'শুটিংয়ের সময় প্রতিমার আটটা হাতের কাঠামো আমার সঙ্গে বাঁধা থাকত': সংযুক্তা বন্দ্যোপাধ্যায়

Durgapuja 2022: টরেন্টো-তে থাকেন দূরদর্শনের দুর্গা ড. সংযুক্তা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর সঙ্গে এক্সক্লুসিভ কথোপকথনে তিয়াষা গুপ্ত।

আদ্যাশক্তি মহামায়া,
কত রূপ তাঁর, কখনও তিনি
মহিষাসুরমর্দিনী দেবী দুর্গা।
কখনও তিনি হিমালয়-নন্দিনী উমা।...

তখনও ভালো করে সূর্যোদয় হয়নি। আকাশ নীল। একটু একটু করে উঁকি দিচ্ছে পেঁজা তুলোর মতো মেঘ। কৈলাস থেকে আবির্ভূতা হলেন দেবী দুর্গা। এতদিন যাঁরা শুনে এসেছেন 'আশ্বিনের শারদপ্রাতে বেজে উঠেছে...’, এবার তাঁরা দেখলেন উমাকে। ১৯৯৪ সালে প্রথম মহালয়া দূরদর্শনে সম্প্রচারিত হলো। তারপর চলল বেশ কয়েক বছর। বাঙালির মনে ড. সংযুক্তা বন্দ্যোপাধ্যায় চিরস্থায়ী হয়ে রইলেন দনুজদলনী রূপে। এখন তাঁর বাস কৈলাস নয়, টরেন্টোয়। সেখান থেকে কথা বললেন ইনস্ক্রিপ্ট-এর সঙ্গে। একান্ত আলাপচারিতায় জানালেন, তাঁর অনুভবের নানা কথা।

কুমোরটুলিতে মৃৎশিল্পীর ছোঁয়ায় ধীরে ধীরে রূপ গ্রহণ করছে কায়া, মা আসছেন। মহালয়ার আর বেশি দেরি নেই। মহালয়ার অর্থ বাঙালির কাছে শুধুই তর্পণ নয়। মহালয়ার সম্পূর্ণতা বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রকে দিয়ে। পরবর্তীকালে বাঙালির ঘরে জায়গা করে নেয় টেলিভিশন। নয়ের দশকে দূরদর্শনে তৈরি হলো ‘মহিষাসুরমর্দিনী’। বাঙালি খুঁজে পেল তাঁর উমা। ২০১৪ সালে শেষ দুর্গারূপে দেখা গিয়েছে তাঁকে, তবু একাধিক চ্যানেলের প্রতিযোগিতার ভিড়ে আজও ট্রেন্ডিং সংযুক্তার ‘মহিষাসুরমর্দিনী’! ১৪ বছর ধরে দূরদর্শনের দুর্গা ছিলেন তিনি। তাঁর সঙ্গে একান্ত আলাপে উঠে এল প্রথম 'মহিষাসুরমর্দিনী'-তে অভিনয়ের নস্টালজিয়া। কীভাবে টরেন্টোয় পুজোর দিনগুলো কাটান, বললেন সে কথাও। তখন শ্রীশিক্ষায়তন কলেজের ছাত্রী ছিলেন সংযুক্তা।

সালটা ১৯৯৪। দূরদর্শন সিদ্ধান্ত নেয় ডান্স-থিয়েটারের মাধ্যমে উপস্থাপনা করা হবে 'মহিষাসুরমর্দিনী'। একজন ক্লাসিক্যাল ডান্সার থেকে দূরদর্শনের প্রথম দুর্গা। কেমন ছিল সেই জার্নি?

