যাত্রার প্রেমে জীবন দিয়েছেন ব্রজেন্দ্রনাথ, বাঙালি কি ভুলল তাঁকে!

যাত্রা' শব্দটির অর্থ 'গমন।' বেশ কিছু গবেষকদের মতে প্রাচীনকালে কোন দেবতার উৎসবকে উপজীব্য করে যে নৃত্যগীতপূর্ণ শোভাযাত্রা অনুষ্ঠিত হতো তাকেই ' যাত্রা' বলে অভিহিত করা হতো তৎকালীন সময়ে। বাংলা সংস্কৃতির অন্যতম ধারক- বাহক হিসেবে যাত্রার আগমন ঠিক কবে সে সম্পর্কে গবেষকগণ সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারেননি, তবে এরই সঙ্গে এ কথা সম্পর্কে সকল গবেষকই নিঃসন্দেহ যে বঙ্গীয় সংস্কৃতির নিরিখে যাত্রার ধারাটি যথেষ্ট সুপ্রাচীন।বঙ্গীয় সংস্কৃতির ক্ষেত্রে যাত্রা চৈতন্যদেবেরও বহু আগে থেকে প্রচলিত ছিল, তার নিদর্শন মেলে 'চৈতন্যভাগবত' গ্রন্থে। শিবের উৎসব, কৃষ্ণ উৎসবের মধ্য দিয়ে যাত্রার ধারাক্রমিক বিবর্তন ঘটে।

শমীক বন্দ্যোপাধ্যায় -এর মতো গবেষকের মতে - " Jatra, the traditional theatre of Bengal, was of course available to everyone, but the rising middle classes of calcutta, which had come to favour western forms of art, regarded it as a corrupt, and indecorous entertainment. Jatra, complained the middle - class audiences, followed neither the classical sanskrit definitions of drama, nor the newly fashinable western models. Jatra was two - third song;the dialogue, impraeeised during the performance by illiterate players, had no literary distinction... Jatra used no scenery or permanent stage. 

যাত্রা গবেষকরা ১৮৪০ সালকে যাত্রার ইতিহাসে মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। কারণ গবেষকদের মতে এই সময় থেকেই ধর্মনিরপেক্ষ যাত্রার উদ্ভব। এর পূর্বে যাত্রার ক্ষেত্রে মূলত হিন্দু ও বৈষ্ণব ধর্মমতের প্রাধান্য ছিল চোখে পড়ার মতো।

মধ্যযুগীয় সংস্কৃতির ক্ষেত্রে পাঁচালী, লোকনাট্য প্রভৃতিকে যাত্রার যথার্থ পূর্বসূরী বলে গণ্য করা হয়;এমনকি যাত্রার উৎস সন্ধান করতে গিয়ে অধিকাংশ গবেষক পাঁচালীর কথা উল্লেখ করেছেন।তবে পাঁচালী এবং যাত্রার মধ্যে বেশ কিছু সূক্ষ্ম পার্থক্য বিদ্যমান। পাঁচালী তে চরিত্র তথা মূল গায়েন থাকেন একজন,যাত্রায় তা একাধিক।ড.সুকুমার সেনের মতে শোভাযাত্রা থেকেই আধুনিক যাত্রা কথাটির উদ্ভব।

ড. আশরাফ সিদ্দিকী মনে করেছেন, যাত্রা শব্দটি দ্রাবিড় থেকে উদ্ভূত। কারণ দ্রাবিড় জনগোষ্ঠীর মধ্যে এখনও অনেক উৎসবকে যাত্রা বলে অভিহিত করা হয়। এমনকি সম্রাট অশোক তার শিলালিপিতে উৎসব অর্থ যাত্রা ব্যবহার করেছেন। অবশ্য খৃষ্টপূর্ব দ্বিতীয় দশক থেকেই কৃষ্ণ যাত্রার অভিনয় হতো তার প্রমাণ মেলে বিভিন্ন ক্ষেত্রে। তবে একটা বড় অংশের গবেষকের ধারণা এই যে যাত্রার অভিনয়ের সর্বপ্রথম মঞ্চায়ন হয় ষোড়শ শতাব্দীর প্রথম দশকে।১৫০৯ সাল নাগাদ মহাপ্রভু শ্রী চৈতন্যদেব অভিনীত পালা ' রুক্মিণী - হরণ' - যাত্রা প্রথম মঞ্চে অভিনীত হয়।

