৭৭ বছরেও কেন স্থায়ী শান্তির পথে যেতে পারল না ভারত-পাকিস্তান?
Operation Sindoor: বর্তমান বিশ্বের বহুধা বিভক্ত শক্তিগুলিকে মোটামুটি নিরপেক্ষ অবস্থান নিতে বাধ্য করাকে ভারতীয় কূটনৈতিক সাফল্য হিসেবেই দেখতে হবে।
যুদ্ধের মধ্যে শান্তির বীজ কী করে লুকিয়ে থাকবে? এ তো সোনার পাথর বাটির মতো ব্যাপার হলো। যুদ্ধ ও শান্তি সম্পূর্ণ বিপরীত ধর্মী দু'টি শব্দ। একটি শেষ না হলে আরেকটি থাকতে পারে না। তাহলে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সাম্প্রতিক যুদ্ধ পরিস্থিতির মধ্যে শান্তি কোথা থেকে এল? যুদ্ধবিরতি মানে তো আর নিশ্চিত শান্তি নয়।
এ প্রশ্ন স্বাভাবিক, কিন্তু ঠাট্টাচ্ছলে উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়।
কাশ্মীরের পহেলগাঁওয়ে জঙ্গিরা এক এক করে হিন্দু পর্যটকদের বেছে বেছে হত্যা করার পর, ভারতের পাকিস্তানের জঙ্গি ঘাঁটিগুলির উপর আক্রমণ করে তা নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া ছাড়া আর কী উপায় ছিল! হতে পারে, যে সব জঙ্গিরা এই ভয়ানক নির্মম হত্যালীলা চালাল, তাদের গ্রেফতার করে, তদন্ত করে, ঠিক কারা এর পিছনে রয়েছে, তাদের চিহ্নিত করে, ধরপাকড় করে ভারতীয় আইন অনুযায়ী চরমতম শাস্তি দেওয়ার একটা উপায় ছিল বটে। সেই তদন্তের জন্য অন্তত মৌখিকভাবে পাকিস্তানও সহযোগিতা করতে রাজি ছিল। কারণ অভিযোগ বরাবরই যে, পাকিস্তানের সরকার, গোয়েন্দা সংস্থা বা সেনাদের মদতপুষ্ট হয়েই এই ধরনের জঙ্গিরা ভারতের মাটিতে হত্যালীলা চালায়। সে তারা স্বীকার করুক বা না করুক।
এটি একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া। যে প্রক্রিয়াতে মুম্বইতে ২৬/১১ বর্বরোচিত জঙ্গি হামলার পরে পাকিস্তানি জঙ্গি আজমল কাসভকে ধরে তার বিচার ও শাস্তি হয়েছে। একই ঘটনায় অভিযুক্ত পাকিস্তানি-মার্কিন ইসলামি জঙ্গি ডেভিড কোলম্যান হেডলিকে ১৭ বছর বাদে আমেরিকা থেকে ভারতে আনা গেছে।
না তো ২০০১-এর ভারতীয় সংসদে জঙ্গি হামলা, না ২০০৮-এর এই মুম্বই জঙ্গি হামলা — কোনও ঘটনার পরই ভারত পাকিস্তানের উপর কোনও সামরিক আক্রমণ করেনি। যদিও অপারেশন পরাক্রম নাম দিয়ে ভারত-পাকিস্তান মধ্যে নিয়ন্ত্রণ রেখা বরাবর সেনা তৎপরতা দেখা গিয়েছিল। কিন্তু তা কখনই পুরোপুরি যুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরি করেনি। তৎকালীন সরকার মূলত দেশের আইন ব্যবস্থার উপর ভরসা রেখেছিল।
আরও পড়ুন-পাকিস্তানের ‘জিহাদি জেনারেল’! কতখানি ক্রূর সেনা প্রধান মুনির?
