কালীপুজো থেকে দীপাবলি
বাঙালিদের প্রাণের উৎসব অতিক্রান্ত হওয়ার পরেই আবার বাংলায় একরাশ আলোর ছটা বয়ে নিয়ে আসে কালীপূজা। বলা চলে, বাঙালির দ্বিতীয় বড়ো উত্সব। কার্তিক মাসের অমাবস্যা তিথিতে অনুষ্ঠিত হওয়া এই কালীপূজাকে বলা হয়ে থাকে দীপান্বিতা কালীপূজা। প্রাচীনকাল থেকেই বাংলায় শাক্ত সাধনা হয়ে এসেছে, দেবী কালী সেই শক্তিরই রূপ। কালীর এক হাতে থাকে খড়্গ আর অন্য হাতে কাটা মুন্ড, দেবীর এই মূর্তি আসলে তন্ত্র সাধনার প্রতীকস্বরূপ। পুরাণ মতে, দেবী মহামায়ার দশমহাবিদ্যা রূপের একটি রূপ হল এই কালী। এবার আসা যাক, কালীর আগমণ প্রসঙ্গে দু’এক কথা। পৌরাণিক কাহিনিতে বলা হয়েছে, শুম্ভ-নিশুম্ভ নামক দুই অসুরের বিনাশের মাধ্যমে দেবকুলের রক্ষার্থে দেবীর আবির্ভাব। আদ্যাশক্তি ভগবতীর কোষ থেকেই তাঁর সৃষ্টি। কোষ থেকে দেবীর জন্ম হওয়ায় তাঁকে বলা হয় ‘দেবী কৌশিকী’ এবং এই রূপ ধারণের সময় দেবীর গায়ের রঙ হয়ে ওঠে ঘন কালো, তাই তিনি পরিচিত হন ‘কালী’ হিসাবে। আবার অন্য স্থানে কালী নামকরণের পিছনের রয়েছে কাল-এর স্ত্রীরূপটি। অর্থাৎ মহাদেবের স্ত্রী হিসাবেই কালী নামের উত্পত্তি। প্রাচীন গ্ৰন্থে পাওয়া যায় কালী একটি দানবীর রূপ। মহাভারতে কালী প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, যোদ্ধা এবং পশুদের আত্মা বহন করে থাকেন যিনি, তিনিই কাল রাত্রি বা কালী।
এই ছিল ‘কালী কথা’। এবার আসা যাক, দীপাবলি প্রসঙ্গে। বাঙালিদের যখন কালীপুজো, গোটা উত্তর ভারতে সেই সময় ধুমধাম করে পালিত হয় দিওয়ালি উত্সব। তবে বাঙালিদের দীপাবলি যে কেবলমাত্র এই দেশেই পালিত হয় তেমনটা নয়। আবার দীপাবলি যে কেবল হিন্দুদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ তেমনটাও নয়। ভারতের ব্যতীত নেপাল, মায়ানমার, মরিসাস, শ্রীলঙ্কা, মালেশিয়া, গুয়েনা, সুরি, সিঙ্গাপুর, ফিজি ইত্যাদি দেশগুলিতেও দীপাবলির দিন সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয়। হিন্দু ছাড়াও শিখ, জৈন, বৌদ্ধ ধর্মের মানুষেরাও এই উত্সব পালন করে থাকেন । তবে প্রতিটি ধর্মেরই এই উত্সব পালনের নিজ নিজ তাত্পর্য রয়েছে। উত্তর ভারতে যেমন এই উত্সব পালিত হয় আশ্বিণ-কার্তিক মাসে, দক্ষিণ ভারতে আবার দীপাবলি পালন করা হয়ে থাকে বসন্তকালে। সংস্কৃতে ‘দীপ’ কথার অর্থ প্রদীপ বা আলোকশিখা এবং ‘অবলি’ কথার অর্থ সারিবদ্ধ। আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যায় এই আলোকে আবার বলা হয়েছে জ্ঞানের আলো। রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ এবং জৈনধর্মে দীপাবলির উল্লেখ পাওয়া যায়। শ্রীরামচন্দ্র, সীতা এবং লক্ষ্মণ চৌদ্দ বছর বনবাস কাটিয়ে যখন পুনরায় অযোধ্যা ফিরে আসেন, সেইদিন অযোধ্যাবাসী খুশির আলোয় ভরিয়ে তোলেন গোটা অযোধ্যা নগরীকে। এইদিনকেই পরে দীপাবলি হিসাবে পালন করার প্রসঙ্গ পাওয়া যায় রামায়ণে। আবার মহাভারত অনুযায়ী, ভূদেবী এবং বরাহরের