পহেলগাঁও হামলার মূল অভিযুক্ত ও ভুক্তভোগী আসলে একই
Pahalgam Incident: মালেগাঁও বিস্ফোরণ যদি সংগঠিত জঙ্গি কার্যকলাপ হয়, তবে আরপিএফ জওয়ানের ট্রেনে বেছে বেছে মুসলমান যাত্রীদের হত্যা করা অসংগঠিত জঙ্গি কার্যকলাপ হিসেবেই দেখা উচিত।
গত কয়েকদিন ধরে না তো সোশ্যাল মিডিয়ার টাইমলাইন, না টিভি চ্যানেল — কোনও দিকেই তাকানো যাচ্ছে না। একেই তো পহেলগাঁওয়ের জঙ্গি হামলার ভয়ঙ্কর ছবি ঘুরে বেড়াচ্ছে নেট জুড়ে। সঙ্গে মৃতের আত্মীয় পরিজনেরা তাঁদের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা শোনাচ্ছেন। কীভাবে তাঁদের আলাদা করে বেছে বেছে পুরুষদের হিন্দু ধর্ম পরিচয় জেনে একে একে গুলি মেরেছে হামলাকারীরা, কীভাবে তাঁরা বেঁচে ফিরেছেন। এই ছবি দেখলে বা পরিজনদের কথা শুনলে চোখে জল চলে আসে। আবেগতাড়িত হই।
আর অন্যদিকে আরেক সমস্যা! এই ভয়াবহ ঘটনার জন্য মুসলমান সম্প্রদায়কে দায়ী করে একের পর এক পোস্ট সামাজিক মাধ্যম জুড়ে। হিন্দু জাগরণের আহ্বান। গাজায় ইজরায়েলের মতো হত্যালীলার দাবি। সঙ্গে আরও বহু বিভাজনকারী আলেখ্য। অভিযোগ ও পাল্টা অভিযোগ। এক দমবন্ধ করা পরিবেশ। কারও সঙ্গে শান্ত হয়ে দু'দণ্ড কথা বলার অবকাশ নেই। প্রায় সবাই মারমুখী। পোস্টের বয়ানের এদিক কিংবা ওদিক মন্তব্য হলেই ঝামা ঘষে দেওয়া হবে।
তবে এই জঙ্গি হামলার সবচেয়ে বড় অভিযুক্ত মনে হচ্ছে 'ধর্মনিরপেক্ষতা'!
আরও পড়ুন- মুর্শিদাবাদ: হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে কাঁটাতারের বেড়া আর কি কাটা যাবে না?
অস্বীকার করার উপায় নেই ৯০ দশকের পর থেকে এখন পর্যন্ত ভারতীয় রাজনীতির ও সামাজিক ঘটনার পরম্পরায় ধর্মনিরপেক্ষতা শব্দটি কলুষিত হয়ে গেছে। তার আসল কারণ নিরপেক্ষতা শব্দটিই জোলো হয়ে গেছে এই আবহে। হয় আপনি এদিকে অথবা ওদিকে। কোনও দিক-নিরপেক্ষ অবস্থান আপনি নিতেই পারেন না। একটি ঘটনার যে বিভিন্ন স্তর থাকতে পারে, এই ধারণাটিই মুছে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে।
ঠিক তেমনভাবেই ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণাকে লঘু করে, কংগ্রেসি ঘরানার বা সমাজতান্ত্রিক দলগুলির মুসলমান তোষণের দৃষ্টান্ত দেখিয়ে ধর্মনিরপেক্ষতাকে আসলে 'মুসলমান তোষণ'-এর সঙ্গে এক করে দেওয়া হয়েছে।
যদি ধরেই নিই যে ধর্মনিরপেক্ষতা এবং মুসলমান তোষণ সমার্থক, তাহলেও কি বলা যায় যে মুসলমান তোষণই কাশ্মীরের বর্তমান জঙ্গি সমস্যা ও পহেলগাঁও জঙ্গি হামলার একমাত্রিক কারণ?
