ট্রাম্প-নেতানিয়াহু যৌথ হামলা! পরমাণু প্রকল্প বন্ধ রাখবে ইরান?
Iran-Israel Conflict: ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু ইরানের ওপর হামলার পরিকল্পনা করেছিলেন। কিন্তু ট্রাম্প তাঁকে থামিয়ে মার্কিন হামলার নির্দেশ দেন।
দিন কয়েক আগের ঘটনা। গোটা বিশ্বকে চমকে দিয়ে ইরানের পরমাণু গবেষণাকেন্দ্রে হামলার নির্দেশ দিয়েছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। এই হামলায় ইরানের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ পরমাণু কেন্দ্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ট্রাম্প দাবি করছিলেন, এই হামলায় ইরানের পরমাণু অস্ত্র তৈরির ক্ষমতা পুরোপুরি ধ্বংস হয়েছে। তবে ট্রাম্পের দাবি উড়িয়ে দিয়ে তেহরান জানিয়ে দেয়, হামলার আগেই তারা সব সরঞ্জাম সরিয়ে নিয়েছিল। এই অবস্থায় প্রশ্ন উঠছে, ইজরায়েল-মার্কিন আগ্রাসন কতটা ধাক্কা দিতে পারল ইরানকে? ইরান কি পরমাণু প্রকল্প গুটিয়ে নেবে?
মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলো বলছে, এই হামলা ইরানের পরমাণু কর্মসূচি কয়েক মাস পিছিয়ে দিতে পারে। তবে এটুকুই। প্রকল্প স্থগিত হবে এমন কোনও ইঙ্গিত নেই। এই হামলায় দু'টি পরমাণু কেন্দ্রের প্রবেশপথ বন্ধ হয়েছে, তবে ভূগর্ভস্থ কাঠামো অক্ষত রয়েছে।
ইরান এই হামলার জবাবে জাতিসংঘের পরমাণু পরিদর্শকদের সঙ্গে সহযোগিতা বন্ধ করেছে। ইরান এখন তাদের পরমাণু কার্যক্রম গোপন জায়গায় সরিয়ে নিতে পারে বলে আশঙ্কা করছে তামাম আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা বলছেন, ইরান তাদের সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের ভান্ডার ব্যবহার করে পরমাণু বোমা তৈরির চেষ্টা ত্বরান্বিত করতে পারে। সে কথা মাথায় রেখেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইজরায়েল ইরানের কার্যক্রমের ওপর কড়া নজর রাখছে।
আরও পড়ুন- ইরানের পারমাণবিক ঘাঁটিগুলির কতটা ক্ষতি হয়েছে?
পাশাপাশি, ট্রাম্প প্রশাসন মার্কিন পরমাণু অস্ত্রাগারের বরাদ্দ বাজেট বাড়িয়েছে। জাতীয় পরমাণু নিরাপত্তা প্রশাসনের বার্ষিক বাজেটে ৫৫০ কোটি ডলার বাড়ানো হয়েছে। এর ফলে মোট সামরিক বাজেট ২৫০০ কোটি ডলারে গিয়ে ঠেকেছে। এই অর্থ পুরনো যুদ্ধাস্ত্র আধুনিকীকরণ, নতুন অস্ত্র তৈরি এবং ৩০০০-এর বেশি পরমাণু যুদ্ধাস্ত্র প্রস্তুত রাখতে ব্যবহার হবে। তবে, এই বাজেট বাড়ানোর জন্য বৈজ্ঞানিক গবেষণার তহবিল কমানো হয়েছে। এই সিদ্ধান্ত নিয়ে সারা বিশ্ব উদ্বেগ প্রকাশ করছে। বিজ্ঞান গবেষকরা বলছেন, সামরিক এবং অন্যান্য গবেষণার মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখা জরুরি। বিজ্ঞানের দ্বাররুদ্ধ করে সমরাস্ত্রে মনোযোগ সভ্যতার সূচক নয়।
ট্রাম্প যে পরমাণু অস্ত্র নিয়ে ভাবিত তার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্দরেই। বছরের শুরুতে ট্রাম্প প্রশাসন জাতীয় পরমাণু নিরাপত্তা প্রশাসনের কিছু কর্মীকে বরখাস্ত করেছিল। পরে তড়িঘড়ি তাদের আবার নিয়োগ করা হয়। এই ঘটনা সামনে আসছে এখন। এই সংস্থা মার্কিন পরমাণু অস্ত্রের দেখভালের জন্য কাজ করে। ৫৫ হাজারের বেশি কর্মীর কাজ তদারকি করে।
উল্লেখ করা জরুরি, ট্রাম্পের ইরান নীতি আন্তর্জাতিক মঞ্চের পাশাপাশি তাঁর নিজের দেশেও বিতর্ক তৈরি করেছে। প্রশ্ন উঠছে, কেন আগ বাড়িয়ে ট্রাম্প এ কাজ করলেন, কেন কোনও আলাপ আলোচনা করলেন না। ফোর্ডো, নাতাঞ্জ এবং ইসফাহানে হামলায় তাঁর নির্দেশেই বি-২ বোমারু বিমান এবং একটি সাবমেরিন থেকে ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে। ট্রাম্প ওসামা বিন লাদেনের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে এই হামলার তুলনা করেন। তিনি বলেন, ইরান আর পরমাণু অস্ত্র তৈরি করতে পারবে না। তবে গোয়েন্দা প্রতিবেদন বলছে, এই দাবি যথাযথ নয়। ট্রাম্পের আক্রমণ ইরানের পরমাণু কর্মসূচিকে শুধু কিছুটা পিছিয়ে দিয়েছে।
আরও পড়ুন- ইরান থেকে ট্রাম্প, নেতানিয়াহু আসলে কী চান?