শক্তিশালী পুত্র নরকাসুর স্বর্গ এবং মর্ত্ত্য উভয় দখল করে প্রবল অত্যাচার শুরু করে। এই সময় শ্রীকৃষ্ণ নরকাসুরকে হত্যা করে বন্দি ১৬হাজার নারীকে উদ্ধার করেন এবং তাঁদের সঙ্গে বৈবাহিক সূত্রে আবদ্ধ হন। মৃত্যুর সময় নরকাসুর কৃষ্ণের থেকে বর চেয়েছিলেন যেন তাঁর মৃত্যু দিবস অত্যন্ত ধুমধাম করে পালন করা হয়ে থাকে। দীপাবলির দিনেই নরকাসুরকে হত্যা করেন শ্রীকৃষ্ণ এবং সেই বরের কারণেই দীপাবলির সূচনা। পদ্মপুরাণ অনুযায়ী দীপাবলির দিনেই নাকি লক্ষ্মীর সঙ্গে বিবাহ হয় বিষ্ণুর। জৈনধর্ম অনুযায়ী ৫২৭ খ্রীস্টপূর্বাব্দে এই দীপাবলির দিনেই নির্বাণ লাভ করেছিলেন মহাবীর। ১৬১৯ সালে শিখদের ষষ্ঠ গুরু হরগোবিন্দ সহ ৫২জন রাজপুত্রকে দীপাবলির দিন বন্দিদশা থেকে মুক্তি দেওয়া হয় তাই শিখধর্মাবলম্বীরাও দীপাবলিতে সমানভাবেই মেতে ওঠেন। আর্য সমাজ এইদিন স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতীর মৃত্যুদিন পালন করে থাকেন।
আবাঙালিদের তো বটেই, এ ছাড়াও অনেক বাঙালি ঘরেও দীপাবলির দিনে পূজা পান দেবী লক্ষ্মী। এপার বাংলার মানুষেরা অনেকেই এই অমাবস্যা তিথিতে লক্ষ্মীপূজা করে থাকেন। কালীর মোটামুটি আটটি রূপের মধ্যে একটি রূপ দক্ষিণা কালীর। কালীর এই রূপটিই পূজা পায় দেবী লক্ষ্মী হিসাবে। তবে এই পূজায় যেমন লক্ষ্মীকে পুজো করে হয় তেমনভাবেই পূজিত হন অলক্ষ্মীও। মূল পূজা শুরুর আগে অলক্ষ্মীর আরাধনা করে তাঁকে বিসর্জন দিয়ে আসা হয় । এভাবেই বাঙালি ঘরে অশুভ শক্তির দূরীকরণের মাধ্যমে শুভ শক্তির প্রতিষ্ঠান করা হয়ে থাকে। অবাঙালিরা আবার লক্ষ্মীর সঙ্গে পূজা করেন গণেশকেও। এরা উভয়েই ঐশ্বর্যের প্রতীক। অনেকেই মনে করেন যা বাঙালিদের দীপাবলি, তাই উত্তর ভারতে দিওয়ালি। তবে বাঙালিদের দীপাবলি এবং দিওয়ালির মধ্যে কিছু তারতম্য থেকেই যায়। বাঙালিদের কালীপূজা ঘিরে দীপাবলির উত্সব চলে পাঁচদিন ধরে। দিওয়ালির মূল উত্সব তিনদিনেই সমাপ্ত হয়। ‘ভূতচতুর্দশী’ দিয়ে যেখানে দীপাবলির শুরু , সেখানে দিওয়ালি উত্সবের সূচনা ঘটে ‘ধনতেরাস’এর মধ্যে দিয়ে। এইদিন উত্তর ভারতে মানুষদের মধ্যে সোনা-রূপা কেনার চল রয়েছে এবং কুবের দেবতার সামনে ঘিয়ের প্রদীপ জ্বালানোর নিয়মও রয়েছে। তবে এখন অনেক বাঙালিই সমানভাবেই ধনতেরাস পালন করে থাকেন ধন ও ঐশ্বর্য লাভের আশায়। দিওয়ালির দ্বিতীয় দিন পালিত হয় ‘ছোটি দিওয়ালি’ নামে এবং পরবর্তী অনুষ্ঠান ‘ভাই-দুজ’। মূলত বাঙালিদের দিওয়ালির তৃতীয়দিনে আরাধনা করা হয় দেবী কালীর। তবে এতো কিছুর পরেও এই উত্সবে সবাই নিজেদের ঘর-বাড়ি অসংখ্য প্রদীপ দিয়ে মনের মতো করে সাজিয়ে তোলেন, বাঙালি-অবাঙালির ভেদাভেদ ভুলে সবাই মেতে ওঠেন আতসবাজিতে, সমগ্ৰ উত্তর ভারত একসাথে উত্সবের জোয়ারে ভাসে মিষ্টি মুখে।
Source:
- tv9bangla.com/spiritual/history-and-historical-story-of-kali-pujo-378257.html
- sobbanglay.com/sob/diwali/
- sobbanglay.com/sob/kali-puja/
- aajkaal.in