সংযুক্তা: প্রথম কথা, ডান্স থিয়েটার ফর্মে হয়েছিল; আমি যেহেতু ক্লাসিক্যাল ডান্সের ছাত্রী, কলামন্ডলমে থাকাকালীন আমি অনেক ডান্স ড্রামা ফর্মে কাজ করেছি- ফলে এটা তখন আমার কাছে নতুন নয়। তবে একটা গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে কাজ করছি, এটা অভিনব। এটা গুরুত্বপূর্ণ, কারণ, একটা সেন্ট্রাল ক্যারেক্টার, যাঁকে ঘিরে পুরো স্টোরিটা আবর্তিত হচ্ছে। দূরদর্শনে এই ধরনের অনুষ্ঠান প্রথম হলেও, আমার কাছে দূরদর্শন প্রথম নয়। কারণ আমি আগেও অডিশনের মাধ্যমে দূরদর্শনে 'চিচিং ফাঁক', 'হরেকরকম্বা', 'তরুণদের জন্য'- এসব ছোটদের অনুষ্ঠানে কাজ করেছি। এছাড়া মিসেস কুট্টির ছাত্রী হওয়ায় আমরা দূরদর্শনে অনেক অনুষ্ঠান করেছি। ফলে আমার টিভির অভিজ্ঞতা ছিল। এটা আমাকে অনেকটা হেল্প করেছে। এছাড়া আমরা যখন চিচিং ফাঁক, হরেকরকম্বা করেছি, তখন ক্যামেরাম্যান, ডিরেক্টর, প্রোডিউসাররা বুঝিয়ে দিতেন, কীভাবে ক্যামেরা ফেস করতে হয়। পরবর্তীকালে এই অভিজ্ঞতা কাজে এসেছে।

গুরু গোবিন্দন কুট্টির ফোন এবং তারপর কঠিন নির্বাচন প্রক্রিয়া- এই দুটোই বা কেমন ছিল?

সংযুক্তা: আমার শোনা কথা, গুরু গোবিন্দন কুট্টি এবং আন্টির কাছে যে, কলামন্ডলমে ওঁরা দূরদর্শন থেকে আগে এসে ঘুরে গেছেন। দ্বিতীয় বা তৃতীয় দিন ওঁরা আমাকে মিট করেন। আমাকে গুরুজি বলেছিলেন, দূরদর্শন থেকে ওঁরা পার্টিসিপ‍্যান্ট সিলেক্ট করতে আসছেন, তুমি এসো। সেই সূত্রে আমাদের যাওয়া। আমরা কী অনুষ্ঠানের জন্য যাচ্ছি, সেটা তখন জানতাম না। যেহেতু শুরুর দিকের কাজ, তাই সেভাবে প্রচার ছিল না। আমি জানি, আমাকে কিছু নাচের জন্য সিলেক্ট করা হবে। ওয়াটার ব্যালে-র মাধ্যমে কিছু কাজ হবে, সেই সঙ্গে চরিত্রায়ণ, সেই নিয়ে আলোচনা হয়। সবশেষে মিসেস কুট্টি প্রোডিউসার-ডিরেক্টর শর্মিষ্ঠা দাশগুপ্তকে বলেন, তুমি কি দুর্গা পেলে? তখন তিনি বলেন, ও করবে (আমাকে দেখিয়ে)। এর আগে আমার সঙ্গে কোনও কথাই হয়নি।

টানা ২ সপ্তাহ ধরে শুটিং হয়েছিল। আপনার প্রোডাকশনের কোনও বিশেষ অভিজ্ঞতা আছে?

সংযুক্তা: প্রথম বর্ষের ছাত্রী থাকাকালীনই প্রযোজক এবং পরিচালক দেখামাত্রই আমাকে পছন্দ করে নেন। এরপর টানা কঠিন পরিশ্রম ও ওয়ার্কশপ চলে। রিহার্সালের সময় থাকত একজন ফাইট মাস্টার। তিনি শেখাতেন, কীভাবে ত্রিশূল ধরতে হবে, চক্র ধরা, কীভাবে মহিষাসুরের সঙ্গে লড়াই করা ইত্যাদি। দু’সপ্তাহ ধরে চলে শুটিং। যুদ্ধের শুটিং হয়েছিল নিউ থিয়েটার্স, টেকনিশিয়ান স্টুডিও- এসব জায়গায়। সেট তৈরি করেছিলেন অশোক বসু। তিনি সত্যজিৎ রায়ের আর্ট ডিরেক্টর ছিলেন। একটা ঘটনা বলি। শুটিংয়ে কিছু লাইট এফেক্টস ইউজ করা হয়, সেই লাইটের দিকে নাকি তাকাতে নেই। আমি তো শুটিংয়ের রিকোয়ারমেন্ট অনুষায়ী তাকিয়ে ফেলি, কারণ এ-ব্যাপারে অনভিজ্ঞ। পরের দিন শুটিং ছিল, সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি, চোখ খুলতে পারছি না। সেদিনের শুটিং ছিল, আগুনের থেকে উঠছেন দেবী, আউটপুট অফ দ্য সিন ওয়াজ সো ইমপ্রেসিভ, কারণ, চোখটা আলাদা করে লাল করতে হয়নি। একেবারে ন্যাচারাল এফেক্ট।

তখন তো আজকের মতো উন্নত গ্রাফিক্স, সাউন্ড এফেক্ট ছিল না। তাই কি তখন কাজটা এতটা কঠিন ছিল?