তবে আরেকটি উপায় ভারতের হাতে বরাবরই ছিল এবং আছে। পাকিস্তানের উপর সেই কূটনৈতিক চাপ বাড়ানোর কৌশল সবসময় অব্যাহত ছিল। তবে ২০১১ সালে ওসামা বিন লাদেনকে হত্যা করা পর্যন্ত বা আফগানিস্তানে তালিবানদের জব্দ করার জন্য পশ্চিমি দুনিয়ার বা বিশেষত আমেরিকার পাকিস্তানকে দরকার ছিল। ফলে সেখানে পাকিস্তানকে সামরিক আক্রমণ করে ঘেঁটে দেওয়াতে মোটেই দুনিয়ার শক্তিধর দেশগুলির সমর্থন ছিল না।
তবে কূটনৈতিক চাপ বৃদ্ধির ফল হিসেবেই ২০১৮ সালে জি-৭ দেশগুলির সংস্থা ফাইনান্সিয়াল টাস্ক ফোর্স-এর গ্রে লিস্টে স্থান হয়েছিল পাকিস্তানের। অর্থাৎ জঙ্গিদের সাহায্য করা, জঙ্গিদের আর্থিক সাহায্য করা, বেআইনি টাকার লেনদেন সংক্রান্ত অভিযোগের ভিত্তিতেই এই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল ফাইনান্সিয়াল টাস্ক ফোর্সের তরফে। যদিও ২০২২ সালের অক্টোবর মাসে সেই তালিকা থেকে পাকিস্তানকে সরিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু ভারতের কূটনৈতিক চাপের কারণেই বেশ কিছু সময় ধরে কাশ্মীর নিয়ে আন্তর্জাতিক স্তরে বিশেষ ট্যাঁ-ফোঁ করার সুযোগ পায়নি পাকিস্তান। এমনকী ভারত সরকার যখন কাশ্মীরের বিশেষ অধিকার সম্বলিত ৩৭০ নম্বর ধারাটিকে ভারতীয় সংবিধান থেকে মুছে দিল, তখনও পাকিস্তান বিশেষ কিছু করে উঠতে পারেনি।
কিন্তু বকলমে তারা ভারত-বিরোধী জঙ্গি গোষ্ঠীগুলিকে মদত দিয়ে গেছে। কারণ পাকিস্তানের মাটি থেকেই লস্কর-ই-তৈবা, জৈশ-ই-মহম্মদের মতো জঙ্গিগোষ্ঠীগুলির নেতারা ভারত-বিরোধী হঙ্কার দিয়েছে এবং তারা সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে জঙ্গি কার্যকলাপ চালিয়ে গেছে।
এর আগে ২০১৬ সালে উরিতে ও ২০১৯ সালে পাঠানকোটের সেনা ছাউনিতে জঙ্গি হামলার পরে ভারতীয় সেনা সার্জিক্যাল স্ট্রাইক করেছে। কিন্তু কার্গিল যুদ্ধের পরে পাকিস্তানের মূল ভূখণ্ডে (মানে পাকিস্তান-অধিকৃত কাশ্মীর বাদ দিয়ে) কখনও আক্রমণ করেনি। এবার মূল পাকিস্তানের জমিতে ভারতীয় সেনারা আক্রমণ শানিয়েছে। প্রথমে শুধুমাত্র জঙ্গি ঘাঁটিগুলি গুঁড়িয়ে দিলেও, পরে পাকিস্তানের আক্রমণের উত্তরে তাদের সেনা ঘাঁটিতেও পাল্টা আক্রমণ চালাতে বাধ্য হয়েছে।
ভারতীয় অভ্যন্তরীণ তদন্ত, নিরাপত্তার ঘাটতির প্রশ্ন আলাদা একটি বিষয়। সে বিষয়ে আলোচনা করার সময় এটি নয়। কিন্তু পাকিস্তানের মাটিতে জঙ্গি ঘাঁটিগুলিতে লক্ষ্য করে আক্রমণ দরকারি ছিল। এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই যে, এটি একটি সামরিক ও রাজনৈতিক বার্তা দেওয়ার জন্যই দরকারি ছিল। ভারতীয় রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষের মতো পাকিস্তানের রাজনৈতিক ও সামরিক কর্তৃপক্ষের জন্য এই সামরিক আক্রমণ চুপচাপ মেনে নেওয়া কষ্টকর। তাই তারাও প্রত্যাঘাত করেছে। ভারতীয় সেনাও তার যথাযথ উত্তর দিতে বাধ্য হচ্ছে।
ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ বা যুদ্ধ পরিস্থিতি নতুন নয়। ১৯৪৭-৪৮ হোক বা ১৯৬৫ বা ১৯৭১ বা ১৯৯৯ — দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে যুদ্ধে হয়েছে। জওহরলাল নেহরু হন বা ইন্দিরা গান্ধি, অটল বিহারি বাজপেয়ীকেও যুদ্ধের দিকে যেতে হয়েছিল। সুতরাং নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে পাকিস্তানের উপর প্রত্যাঘাত নতুন নয়। বরং ২০১৬ ও ২০১৯-এ সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের ঘটনা ঘটেছে এই সরকারের আমলেই।
কিন্তু শুধুই বদলা চাই-এর স্লোগান তুলে ভারতীয় সেনাবাহিনীর এই প্রত্যাঘাতকে দেখলে চলবে না। আমদের মধ্যে অনেকেই যুদ্ধকে রোমান্টিসিজমের পর্যায়ে নিয়ে যাই। কেউ কেউ এর মধ্যে দিয়ে প্রতিশোধের স্পৃহা মেটাতে চাই। কিন্তু আসল লড়াই মাঠে নেমে সেনাদের লড়তে হয়।
পাকিস্তানের মদতে জঙ্গি হামলার প্রত্যুত্তরে ভারতীয় সেনাবাহিনীর 'অপারেশন সিঁদুর' আসলে পাকিস্তানকে সবক শেখানোর একটি পথ মাত্র। এটাই শেষ পথ নয়।
আরও পড়ুন-সন্ত্রাসের নার্সারি, কাসভকে প্রশিক্ষণ! কেন মুরিদকের মারকাজেই প্রত্যাঘাত ভারতের?
পাকিস্তানের জঙ্গি ঘাঁটিগুলির উপর আক্রমণের পরে পাকিস্তান সরকার কূটনৈতিক উপায়ে এর একটি নিষ্পত্তি করতে পারত। কারণ পাকিস্তানের কোনও সেনা ছাউনিতে ভারতীয় সেনারা প্রথমে কোনও হামলা চালায়নি। যে কাজ পাকিস্তান এতদিন করেনি, সেই কাজ ভারতীয় সেনারা করে এসেছে। জঙ্গি ঘাঁটিগুলি আক্রমণ করেছে। কিন্তু পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির থেকেও এখানে বোধহয় বড় হয়ে উঠেছে পাকিস্তানের সেনা প্রধানের ইগো।
তুরস্ক ও চিনের প্রছন্ন সমর্থন পেলেও আন্তর্জাতিক স্তরে বিশেষ কারও সমবেদনা জোটাতে পারেনি পাকিস্তান। বর্তমান বিশ্বের বহুধা বিভক্ত শক্তিগুলিকে মোটামুটি নিরপেক্ষ অবস্থান নিতে বাধ্য করাকে ভারতীয় কূটনৈতিক সাফল্য হিসেবেই দেখতে হবে। তবু পাকিস্তানি সেনাই — যাদের আধিপত্য পাকিস্তানের প্রশাসন ও রাজনীতির সর্বস্তরে নির্বাচিত সরকারের থেকে অনেক বেশি — ভারতের উপর প্রত্যাঘাত করতে উদ্যোগী হয়েছে।
তবে বহু যুদ্ধ দেখা ভারতের পক্ষে কি দক্ষিণ এশিয়াকে স্থায়ী শান্তির পথে নিয়ে যাওয়া সম্ভব? আসলে ভারতের তরফে শুধু পাকিস্তানের দিকেই বারবার বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেওয়ার পরেও স্থায়ী শান্তির ব্যবস্থা করা যায়নি। ১৯৫০-এর নেহরু ও লিয়াকত আলি খানের চুক্তি থেকে শুরু করে, ১৯৬৬ সালে লালবাহাদুর শাস্ত্রী ও আয়ুব খানের মধ্যে তাসখন্দ ঘোষণা বা ১৯৭২-এ ইন্দিরা গান্ধি ও জুলফিকর আলি ভুট্টোর মধ্যে শিমলা চুক্তি, ১৯৮৫ সালে দক্ষিণ এশিয়ার সাতটি দেশকে নিয়ে সার্ক গোষ্ঠীর গঠন, ১৯৮৮ সালে রাজীব গান্ধি