ভাষা হারালে হারিয়ে যাবে বিজ্ঞানের জ্ঞান, চেতনাও

একটি ভাষা মুছে গেলে কী ভাবে তার সঙ্গে জড়িত সংস্কৃতি মুছে যায়, সভ্যতা মুছে যায়, এবং মানুষের নিজস্ব পরিচিত মুছে যায়, তা আর বলে দিতে হয় না।  আর মানুষের নিজস্ব পরিচিত মুছে গেলে বোধহয় তার নিজস্ব ভাষায় ব্যক্ত করা ভাবনা-চিন্তা, মতামত, এবং জ্ঞান এক লহমায় হঠাৎ করে যেন হারিয়ে যায়। কিন্তু কোনো একটি নির্দিষ্ট  ভাষা হারালে কি বৈজ্ঞানিক জ্ঞান, চেতনাও কি হারিয়ে যেতে পারে? ভাষা হারালে কি প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষা করা, বাস্তুতন্ত্র রক্ষা করা কঠিন হয়ে যেতে পারে? কী ভাবে?

বর্তমানে কিছু না হলেও অন্তত ৭,৫০০ টি ভাষা সঙ্কটের মুখে রয়েছে - তাদের মধ্যে বেশ কিছু মুছে গেছে চিরতরে, কিছু কিছু ভাষা হারানোর পথে। পৃথিবীতে বোধহয় সবচেয়ে বেশী সঙ্কটের মুখে পড়ে আদিবাসীরা - তাদের সংস্কৃতি, লোকাচার এবং ভাষা।

 যেখানে প্রাকৃতিক সম্পদ বেশি, বনজ সম্পদের প্রাচুর্য বেশি, আদিবাসীদের বাসস্থান সেখানেই। প্রকৃতির সাথে তাদের নিবিড় যোগ - প্রকৃতি তাদেরকে সন্তানের মত আগলে রাখে, অন্যদিকে অদিবাসীরা প্রকৃতিকে রক্ষা করে বংশানুক্রমে জেনে আসা আদি জ্ঞান দিয়ে, গভীর মূল্যবোধ দিয়ে, এবং ব্যক্তিগত বিশ্বাস দিয়ে।

বনজ সম্পদের প্রাচুর্য যেখানে বেশি, সেখানে ওষধিগুণ সম্পন্ন গাছপালার সংখ্যাও বেশি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, সেই গাছপালার গুণাগুণ সম্পর্কিত জ্ঞান কেবল একটি নির্দিষ্ট আদিবাসীগোষ্ঠীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ। দুঃখের বিষয় এখানেই, বহুকাল ধরে  আহরিত প্রকৃতি সম্পর্কিত জ্ঞান লিখিত রূপে কোনোভাবেই সংরক্ষিত নেই, কেবল মুখে-মুখে এক প্রজন্ম থেকে পরের প্রজন্মে জ্ঞানের ধারা বয়ে গেছে কেবল নিজেদের মাতৃভাষায়।

শুধু কী গাছগাছড়ার ঔষধিগুণাগুণের জ্ঞান ভান্ডার ক্ষতি হবে সেই ভাষা হারালে? না, পাশাপাশি সেই গাছপালাগুলোর আঞ্চলিক নাম, শ্রেণীবিন্যাস হারিয়ে যাবে। গাছ শনাক্তকরণের জন্য সারা পৃথিবীতে ল্যাটিন ভাষা ব্যবহার করা হলেও, একটি বিষয় থেকেই যায় - আর তা হল সেই গাছটির আঞ্চলিক নামটির গুরুত্ব।

যেহেতু জঙ্গলকে নির্ভর করে অদিবাসীদের ওতোপ্রত ভাবে বেড়ে ওঠা, আদিবাসীদের মধ্যেই কিন্তু প্রাকৃতিক সম্পদ, গাছপালা এবং বনের পশু সংরক্ষণের বিশেষ জ্ঞান রয়েছে, জ্ঞান রয়েছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে বন ও বন্যপ্রাণীকে রক্ষা করার; জ্ঞান রয়েছে জল, মাটি সংরক্ষণের কার্যকরী প্রক্রিয়ার।

আর আবারও সেই সমস্ত শিক্ষা এবং তথ্য তারা লিখিত ভাবে সংরক্ষণ করেনি। প্রজন্ম এবং আদিভাষার বহমানতাই সেই শিক্ষা এবং জ্ঞানকে বয়ে নিয়ে গেছে। সুতরাং বুঝতে বাকি থাকে না, আদিবাসীদের স্ব স্ব মাতৃৃভাষা হারালে ক্ষতিটা কোন পর্যায়ে হবে। বনজ সম্পদ - গাছপালা, বন্যপ্রাণী, জল, মাটি এবং সেখানকার যে জীববৈচিত্র এবং তাদের সঙ্গে প্রাণী হিসেবে মানুষের কীরকম সম্পর্ক হওয়া উচিত, তাদের কেন্দ্র করে, তাদের রক্ষা করে কী ভাবে জীবনধারণ করা উচিত, তা বোধহয় চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় আদিবাসীরাই।