ট্রাম্প কিন্তু প্রথমে ইরানের সঙ্গে কূটনীতির পথে হাঁটতে চেয়েছিলেন। গত ফেব্রুয়ারিতে তিনি ইরানের সঙ্গে নতুন পরমাণু চুক্তির কথা বলেছিলেন। তিনি ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনির কাছে চিঠি লিখে আলোচনার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তবে ২০১৫ সালের পরমাণু চুক্তি থেকে ট্রাম্প বেরিয়ে যাওয়ায় ইরান এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। ইরান বলে, তারা অসামরিক পরমাণু শক্তির অধিকার চায়। তারা আরব দেশগুলোর সঙ্গে যৌথ পরমাণু প্রকল্পের প্রস্তাব দিয়েছে। বলাই বাহুল্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই প্রস্তাব নাকচ করেছে।
আবার, এই যুদ্ধের আবহে ইজরায়েলের সঙ্গে ট্রাম্পের সম্পর্কেও টানাপড়েন দেখা দিয়েছে চলমান ঘটনাপ্রবাহকে কেন্দ্র করে। ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু ইরানের ওপর হামলার পরিকল্পনা করেছিলেন। কিন্তু ট্রাম্প তাঁকে থামিয়ে মার্কিন হামলার নির্দেশ দেন। এই ঘটনায় দুই নেতার মধ্যে মতপার্থক্য দেখা দিয়েছে। ইজরায়েল এবং ইরানের মধ্যে অস্থায়ী যুদ্ধবিরতি এখনও বহাল। তবে দুই পক্ষই আরও হামলার হুমকি দিয়েছে। এই সংঘাত বিশ্ব বাণিজ্যে প্রভাব ফেলছে। হরমুজ প্রণালীর মাধ্যমে তেল পরিবহণ ব্যাহত হচ্ছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সাধারণ মানুষের মধ্যে ট্রাম্পের এই নীতি নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। তাঁর সমর্থকরা বলছেন, এই হামলা ইরানকে পরমাণু অস্ত্র তৈরি করা থেকে দূরে ঠেলে দেবে। তারা মনে করেন, এটি ইজরায়েল এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যৌথ নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে। তবে একটা বড় অংশই ট্রাম্পের বিরুদ্ধে সরব। এই পদক্ষেপ বিশ্বে উত্তেজনা বাড়াবে, এ কথা না মেনে উপায় নেই। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বৃদ্ধি এবং অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক সমস্যায় জেরবার মার্কিন নাগরিকসমাজ এই সংঘাতকে অপ্রয়োজনীয় মনে করছেন।
মনে রাখতে হবে, ট্রাম্পের পরমাণু নীতি শুধু ইরানেই সীমাবদ্ধ নয়। ট্রাম্প বলছেন, মার্কিন অস্ত্রের ভাঁড়ারে টান পড়েছে। ন্যাটো মিত্রদের প্রতিরক্ষা ব্যয় বাড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। তাঁর প্রশাসন আমেরিকার জন্য একটি নতুন ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তৈরির কথা বলছে। পাশাপাশি পরমাণু অপ্রসারণ প্রকল্পের তহবিল হ্রাস করা হয়েছে। এই পদক্ষেপ নিয়েও লাগাতার বিতর্ক চলছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইরানে হামলা তেহরানের পরমাণু অস্ত্র তৈরির প্রচেষ্টা বন্ধ করতে পারবে না। বরং এই অতি-তৎপরতা দক্ষিণ কোরিয়া বা জাপানের মতো দেশগুলোকে নিজেদের পরমাণু অস্ত্র তৈরির দিকে ঠেলে দিতে পারে। তারা মনে করেন, মার্কিন নিরাপত্তাই এতে দুর্বল হচ্ছে। উত্তর কোরিয়ার উদাহরণ টেনে তারা বলছেন, পরমাণু অস্ত্র থাকলে কোনও দেশকে সহজে আক্রমণ করা যায় না। ট্রাম্পের এই পদক্ষেপের দীর্ঘমেয়াদি ফলাফল এখনও স্পষ্ট নয়। আশা নিরাশার দোলাচলে দুলছে গোটা বিশ্ব।