ও বেনজির ভুট্টোর চুক্তি, ১৯৯৯ সালে অটলবিহারী বাজপেয়ীর লাহোর যাত্রা ও নওয়াজ শরিফের সঙ্গে লাহোর ঘোষণাপত্র, এমনকী ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদির শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রীকে আমন্ত্রণ ও ২০১৫ সালে লাহোরে নওয়াজ শরিফের বাড়িতে নরেন্দ্র মোদির আচমকা সফর — যতই বিতর্ক থাকুক, দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা কমানোর চেষ্টা কম হয়নি।
কিন্তু এত শান্তি চেষ্টার পরেও ১৯৪৭-এর দেশ ভাগের স্মৃতি ও তার আনুষঙ্গিক অশান্তি আমাদের কুড়ে কুড়ে খেয়েছে। ধর্মের ভিত্তিতে পাকিস্তান তৈরি করা হোক, দেশভাগ পরবর্তী হিংসা হোক, কাশ্মীরকে নিয়েই হোক বা তার ফলস্বরূপ এ দেশের সাম্প্রদায়িক বিভাজন হোক বা স্বাধীন বাংলাদেশ গঠন করা হোক বা অতি সম্প্রতি বাংলাদেশের পালা বদল — অশান্তি আমাদের পিছু ছাড়েনি।
পূর্ব ও পশ্চিম জার্মানি যেমন নিজেদের মধ্যে পুনর্মিলন ঘটিয়েছে বা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে যেভাবে প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলির বেশির ভাগই নিজেদের মধ্যে (বাণিজ্যিক কারণে হলেও) একটি সমঝোতা করে নিয়েছে, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে তা সম্ভব হয়নি।
তার কারণ শুধুই সামরিক নয়। সেনাবাহিনী তার কাজ করছে। আমরা তাদের কাজ তাদেরই করতে দিই। কিন্তু ভারতীয় উপমহাদেশের সমস্যার স্থায়ী সমাধানের জন্য ও শান্তির পথে যাওয়ার জন্য সামরিক অভিযানের সঙ্গে কূটনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সামাজিক স্তরেও প্রয়োজনীয় এবং কার্যকরী অবস্থান নেওয়া আবশ্যিক। নাহলে প্যালেস্তাইনের মতো পাকিস্তানকে গুঁড়িয়ে দিয়েও শান্তি ফিরবে না।
যতদিন না সামাজিক স্তরে এর সমাধানের জন্য একটি মানসিক প্রস্তুতি নেওয়া শুরু হবে এবং তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক পদক্ষেপ হবে, ততদিন অশান্তি ভিতরে ভিতরে চাপা আগুনের মতো থেকেই যাবে। যদিও এক দিনে বা এক বছরে বা এক সরকারের আমলে সেই অশান্তির সমাধান হয়ে যাবে এমনটা ভাবা অবশ্য মূর্খামি। এটি একটি প্রক্রিয়া। সেই প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে এই উপমহাদেশকে যেতে হবে। সংকীর্ণ রাজনীতির মধ্যে নিজেদের বেঁধে রাখলে বা শুধুই সেনা অভিযানের দিকে তাকিয়ে থাকলে ক্ষতের উপর প্রলেপ পড়বে না।
সেনাবাহিনীর যা কাজ — দেশের উপর আক্রমণকারীদের দমন ও দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা — সে কাজ তারা করবে। করছেও। কিন্তু তাদের কাজ করার পরে, যুদ্ধ-পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে সব স্তরে সেই শান্তির খোঁজ করার চেষ্টা হলেই কিন্তু সেনাবাহিনীকে সত্যিকারের কুর্ণিশ জানানো হবে।