এটা ঠিক যে পহেলগাঁওর অভিযুক্ত জঙ্গিরা ধর্ম পরিচয়ে মুসলমান এবং তারা বেছে বেছে ধর্ম পরিচয়ে হিন্দুদের মেরেছে। কিন্তু তার সঙ্গে স্থানীয় পর্যটন ব্যবসার উপর যাঁদের রুটি-রুজি নির্ভর করে তাঁদেরও ভাতে মেরেছে। সেই স্থানীয়রা কিন্তু ধর্ম পরিচয়ে মুসলমান। তাঁদেরও একপ্রকার মরেই বেঁচে থাকতে হবে এখন। যদি ধর্ম পরিচয়েই পুরো ঘটনাকে দেখতে হয়, তাহলে এভাবেই দেখা উচিত নয় কি?
কাজেই যদি এটা ভেবে নিই যে, সাধারণ মুসলমান উপত্যকাবাসীদের যা হয়েছে বেশ হয়েছে তাহলে সেটা একটি জটিল বিষয়। ধর্মের লেন্স দিয়ে দেখতে গেলে পুরো বিষয়টিই কিন্তু আরও গুলিয়ে যাবে!
ইসলামের নামে এই ধরনের জঙ্গি কার্যকলাপ নতুন নয়। তা অত্যন্ত নিন্দনীয় এবং ন্যক্কারজনক। এই জঙ্গিদের বাড়বাড়ন্তে সারা বিশ্ব জুড়ে লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রাণ গেছে। মুসলমান অধ্যুষিত আরব দেশগুলিতে মুসলমানেরাই বেশি সংখ্য়ায় মরেছে। কাজেই ধর্মের নামে যে কোনও নৃশংস কর্মকাণ্ডই ধিক্কারযোগ্য। তার জন্য যথাযথ প্রশাসনিক এবং সুরক্ষা ব্যবস্থা জরুরি।
কিন্তু রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ফায়দা লুটতে গিয়ে এবং সুরক্ষা ও প্রশাসনিক ব্যবস্থার গাফলতি ঢাকতে যদি ধর্ম পরিচয়েই শুধু মানুষে মানুষে লড়িয়ে দেওয়া হয়, তাহলে হিন্দু বা মুসলমান নয় 'মানুষ'-ই মরে।
পহেলগাঁওয়ের ঘটনায় ইসলামের নামে উগ্রপন্থার কড়া মোকাবিলা হোক। কিন্তু তার নামে হিন্দু-জাতীয়তাবাদের জিগির তোলার পরিণতি অন্যরকম হবে। আর ঠিক সেটাই হচ্ছে। যে ভাবে 'হিন্দু শহিদ'-দের নামে স্লোগান উঠছে। যেভাবে পাকিস্তানকে ধুলোয় মিশিয়ে দেওয়ার বা গাজার উপর ইজরায়েলি আক্রমণের মতো দাবি উঠছে, তাতে মানুষে মানুষে বিভেদ আরও বাড়ছে। সবার জন্যই বিপদ বাড়ছে।
যাঁরা এই জঙ্গি হানার জন্য শুধুই 'ধর্মনিরপেক্ষতা'-কে কাঠগড়ায় তুলছেন, তাঁরা আসল অপরাধীদের ছেড়ে একটি সামাজিক বিভাজনের দিকে দেশকে আরও এগিয়ে দিচ্ছেন। কারণ, যে মানুষটি পহেলগাঁওয়ের বীভৎস জঙ্গি হামলার উদাহরণ দিয়ে হিন্দু জাতীয়তাবাদের কথা বলছেন, তিনি আসলে ধর্ম পরিচয়ে মুসলমান সাধারণ সহ-নাগরিককেও জঙ্গি হিসেবে চিহ্নিত করছেন। সমস্যাটি ঠিক এই জায়গাটিতেই।
অনেকেই লিখছেন দেখলাম, হিন্দুরা তো বন্দুক হাতে নিয়ে মুসলমানদের হত্যা করছে না! ঠিকই। যে হারে ইসলামকে কেন্দ্র করে সংগঠিত জঙ্গি কার্যকলাপের উদাহরণ আমাদের সামনে রয়েছে, সেই পরিমাণে হিন্দু জঙ্গি কার্যকলাপ আমরা দেখি না। তার মানে এই নয় যে, আমরা হিন্দুদের ক্রোধকে আরও ভুল পথে চালিত করছি না।
