বিদেশে মানুষের নিত্য ভরসা, অথচ কলকাতায় কেন বাতিল সাধের ট্রাম?
Kolkata Tram: আমাদের শহরে মেট্রো সম্প্রসারণ হয়, কিন্তু ট্রাম লাইন সম্প্রসারণের কথা ভাবা হয় না।
অদ্ভুত সমাপতন। ডাবলিনে নিজের অফিসগামী ট্রামে বসে নিউজ স্ক্রোল করতে গিয়ে কলকাতার ট্রাম বন্ধ হওয়ার খবর পেলাম। হাতে-টানা রিকশা, হলুদ ট্যাক্সি, ট্রাম— কলকাতার গণপরিবহনের প্রতীক হয়ে উঠে আসে বারবার। দেখলাম, সোশ্যাল মিডিয়াতে বহু মানুষ ট্রাম নিয়ে নস্টালজিক। কিন্তু যা কিছু পুরনো, যা কিছু ঐতিহ্য সবই কি ভালো? নিশ্চয়ই না। এই কথা অস্বীকার করার কোনও জায়গা নেই যে, কলকাতা শহরের গণপরিবহনের প্রতীক হিসাবে থেকে যাওয়া ছাড়া ট্রাম তার বর্তমান অবয়ব নিয়ে শহরের মানুষের রোজের যাতায়াতে বিশেষ কোনও সুরাহা দিতে পারছিল না। না ছিল সঠিক পরিকঠামো, না ছিল যথেষ্ট সংখ্যক ট্রাম এবং রুট, না সঠিক সময়সূচি।
উল্টোদিকে, বর্তমানে যে শহরে বাস করি, আমি নিজে শহরের মূলকেন্দ্রে না থেকেও রোজ শহরে কাজ করতে যাই ট্রামেরই ভরসায়। এই শহরের জন-ঘনবসতি অনুযায়ী ঠিক করা আছে ট্রামের ফ্রিকোয়েন্সি। যদিও কখনই সেটা ১০-১৫ মিনিটের বেশি হয় না। বহু চেনা মানুষ শহর থেকে বেশ খানিক দূরে নিজেদের স্থায়ী বাসস্থান গড়ে তুলছেন এই কথা মাথায় রেখে যে, এখানকার সরকার খুব শীঘ্রই ট্রাম লাইনের প্রসারণ ঘটাবে। অথচ ডাবলিনে ট্রাম ব্যবস্থা শুরু হয়েছে মাত্র ২০ বছর আগে। শুধু ডাবলিন না, ইওরোপের কত শহরে ঘুরতে গিয়ে দেখি ট্রাম দিয়ে মোড়া গোটা শহর। প্রাগ, অস্ট্রিয়া, বুদাপেস্ট, আমস্টারডাম— পৃথিবীর বিভিন্ন শহরে ছড়িয়ে থাকা পরিচিতদের মুখে শুনি, তাদের রোজের যাতায়াতের জন্য ট্রামের উপর নির্ভরতার কথা।
আরও পড়ুন- ১ পয়সা ভাড়া বৃদ্ধির প্রতিবাদে কেঁপেছিল কলকাতা, ট্রামের মতোই ম্রিয়মাণ বাম আন্দোলন?
আধুনিক শহরগুলোতে ট্রামের এই জনপ্রিয়তার কারণ সেখানের প্রশাসন ট্রামকে যেমন পরিবেশবান্ধব যানবাহন হিসাবে মডেল করেছে, তেমনই সেটাকে যাত্রীদের সুবিধার্থে কীভাবে ব্যবহার করা যায় তার জন্যও সঠিক পরিকল্পনা করেছে। বর্তমান সময়ে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সংকট পরিবেশ। সব দেশ উঠে পড়ে লেগেছে কার্বন ফুটপ্রিন্ট কমানোর জন্য। এখানেই ট্রামকে গণ পরিবহন হিসাবে ব্যবহার করার সবচেয়ে বড় উপযোগিতা। ট্রাম বিদ্যুৎ দ্বারা চালিত হয় এবং এই দেশগুলোতে ধীরে ধীরে বিদ্যুৎ উদপাদনের জন্য কমছে কয়লার ব্যবহার। আর গণ যানবাহনের সঠিক পরিকাঠামো থাকলে মানুষের নিজের গাড়ি ব্যবহারের প্রবণতা কমে। সবুজ পরিবেশ গড়ে তোলার এইগুলোই তো প্রাথমিক ধাপ। এবার প্রশ্ন, কলকাতার মতো ঘন জনবসতি পূর্ণ জায়গায় কতটা সম্ভব এরকম মডেল তৈরি করা?