সংযুক্তা: অফকোর্স কঠিন, অস্ত্রগুলো হাতে আসছে, তা পাস করা, পুরো কাজটা করিয়েছিলেন সনৎ মোহান্ত। (তিনি পরিচালক তপন সিংহ-র সহকারী পরিচালক)। তখন তো গ্রাফিক্সে হতো না। তাই পুরো কাজটাই হয়েছে ম্যানুয়ালি। বিগেস্ট চ্যালেঞ্জ ওয়াজ, দশ হাত। প্রতিমার যে দশ হাত থাকে, আটটা হাতের স্ট্রাকচার আমার গায়ের সঙ্গে বেঁধে দেওয়া হলো। আমার দুটো হাত, প্রতিমার আটটা। আমি যত বছর কাজ করেছি, এভাবেই করেছি।

এখন অনেক চ্যানেলে টিআরপির দৌড়, মহালয়ায় নানা দুর্গার আবির্ভাব, শুধু পুরনোদের কাছে নয়, নতুনদের কাছেও আপনি একইভাবে গ্রহণযোগ্য। এত বছর পরেও আপনাকে টেক্কা দেওয়ার মতো কেউ এলেন না। এটা আপনাকে কতটা আনন্দ দেয়?

সংযুক্তা: এটার না দু'রকম ফিলিং আছে। একজন পারফর্মার হিসেবে যখন জানি যে, জেনারেশন নির্বিশেষে মানুষ আমাকে গ্রহণ করেছে, সেটা খুব আনন্দের। আমি বলব আশীর্বাদ। এটা ব্লেসিং যে, নতুন জেনারেশনও আমাকে গ্রহণ করেছে। ইন্ডিয়ান ক্লাসিক্যাল ডান্সের ট্রেনার হিসেবে এটা দুঃখের যে, একজন আর্টিস্টকে সেভাবে উপস্থাপিত করা হচ্ছে না। এর জন্য একজন আর্টিস্ট একা রেসপন্সিবল নয়। এটা একটা টিম ওয়ার্ক। ফলে কিছুর একটা অভাব আছে। আমি শুধুমাত্র একটা চরিত্র। একটা ফেস। এখানে অনেকের অবদান জড়িয়ে। টোটাল কেমিস্ট্রিটা এখন জমছে না। সেইদিকে নজর দিতে হবে।

বাঙালির মনে দুর্গার অবিকল্প প্রতিমূর্তি আপনি, আপনি নিজে নিজের কোনও বিকল্প কাউকে মনে করেন? 

সংযুক্তা: আমার কাছে দুর্গা হিসেবে অনেকের মুখ ভেসে ওঠে, ফিল্মের থেকে হেমা মালিনী, অফকোর্স। ছোট থেকে আমরা তাঁকে দেখে এসেছি। পরবর্তীকালে মীনাক্ষী শেষাদ্রি।

আজ আবার 'মহিষাসুরমর্দিনী' করার সুযোগ পেলে, কোন চরিত্র করতে চাইবেন?

সংযুক্তা: দুর্গার নানা রূপ আমাকে আকর্ষণ করে।

অসুর চরিত্রটা কি চ্যালেঞ্জিং মনে হয়? যেহেতু ভিলেন!

সংযুক্তা: অবশ্যই চ্যালেঞ্জিং। তবে আমি জাস্টিস করতে পারব? মনে হয় না। (সঙ্গে প্রাণখোলা হাসি)

ব্যক্তিগত প্রশ্ন, টরেন্টোয় কেমন কাটে আপনার পুজোর দিনগুলো?

সংযুক্তা: রোজ অনুষ্ঠান থাকে। অনেক পুজো হয় টরেন্টোতে। এখানে আমার স্কুল আছে। আমার ছেলে-মেয়েরা, যারা পারফর্ম করার মতো কেপেবেল হয়েছে, তাদের নিয়ে অনুষ্ঠান হয়। সকালে অঞ্জলি, বিকেলে প্রোগ্রাম, পুজোর সময়টা খুব ব্যস্ততায় কাটে।

More Articles