়ুন-পাকিস্তানের ‘জিহাদি জেনারেল’! কতখানি ক্রূর সেনা প্রধান মুনির?
এই প্রেক্ষাপটে আইএমএফ ঋণ প্রায়শই হয়ে ওঠে এক ধরনের ছদ্মবেশী যুদ্ধ তহবিল, যার মুখে থাকে উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি, কিন্তু ভিতরে থাকে রাষ্ট্রের কর্তৃত্ববাদী প্রকল্প, দুর্নীতিপূর্ণ প্রকল্প চালু, সামরিক আগ্রাসন কিংবা জঙ্গিবাদের ছায়া। সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো— এসব ঋণের দায় শোধ করতে গিয়ে, এই অপব্যবহার সাধারণ জনগণের মাথার ওপরে চাপিয়ে দেওয়া হয় ভর্তুকি প্রত্যাহার, খাদ্যদ্রব্যের দাম বৃদ্ধি, কর চাপানো, মুদ্রাস্ফীতি ও বেকারত্বের আকারে। ফলে ঋণ গৃহীত দেশের দরিদ্র শ্রেণিই হয় সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী।
বিশ্বব্যাপী এই চিত্র বদলাতে হলে কেবলমাত্র অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি নয়, দরকার একটি রাজনৈতিক ও নৈতিক পুনর্মূল্যায়ন। আইএমএফসহ আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের উচিত ঋণ প্রদানের পর সেটির প্রতিটি ব্যয়ের ওপর কঠোর স্বচ্ছতা ও নিরীক্ষা নিশ্চিত করা। নতুবা এই ঋণ ভবিষ্যতেও কেবলমাত্র রাজনৈতিক হাতিয়ার হয়ে থাকবে— গরিবের নামে নেওয়া, কিন্তু যুদ্ধের জন্য খরচ করা। ক্ষমতাধর রাষ্ট্র ও শাসকের হাতের 'শান্তির মুখোশে লুকানো যুদ্ধ তহবিল' হিসেবেই রয়ে যাবে। পাকিস্তানকে সাম্প্রতিক ঋণ মঞ্জুর করার পর, নির্বাসিত প্রাক্তন আফগান সংসদ সদস্য মরিয়ম সোলাইমান খিল আইএমএফকে 'রক্তপাতের অর্থায়ন' করার অভিযোগ করেছেন। তিনি সোশ্যাল মিডিয়ায় লিখেছেন, "আইএমএফ কোনও অর্থনীতিকে উদ্ধার করেনি। এটি রক্তপাতের অর্থায়ন করেছে। হত্যা করার জন্য পাকিস্তানকে বিশ্ব আর কতদিন অর্থ দেবে?"
তথ্যসূত্র :
Congressional Research Service (CRS), “Pakistan’s Internal Security Challenges”, 2022
The New York Times, “U.S. Aid to Pakistan Misspent”, 2009; Foreign Policy, “Where the IMF Falls Short in Pakistan”, 2023
IMF Country Report No. 09/270 – Pakistan, 2009
IMF Press Release No. 16/501: Egypt Loan Approval, 2016
Carnegie Endowment: “Egypt’s Uncivil Military Economy”, 2020; Human Rights Watch, Egypt Annual Report, 2017
Bloomberg, “IMF Money Went to Calm Markets in Argentina, Not Fix Economy”, 2019
Transparency International, “Corruption in Africa's Public Finance”, 2021
Babb & Buira, The IMF and the Politics of Conditional Lending, 2013
Wikileaks: Cable 10ISLAMABAD2227 – “IMF and Pakistan: Behind the Scenes Pressure”, 2010