মালেগাঁও বিস্ফোরণ যদি সংগঠিত জঙ্গি কার্যকলাপ হয়, তবে আরপিএফ জওয়ানের ট্রেনে বেছে বেছে মুসলমান যাত্রীদের হত্যা করা অসংগঠিত জঙ্গি কার্যকলাপ হিসেবেই দেখা উচিত। সঙ্গে প্রচণ্ড মুসলমান বিদ্বেষ থেকে সুল্লি বাইয়ের মতো অ্যাপ তৈরি করে মুসলমান মহিলাদের সামাজিক হেনস্থার ঘটনা তো আছেই। যেখানে যুবক ও যুবতীরা যুক্ত ছিলেন। অভিযুক্তদের মধ্যে একজন বলেছিলেন, তিনি টিভির খবর দেখেই মুসলমানদের প্রতি বিক্ষুব্ধ হয়েছিলেন।
আরও পড়ুন- পুলিশের নজর এড়িয়েই বৈসরনে পর্যটকরা! নিরাপত্তার যে যে গাফিলতি স্বীকার কেন্দ্রের
যদি কেউ ভেবে থাকেন এই ধরনের ঘটনা বাড়িয়ে মুসলমান জঙ্গিদের শিক্ষা দেবেন, তার থেকে বড় মূর্খামি আর বোধহয় হয় না। ইসলামি জঙ্গির উত্তর হিন্দু জঙ্গি হতে পারে না। জঙ্গিদের দমন করার দায়িত্ব সরকার ও প্রশাসনের উপর ছেড়ে দিন। তারা যাতে ঠিক কাজ ঠিক ভাবে করে সেদিকে খেয়াল রাখুন। শুধু নিজেরা একে অন্যের উপর ধর্মের নামে হিংসা বাড়িয়ে নিজেদের রক্তচাপই বাড়াব। একদিন নিজেরাও এই ধর্ম-হিংসার বলি হয়ে যাব।
আর যাঁরা গাজার মতো প্রতিশোধ চাইছেন, তাঁরা আসলে শুধু গাজা শব্দটির সঙ্গে পরিচিত। আর জানেন সেখানে মুসলমানদের বাস ছিল। কিন্তু কত হাজার হাজার শিশুকে সেখানে নির্বিচারে হত্যা করা হলো, কত অসুস্থ মানুষকে সেখানে ওষুধটুকু মুখে তুলতে দেওয়া হলো না — সেটা তাঁরা জানেন না বা জেনেও জানেন না। ভারতবর্ষের কোনও একটি রাজ্যে যদি এমনটা নরমেধ অভিযান হয়, তাহলে কারও কারও মনের মধ্যে জমে থাকা ঘৃণার উপশম হয় বটে কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে কারও কারও মনের মধ্যে আরও ঘৃণার উদ্রেক করে।
আর রইল পড়ে ধর্মনিরপেক্ষতা। ভারতীয় সংবিধান না মানলে অন্য কথা। সে মাওবাদীরাও মানে না। কিন্তু যদি বহুমাত্রিক একটি দেশের সংবিধান মানতে হয়, তাহলে সেখানে লেখা ধর্মনিরপেক্ষতার সংজ্ঞা বুঝতে হবে। মানতেও হবে। যার যার নিজের ধর্ম পালনের অধিকার এই দেশে রয়েছে। আর আপনি আস্তিক হন, নাস্তিক হন, হিন্দু হন, মুসলমান হন বা খ্রিস্টান — প্রত্যেকের পছন্দকে সম্মান করে চলতে হবে। ধর্মের নামে কোনও পক্ষেরই একে অন্যের উপর বেয়াদপি চলবে না। সেই বেয়াদপিরও সংবিধান অনুযায়ী ব্যবস্থা হোক।
পহেলগাঁওয়ের ঘটনার পর যদি ধর্মনিরপেক্ষতা শব্দটি সংবিধান থেকে তুলে দিতে চান, তবে মনুষ্যত্ব শব্দটিও অভিধান থেকে তুলে দিন। তার পরে একে অন্যের সঙ্গে ধর্ম পরিচয়ে লড়তে থাকুন। আপনি ভাববেন সমাজ বদলে দেবেন। পারবেন না। ধর্মের নামেই ফায়দা কিন্তু অন্য কেউ তুলে নিয়ে যাবে।
আসলে পহেলগাঁও হামলার মূল অভিযুক্ত ও ভুক্তভোগী একই — ধর্মনিরপেক্ষতা।