সালটা ১৯০৭। সেই সময় বঙ্গীয় সংস্কৃতির অন্যতম ধারক ও বাহক হল যাত্রা।এই বছরই বাংলাদেশের গয়ঘর - গঙ্গানগর গ্রামে জন্মগ্রহণ করলেন যাত্রা শিল্পের ধুমকেতু ব্রজেন্দ্রকুমার দে। একরত্তি ব্রজেন্দ্রকুমার যে পরবর্তী সময়ে যাত্রার মহানায়ক হয়ে উঠবে তা বোধহয় কেউই ভাবতে পারেননি। ব্রজেন্দ্র যখন প্রকৃতির পাঠশালায় সহজপাঠ পড়তে ব্যস্ত, তখন থেকেই সংসার সীমান্তে মা-বাবার এক অসম লড়াইয়ের সাক্ষী থাকত সে । অভাব তাদের নিত্যসঙ্গী। অভাবের সঙ্গে প্রতিনিয়ত লড়তে লড়তেও অর্থনীতিতে এম.এ করে ফেললেন ব্রজেন্দ্র। অর্থনীতিতে এম এ ডিগ্রি লাভের পরেও যাত্রা দলে যোগদান - এ যেন আজকের যুগের ইকনমিক্স পড়ে সিনেমা বানানোর মতো। অর্থাৎ  কিছুটা স্রোতের বিপরীতে ছুটে চলা তো বটেই। হ্যাঁ, আর্থিক নিশ্চয়তাকে একপ্রকার তুচ্ছ করে বঙ্গীয় সংস্কৃতির ভার নিজের কাঁধে তুলে নিলেন তিনি।দীর্ঘ শিক্ষকতা জীবনকে স্বেচ্ছায় পরিত্যাগ করে যাত্রার অ আ ক খ শিখতে শুরু করলেন ব্রজেন্দ্রকুমার। যাত্রা দলে যোগদানের পরে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে, দর্শককে উপহার দিয়ে গেছেন একের পর এক কালজয়ী পালা।'ব্রজনাভ ' এবং ' চাঁদের মেয়ে ' এই দুই পালার মধ্য দিয়ে যে বিজয় অভিযানের সূত্রপাত, সেই অভিজানের আকাঙ্ক্ষাকে ব্রজেন্দ্রকুমার নিজ মনে প্রজ্বলিত রেখেছিলেন আজীবন।

আরও পড়ুন-করোনা আক্রান্তের সংখ্যা হু হু করে বাড়ছে চিনে, তবে কি শেষ হয়নি অতিমারী?

 শুধুমাত্র নিশ্চিন্ত, নিরাপদ জীবন ত্যাগ নয়, যাত্রার জন্য ব্রজেন্দ্র কুমারকে আরও অনেক বড় মাশুল দিতে হলো। ১৯৭৫ সালের,২৬এ জানুয়ারি।ব্রজেন্দ্রকুমার দে -র হাত ধরে মঞ্চে এলো সম্পূর্ণ নতুন একটি পালা - 'বিদ্রোহী নজরুল।' পালাটি অভিনয়ের সঙ্গে সঙ্গে একদিকে যেমন প্রবল জনপ্রিয়তা অর্জন করল ঠিক তেমনি এই পালাকে কেন্দ্র করে শুরু হলো প্রবল বিতর্ক, যা একসময় পর্যবসিত হয় একপ্রকার ' কলতলার ঝগড়ায়'।' বিদ্রোহী নজরুল ' পালায় কবি মোহিতলাল মজুমদারের চরিত্রটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে। কিন্তু এই চরিত্রটিকে ঘিরেই জ্বলে ওঠে বিতর্কের আগুন। যে আগুনে প্রথম ঘি ঢালেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক অরুণ মুখোপাধ্যায়। আনন্দবাজার পত্রিকার মাধ্যমে ব্রজেন্দ্রকুমার -কে তীব্র কটাক্ষ করলেন তিনি।' যাত্রায় মোহিতলাল ' শিরোনামে একটি লেখা লেখেন অরুণবাবু। লেখার মধ্য দিয়ে অরুণবাবু আঙুল তুললেন পালাকার ব্রজেন্দ্রকুমারের দিকে - " মোহিতলাল মজুমদার চরিত্রটিকে এই পালায় হাস্যকর চরিত্র রূপে উপস্থাপন করা হয়েছে।"