কলকাতার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য গণ-যানবাহন হলো বাস। একটি বাসে যেখানে ৭০ -৮০ জন মানুষ ধরে, সেখানে একটি ট্রামে ধরে ২০০-র বেশি মানুষ। ট্রামগুলি প্রায় ৮ কিমি/ঘণ্টা গতিতে চলে, যেখানে বাসের গড় গতি ৯.৫ কিমি/ঘণ্টা। যদি ট্রাম লাইনগুলোকে রিজার্ভ করা যায়, ট্রামের গতি হতে পারে প্রায় ১৬কিমি/ঘণ্টা। অর্থনৈতিক বিনিয়োগ ধরলে, গোটা ট্রাম ব্যাবস্থার পুনর্গঠন এবং পুনর্বিন্যাস করার প্রাথমিক ব্যয় বাসের তুলনায় হয়তো বেশি এবং ট্রামের পরিকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণও ব্যয়বহুল, তবে ট্রামগুলির অপারেশনাল খরচও কম। যদি আমরা বাসের সঙ্গে তুলনা করি এবং রাস্তাগুলির রক্ষণাবেক্ষণের খরচ যোগ করি, বাস পরিচালনার মোট খরচ ট্রামগুলির চেয়ে বেশিও হতে পারে। সবচেয়ে বড় কথা দীর্ঘমেয়াদে ট্রাম ব্যাবস্থার পরিবেশগত এবং অর্থনৈতিক সুবিধা— প্রারম্ভিক ব্যয়কে ছাড়িয়ে যায়।
আরও পড়ুন- মৃত্যুপথযাত্রী ট্রাম, ১৪৯ বছর বাঙালির ওঠাপড়া ভাঙাগড়ার সাক্ষী যে যান
বিশ্ব ব্যাঙ্কের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতি বছর বায়ু দূষণের কারণে কলকাতায় ১০,০০০ জনেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়। এরকম একটা সময়ে দাঁড়িয়ে পরিবেশবান্ধব ট্রাম ব্যাবস্থাকে তুলে দেওয়া বর্তমান প্রশাসনের দূরদর্শিতারই অভাব । আগামী দিনে আমাদের দেশকেও ভাবতে হবে কীভাবে পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তির ব্যাবহার বাড়ানো যায়। ভাবতেই হবে, অবশ্যম্ভাবী। ভবিষ্যতে বিকল্প উৎস থেকে বিদ্যুৎ তৈরির জন্য গোটা পৃথিবী জুড়েই চলছে গবেষণা এবং পরিকল্পনা। এমতাবস্থায় ট্রাম, যা কিনা বিদ্যুতে চালানো যায় সেরকম পরিকাঠামোর ভিত্তি থাকার পরেও তা তুলে দেবার সিদ্ধান্ত একধরনের হঠকারিতা। আমাদের শহরে মেট্রো সম্প্রসারণ হয়, কিন্তু ট্রাম লাইন সম্প্রসারণের কথা ভাবা হয় না। বাড়ানোই যেত ট্রামের সংখ্যা, যাতে ট্রাম পাওয়ার সুযোগ নিয়ে মানুষকে ভাবতে হতো না। প্রয়োজনে বিদেশ থেকে আনা যেত উন্নত মডেলের ট্রাম অথবা নিজেদের রাজ্যেই খোলা যেত নতুন শিল্প। সঠিক পরিকল্পনার মধ্যে দিয়ে ট্রাম লাইন, বাস লাইন আলাদা করে দেওয়া যেত এবং তাতে আরও ভালোভাবে ট্রাফিক পরিচালনা করা যেত। কিন্তু সেসব উদ্যোগ নেওয়ার এবং কার্যকরী করার ভাবনা তো প্রশাসনের পক্ষ থেকে দেখাই গেল না। কেন এবং কার স্বার্থে, সেসব প্রশ্নও চাপা পড়ে যাবে। ব্যাক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে জানি, রাজ্যে বহু মেধা এবং টাকা খরচ হয় পৃথিবীর বাইরে স্পেস স্টেশন পাঠানো যাবে কিনা সেইসব সংক্রান্ত গবেষণায়। সেই গবেষণার প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করে নিয়েই প্রশ্ন থাকে, কিছু বাজেট, কিছু সময়, কিছুটা মেধা কি কলকাতা মেট্রোর পুনঃসংস্করণের জন্যও বরাদ্দ করা যেত না? প্রশাসনের অক্ষমতা তো বটেই, দায় আমাদের নাগরিক সমাজেরও।
আমরা হারালাম আমাদের ১৫০ বছরের ঐতিহ্য, আর পেলাম পরবর্তী প্রজন্মকে আরও খানিক দূষিত বাতাস দেওয়ার দায়ভার। অনেক বছর পর কলকাতার পাশে মফসসলে বড় হওয়া আমি গল্প বলব কোনও এক শিশুকে, বাবা একদিন নতুন ফ্রক, পায়ে মোজা-জুতো পরিয়ে নিয়ে গিয়েছিল ট্রাম চড়াতে। সুখের স্মৃতি সঞ্চারিত করা সহজ, যদিও আমাদের বিশুদ্ধ পরিবেশ দিয়ে যাবার অঙ্গীকার ছিল!