কেন ভারতে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা এলন মাস্কের মাথাব্যথা?

Elon Musk : ভারতের ইউজাররা ৬ জুলাই থেকে রয়টার্সের এক্স হ্যান্ডল-এ ঢুকতে পারেননি। লেখা ছিল, আইনি কারণে ভারতে এই অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

ভারতে সংবাদপত্রে সেন্সরশিপ চলছে, এমনটাই অভিযোগ করেছে ইলন মাস্কের সংস্থা এক্স। যদিও এই অভিযোগ নস্যাৎ করেছে কেন্দ্রীয় সরকার। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক সংবাদসংস্থা রয়টার্সের এক্স হ্যান্ডল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল ভারতে। তারপর থেকেই জল্পনা শুরু হয়েছে। এখানে কেন্দ্রের কোনও ভূমিকা নেই বলে জানিয়েছে মোদি সরকার। তবে বিতর্ক এখনও চলছেই। সংস্থাটির বিবৃতি অনুযায়ী, ‘ভারতে সংবাদমাধ্যমে যে সেন্সরশিপ চলছে তা নিয়ে আমরা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। এক্স-এর পক্ষে এই নির্দেশের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেওয়া কঠিন। কারণ ভারতীয় আইনে আমাদের কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। আইনি পথে সমাধান খোঁজা হচ্ছে।’ কেন্দ্রীয় সরকার আবার পালটা জানিয়েছে, রয়টার্সের মতো আন্তর্জাতিক সংবাদসংস্থাকে ব্লক করার ইচ্ছা ভারত সরকারের নেই। কেন্দ্রীয় সরকারের দাবি, ‘এক্স-এর সঙ্গে লাগাতার আলোচনা চলছে।’

ভারতের ইউজাররা ৬ জুলাই থেকে রয়টার্সের এক্স হ্যান্ডল-এ ঢুকতে পারেননি। লেখা ছিল, আইনি কারণে ভারতে এই অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সংস্থাটির দাবি, ভারত সরকার ৩ জুলাই ২,৩৫৫টি এক্স অ্যাকাউন্ট ব্লক করার নির্দেশ দিয়েছে। তালিকায় রয়টার্স এবং রয়টার্স ওয়ার্ল্ড-ও রয়েছে। এখন প্রশ্ন হল, ভারতে কী সত্যি প্রেস সেন্সরশিপ চলছে?

তথ্য ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় তরফে জানানো হয়েছিল, সমাজ মাধ্যমের যে-কোনো পোস্ট ব্লক করার জন্য মন্ত্রণালয়টি নোটিস ইস্যু করতে একটি ওয়েবসাইট এনেছে। চলতি বছর, মার্চ মাসে এক্স অভিযোগ করেছিল, এই ওয়েবসাইটের মাধ্যমে ভারত সরকার সেন্সরশিপ আনছে। সরকার পক্ষ অপছন্দের কনটেন্ট ইচ্ছে মতো ব্লক করে দিতে পারে বলে অভিযোগ তুলেছিল সংস্থাটি। গত ৫ মার্চ এক্স কর্ণাটকের আদালতেও এই নিয়ে মামলা দায়ের করেছিল। তারা আদালতে বলেছিল, সমাজমাধ্যম সংস্থা হিসেবে এক্স-এর পক্ষে এই আইন মেনে নেওয়া সম্ভব নয়।

আরও পড়ুন- Trump Big beautiful bill: ট্রাম্পের নতুন বিগ বিউটিফুল বিল কী?

গত লোকসভা ভোটের আবহে 'ফ্রি স্পিচ কালেকটিভ' বাকস্বাধীনতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে একটি প্রতিবেদন করেছিল। ২০২৪ সালের মে মাসে প্রকাশিত এই প্রতিবেদনে উঠে এসেছিল, ভারতে ৪ মাসে ১৪৮টি বাকস্বাধীনতা খর্ব হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে রয়েছে, সাংবাদিকদের উপর আক্রমণ, সাংবাদিকদের উপর নির্যাতন, সংবাদমাধ্যমের বিরুদ্ধে আইন, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা হরণ ইত্যাদি। চার মাসে ৩৪জন সাংবাদিকের ওপর হামলার কথাও উঠে এসেছিল এই তদন্তমূলক প্রতিবেদনে। তাঁদের মধ্যে ২০২৪ সালে এখনও ৫ জন সাংবাদিককে গ্রেফতার করা হয়েছিল। তাঁদের মধ্যে আপাতত ৩ জনের জামিন হয়েছে।

'ফ্রি স্পিচ কালেকটিভ'-এর ওই রিপোর্টে কাশ্মীরি সাংবাদিক আসিফ সুলতানের কথাও উল্লেখ ছিল। এই সাংবাদিককে জামিন হওয়ার চার দিন পর পুনরায় গ্রেফতার করা হয়। প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যমগুলি পক্ষপাতদুষ্ট সংবাদ প্রকাশ করছে, এর জন্যও স্বাধীন সংবাদমাধ্যমগুলি বারবার হুমকির মুখে পড়ছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন, 'The Caravan'-এ প্রকাশিত 'Screams from the army post' শিরোনামের প্রতিদিবেদনটি সরিয়ে ফেলার নির্দেশ দিয়েছিল তথ্য এবং সম্প্রচারক মন্ত্রক। এছাড়া সংবাদমাধ্যম 'নিউজক্লিক' এবং তার প্রতিষ্ঠাতা প্রবীর পুরকায়স্থকে গ্রেফতারও করা হয়েছিল।

ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, বিনোদন, সোশ্যাল মিডিয়া, শিক্ষাক্ষেত্রে এবং সংবাদমাধ্যম জুড়ে মোট ৪৬টি সেন্সারশিপ রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ লেখা হয়েছে, অযোধ্যার রাম মন্দির উদ্বোধনের সময় প্রায় শতাধিক সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্ট ব্লক করা হয়েছিল। হরিয়ানার কৃষক আন্দোলনেও একই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল বলে উল্লেখ রয়েছে প্রতিবেদনে। তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৬৯এ ধারায় ২০২৪ সালের ১৪ ও ১৯ ফেব্রুয়ারি কেন্দ্রীয় তথ্য এবং সম্প্রচার মন্ত্রকের নির্দেশে ১১৭ টি সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্ট এবং ওয়েব লিঙ্ক ব্লক করা হয়েছিল। প্রতিবেদনটি উল্লেখ করেছিল, 'মাঙ্কি ম্যান' সিনেমাটি বিশ্ব জুড়ে প্রকাশ পেলেও, ভারতে প্রকাশের অনুমতি পায়নি।

আরও পড়ুন- যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজা থেকে মুনাফা লুটছে মাইক্রোসফট, অ্যালফাবেট?

'ফ্রি স্পিচ কালেকটিভ'-এর প্রতিবেদনে শিক্ষাক্ষেত্রে ২৪ টি বাকস্বাধীনতা খর্ব হওয়ার ঘটনা ঘটেছে বলেও লেখা হয়েছিল। উদাহরণস্বরূপ আলোচিত হয়েছে, মুম্বাইয়ের একটি বিদ্যালয়ের শিক্ষক প্যালেস্টাইনের সমর্থনে ট্যুইট করেছিলেন বলে তাঁর উপরও হামলা করা হয়েছিল। এছাড়া, 'রাম কে নাম ' তথ্যচিত্র প্রদর্শনের জন্য হামলার কথাও বলা হয়েছে। এই তথ্যচিত্র প্রদর্শনের জন্যই টাটা ইন্সটিটিউট অফ সোশ্যাল সায়েন্সেস-র ক্যাম্পাস থেকে পিএইচডি স্কলার রামদাস-কে দু-বছরের জন্য সাসপেন্ড করা হয়। এ তথ্যও জানা যায় যে, মোদি সরকারের সমালোচনা করায় 'Bolta Hindustan' নামের ইউটিউব চ্যানেলটি বন্ধ করে দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল।

উত্তরাখণ্ড, বাকস্বাধীনতা হননের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে। রিপোর্ট অনুযায়ী, এই রাজ্যে ১০টি ক্ষেত্রে বাকস্বাধীনতা খর্ব করা হয়েছে। এরপরেই রয়েছে হরিয়ানার নাম। হরিয়ানা, ইন্টারনেট অবরোধের তালিকায় শীর্ষ। কৃষক আন্দোলনের সময় এই রাজ্যে ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ করা হয়েছিল। তারপরেই রয়েছে পঞ্জাব এবং মণিপুরের নাম। এই রাজ্যগুলিতে পরিস্থিতি সামাল দিতে ইন্টারনেট সংযোগ অবরুদ্ধ করা হয়েছিল। যদিও ২০২৩ সালে মণিপুরে, মে থেকে ডিসেম্বর দীর্ঘ সময় ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ করেছিল সরকার।

প্রসঙ্গত, আগেও বহুবার সাংবাদিকদের উপর আক্রমণ নিয়ে অভিযোগ উঠেছে নরেন্দ্র মোদি সরকারের বিরুদ্ধে। অভিযোগ, উপযুক্ত কারণ ছাড়াই সংবাদমাধ্যম 'নিউজক্লিক' এবং 'বিবিসি'-তে একাধিকবার অভিযান চালায় কেন্দ্রের অধীনে থাকা তদন্তকারী সংস্থাগুলি। পরাধীন ভারতে ব্রিটিশ সরকার বিনা বিচারে ভারতীয়দের জেলে বন্দি করে রাখত। ১৮৯১ সালে 'বঙ্গবাসী' পত্রিকার সম্পাদক রামচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়কে রাষ্ট্রদ্রোহিতার সাথে সংযুক্ত আইনে গ্রেফতার করা হয়েছিল।

'প্রেস ফ্রিডম' তালিকায় ভারতের অবস্থান প্রতিবেশী পাকিস্তান ও বাংলাদেশ-সহ গৃহযুদ্ধে বিধ্বস্ত একাধিক দেশেরও নীচে নেমে গিয়েছে। বর্তমান শাসকগোষ্ঠী প্রায় সর্বত্রই নিজের সঙ্গে পাকিস্তানের তুলনা টানে। কিন্তু নেতারা হয়তো ভুলে যান, বাস্তব চাপা দিতে গিয়ে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে পাকিস্তানের থেকেও পিছিয়ে যাচ্ছি আমরা। বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ ভারত। দেশের সংবিধানে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা মৌলিক অধিকার। তা সত্ত্বেও কেন বারে বারে ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা কেড়ে দেওয়া, শিক্ষা ক্ষেত্রেও স্বাধীনতায় আঘাত করার ঘটনা ঘটছে? প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, দেশে যদি গঠনমূলক সমালোচনা করার পরিস্থিতি না থাকে, সরকার পক্ষ যদি এখনও বিরোধীদের কন্ঠরোধই করতে থাকে তবে স্বাধীনতার আগে এবং পরের পরিস্থিতির পার্থক্য ঠিক কোথায়?

More Articles