৩ মার্চ, ১৯৭৫ - আনন্দবাজার পত্রিকায় কলম ধরলেন শিশির দে। লেখাটির মধ্য দিয়ে তিনিও ব্রজেন্দ্রবাবুকে একপ্রকার তুলোধনা করেন - " মোহিতলালের এই বিকৃত চরিত্র যাত্রার আসরে দেখে, যাত্রার আসর ছেড়ে চলে এসেছে অনেকে এমন খবরও কানে এসেছে। ' বিদ্রোহী নজরুল ' পালায় কবি মোহিতলালের এই বিকৃত চরিত্র অঙ্কনের জন্য পালাকার ব্রজেন্দ্রবাবুর জবাবদিহি করা উচিত।"

এভাবে বিতর্কের গ্রাফ যখন প্রায় হিমালয় অতিক্রম করেছে ঠিক সেই সময়ই ব্রজেন্দ্রকুমারকে সমর্থন করলেন সেই সময়ের অন্যতম নামী সাংবাদিক প্রবোধবন্ধু অধিকারী। তিনি অরুণ মুখোপাধ্যায় এবং শিশির দে এই দুজনের অভিযোগকে এককথায় নস্যাৎ করে দেন। তার লেখা থেকে জানা যায় যাত্রাপালায় কবি মোহিতলাল চরিত্রটি 'হাসি-কান্নার হিরা -  পান্নার দ্যুতিতে উজ্জল।' তবে এতকিছুর পরেও বিতর্কের পারদ প্রতিদিনই নতুন করে চড়ছিল।এই বিষয়কে কেন্দ্র করে অভিযোগ - পাল্টা অভিযোগের মধ্য দিয়ে যাত্রামহল বিভক্ত হয়ে গেছে বারংবার। না, বিতর্ক থামেনি এরপরেও, তার জল গড়িয়েছিল আদালত পর্যন্ত। ব্রজেন্দ্রকুমার - এর বিরুদ্ধে কবি মোহিতলালকে অপমানের অভিযোগ চরমে ওঠে যখন মোহিতলালের পুত্র মনসিজ মজুমদার সম্পূর্ণভাবে ব্রজেন্দ্রকুমারের বিপক্ষে কথা বললেন, আনন্দবাজার পত্রিকায় তিনি লিখলেন - "আমার গভীর বিশ্বাস সুস্থ থাকলে আবেগপ্রবণ নজরুল ও বাবার শেষ জীবন তাদের প্রীতিপূর্ণ সম্পর্কের প্রতিষ্ঠায় প্রয়াসী হতেন এবং কোন অবস্থাতেই অগ্রজতুল্য বন্ধুর অবমাননা অনুমোদন করতেন না।"

' বিদ্রোহী নজরুল '  পালাটি নিয়ে শেষ পর্যন্ত আদালতের দরজায় কড়া নাড়েন মৃন্ময় মজুমদার ( কেস নং সি ০২১৮,১৯৭৫)। আদালত তার সিদ্ধান্তে জানিয়েছিল  ব্রজেন্দ্রকুমার এ বিষয়ে অন্যতম অভিযুক্ত। অর্থাৎ কবি মোহিতলালের মানহানি করেছেন তিনি। যদিও অভিযুক্ত হওয়ার পরেও কোনোরকম শাস্তি ভোগ করতে হয়নি তাঁকে। কারণ তার বেশ কিছুদিন পূর্বেই এসবের উর্ধে চলে গেছেন তিনি, মৃত্যু হয়েছে ব্রজেন্দ্র কুমারের।


চায়ের কাপে তুফান তোলার মতো বিতর্কিত বিষয়ের উপর পরিগণিত হওয়ার পরেও 'বিদ্রোহী নজরুল 'পালাটিকে দর্শকমন্ডলী সাদরে গ্রহণ করে। বর্তমান সময়ে চিতপুরের গদিঘরগুলোর তুমুল ব্যস্ততা, সিনেমার নায়ক নায়িকা এনে যাত্রার মঞ্চ কাপানোর ব্যর্থ চেষ্টা, এবং সর্বোপরি বঙ্গীয় লোকসংস্কৃতির ' যাত্রা' নামক এই মৃতপ্রায় শাখাটিকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টার মধ্যে আমরা বোধহয় ভুলে যাই যাত্রাকে ভালবেসে এক মানুষের কঠিন কঠোর সংগ্রাম, আর আইনের মারপ্যাঁচের মধ্যেও তার চোয়াল চাপা লড়াইয়ের ইতিবৃত্তকে।


তথ্যসূত্র :  যাত্রার সঙ্গে বেড়ে ওঠা - প্রভাতকুমার দাস 

More Articles