বর্তমানে ভারতেও একাধিক আদিবাসী গোষ্ঠী ও ভাষা সঙ্কটের মুখে। অরুণাচল প্রদেশের আকা আদিবাসী গোষ্ঠী, যাদের মাতৃভাষা আকা বা হ্রুশো, তা এখন বিপন্ন। আজ থেকে পনেরো বছর আগে হ্রুশো ভাষায় কথা বলতেন তিন হাজারেরও কম আদিবাসী।

এর পাশাপাশি আসামের ডিমাসা আদিবাসীগোষ্ঠীর ভাষা, ওড়িশার মুন্ডাদের বিরহোর ভাষা বিপন্ন। ২০১৯ সালে হিমালয়ের পাঁচটি ভাষা বিলুপ্ত বলে ঘোষনা করা হয়েছে, কারণ সাকুল্যে একশো জন লোক এই ভাষায় তখন কথা বলতেন।

প্রসিডিং অফ দ্য ন্যাশানাল অ্যাকাদেমি অফ সায়েন্সেস অফ দ্য ইউনাইটেড স্টেটস অফ আমেরিকা নামের একটি জার্নালে পেনসিলভ্যানিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটি এবং ইউনিভার্সিটি অফ অক্সফোর্ডের গবেষকদের যৌথভাবে করা একটি গবেষণা থেকে জানা যাচ্ছে ভাষার বৈচিত্রের সাথে জীববৈচিত্র সংরক্ষণের দৃঢ় একটি সম্পর্ক আছে। সেই গবেষণা থেকেও এ-ও জানা যাচ্ছে, পৃথিবীর যে যে জীববৈচিত্র সম্পন্ন স্থানগুলি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সেখানকার আঞ্চলিক ভাষাও ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে উল্লেখযোগ্য ভাবে।

ইউনিভার্সিটি অফ জ্যু়রিখের একটি গবেষণা থেকে জানা যাচ্ছে  গাছপালার ঔষধিগুণ সম্পর্কিত বহু প্রাচীন তথ্য হারিয়ে যাচ্ছে আদিবাসীদে নিজস্ব ভাষা হারিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই। অ্যামাজন উপত্যকা, নিউ গিনি, দক্ষিণ আমেরিকার বিভিন্ন স্থানে গবেষণা চালিয়ে দেখা যাচ্ছে, গাছপালার ঔষধিগুণ সম্পর্কিত তথ্যের ৭৫ শতাংশই একটি নির্দিষ্ট ভাষায় জানা রয়েছে এবং সেই ভাষা কেবল ওই অঞ্চলের আদিবাসীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ। উত্তর-পশ্চিম অ্যামাজ়নে ৬৪৫ টি আলাদা আলাদা উদ্ভিদ প্রজাতির ঔষধিগুণ সম্পর্কিত তথ্য কেবল মুখে মুখেই আদিবাসীরা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে জেনে এসেছে, আর সেই শিক্ষা বিভিন্ন গোষ্ঠীর  আদিবাসীদের সীমাবদ্ধ কেবল ৩৭ টি ভাষায়। আরও মজার বিষয় সমগ্র জ্ঞানের ৯১ শতাংশ কেবল একটি ভাষাতেই সীমাবদ্ধ। এছাড়াও বিপন্নতার মুখে কেনিয়ার ডিগো আদিবাসীরা ও তাদের ভাষা, পশ্চিম পাপুয়ার লানি, দানি, ইয়ালি, মী প্রভৃৃতি আদিভাষাও এখন বিপন্ন।

কিন্তু কেন হারাচ্ছে আদিবাসীদের ভাষা? ভেবে দেখলে  পুঁজিবাদীদের নজর সেখানেই, যেখানে সম্পদের প্রাচুর্য বেশি।  ফলে প্রাকৃতিক সম্পদ ধ্বংস করতে হলে, আদিবাসীদের আক্রমণ করাই প্রথম কাজ। এর ফলে বনসম্পদ বা প্রাকৃতিক সম্পদের কী ক্ষতি হচ্ছে, সে বিষয়ে আমরা ক্রমান্বয়ে আসব। কিন্তু আদিবাসীদের আক্রমণ করলে, তাদের নিশ্চিহ্ন করলে পৃথিবীর বুক থেকে একটি ভাষা চিরতরে হারিয়ে যায়।

শুধু তাই-ই নয়, ভদ্র, বাবুসমাজে খাপ খাওয়ানোর জন্যে, অনেক আদিবাসীগোষ্ঠীই নিজের সন্তানদের মাতৃভাষা না শিখিয়ে, ভদ্র, বাবু সমাজের ভাষা শেখাতে উদ্যত হয়। ফলে সেই নির্দিষ্ট ভাষার বহমানতা থেমে যায় আগের প্রজন্মেই। আর সেখানেই জীববৈচিত্র বা প্রাকৃতিক বৈচিত্র হারাবার থেকেও বেশি ক্ষতিকর সংস্কৃতি হারিয়ে যাওয়া, ভাষা হারিয়ে যাওয়া। এবং ধাপে ধাপে একটি সমগ্র আদিবাসী গোষ্ঠীর নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া।

More Articles