তালিবান আতঙ্কেও আফগানিস্তানে পালিত হচ্ছে এই উৎসব

...চাঁদ-বাজারে এ নওরোজের
         দোকান বসেছে মোমতাজের
         সওদা করিতে এসেছে ফের
             শাজাহান হেথা রূপ-পাগল।
    হেরিতেছে কবি সুদূরের ছবি
             ভবিষ্যতের তাজমহল–
     নওরোজের       স্বপ্ন-ফল!

কাজী নজরুল ইসলাম 'নওরোজ'– কবিতায় রূপের সওদার কথা বলেছেন। আক্ষরিক অর্থে নওরোজ হল রঙের উৎসব। মিলনের উৎসব। এবং প্রাচীন উৎসব। নব আনন্দে জাগ্রত হওয়ার উৎসব। সবেমাত্র বাংলা পালন করেছে পয়লা বৈশাখ। ক্যালেন্ডারের হিসেব মেনে দিনটা পেছনে চলে গেছে, তবে উৎসবের রেশ এখনও কাটেনি। তাই প্রাসঙ্গিকভাবে এই আবহে এল আর এক প্রাচীন বর্ষবরণ উৎসব 'নওরোজ'-এর কথা। রাষ্ট্রসংঘের সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো 'নওরোজ' উৎসবকে বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে। 


'নওরোজ' শব্দটা শুনলেই বাঙালির হয়তো কাজী নজরুল ইসলামের কথা মনে পড়ে। তাঁর বিখ্যাত 'নওরোজ' কবিতায় নজরুল লিখেছিলেন 'রূপের সওদা কে করিবি তোরা আয় রে আয়,/নওরোজের এই মেলায়!' এ ছাড়াও 'নওরোজ' শব্দটি বারবার ফিরে ফিরে এসেছে নজরুলের কবিতায়। নজরুলের সাহিত্যে মুসলমানি সংস্কৃতির নানা অনুষঙ্গ নানাভাবে উৎকীর্ণ থেকেছে।

আরও পড়ুন: আকবরের সময় থেকেই চলছে পয়লা বৈশাখ উদযাপন!


আফগানিস্তান, ইরান, মধ্য এশিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যের কিছু অংশে ইসলামের উভয় প্রধান শাখা– সুন্নি এবং শিয়াদের অনুসারীরা– নওরোজ ৩,০০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে পালন করে আসছেন। গবেষকরা বলেন, এই উৎসবের মাহেন্দ্রক্ষণে শিয়া-সুন্নিদের মধ্যে কোনও ভেদ থাকে না। সকলে উৎসবে সামিল হন। রঙে-রসে-আমোদে মাতোয়ারা হন অগণিত মানুষ। 
ফার্সি 'নওরোজ' শব্দটির অর্থ নতুন দিন। নওরোজ বিশ্বের প্রাচীনতম উৎসবগুলোর মধ্যে অন্যতম। জনপ্রিয় এই সংস্কৃতি ও উৎসব আজ শুধু ইরানের জাতীয় উৎসব নয়,  আফগানিস্তান,  তাজিকিস্তান,  আজারবাইজান, তুর্কমেনিস্তান, উজবেকিস্তান, 
তুরস্ক ও ইরাকেও এই উৎসব জাতীয় পর্যায়ে পালিত হয়। এই উৎসব কম-বেশি পালিত হচ্ছে জর্জিয়া, পাকিস্তান ও ভারতেও। বসন্ত ঋতু শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় এই নববর্ষ।

ইরানি বর্ষপঞ্জির প্রথম দিনটি হল মহাবিষুব, অর্থাৎ বসন্তের প্রথম দিন। মহাবিষুবের সময় সূর্য সরাসরি নিরক্ষরেখার ওপর অবস্থান করে। এই সময় সূর্যের কিরণ  উত্তর ও দক্ষিণ গোলার্ধে সমানভাবে ছড়িয়ে যায়। খ্রিস্টীয় একাদশ শতাব্দীতে ইরানি বর্ষপঞ্জিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারসাধন করা হয়, যার মূল উদ্দেশ্য ছিল বর্ষ শুরুর দিনটি, অর্থাৎ নওরোজকে মহাবিষুবের দিনে স্থির করে দেওয়া। এই বিষয়ে ইরানি বিজ্ঞানী নাসির আল-দিন আল-তুসি কর্তৃক প্রদত্ত সংজ্ঞা হল: "নববর্ষের প্রথম দিনটি (নওরোজ) হল সেইদিন যে দিন সূর্য মধ্যাহ্নের আগে মেষ রাশিতে প্রবেশ করবে।"

ঠিক কবে এবং কে প্রথম নওরোজ উৎসব চালু করেছিলেন তা স্পষ্ট নয়। কবি ফেরদৌসির অমর কাব্য 'শাহনামা' ও ঐতিহাসিক তাবারির বর্ণনা অনুযায়ী ইরানের বাদশাহ জামশিদ ছিলেন এই উৎসবের প্রথম আয়োজক। কেউ কেউ বলেন, ইরানের হাখামানেশীয় সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা সম্রাট দ্বিতীয় সাইরাস বা কুরুশ বাবেল বা ব্যাবিলন জয়ের বছর তথা খ্রিস্টপূর্ব ৫৩৮ সালে সর্বপ্রথম নওরোজকে জাতীয় উৎসব হিসেবে ঘোষণা ও পালন করেন। পারস্য সম্রাট প্রথম দারিউশের শাসনকালে এই উৎসব পার্সিপলিস প্রাসাদ কমপ্লেক্স বা তাখতে জামশিদে অনুষ্ঠিত হয়। 
শোনা যায়, প্রথম দারিউশ নওরোজ উপলক্ষে খ্রিস্টপূর্ব ৪১৬ সনে স্বর্ণমূদ্রার প্রচলন করেছিলেন। আশকানি ও সাসানিয় সম্রাটদের যুগেও নওরোজ উৎসব পালিত হত। যদিও এই উৎসব ঘিরে ইতিহাসবিদদের মধ্যে নানা মত। সে যাই হোক, উৎসবের আঁচ পেতে চোখ রাখতে হবে আফগানিস্তানের দিকে। 

পশ্চিম কাবুলের কার্তে সাখিতে সখী শাহ-ই মর্দান মন্দিরের প্রবেশদ্বারে নারীদের দল ভিড় করেন, যেখানে অনেক আফগান প্রতি বছর নওরোজ উদযাপন করতে ভিড় করেন। এই উৎসব বসন্তের আগমনকে চিহ্নিত করে। তাঁরা সিকুইন-সহ রঙিন পোশাক পরে সেলফি এবং টিকটক ভিডিও-র জন্য পোজ দিয়ে মাজার চত্বর রঙিন করে তোলেন। 

মার্কিন সেনা দেশে ফিরেছে। তালিবানের দখলে আফগানিস্তান। তাও অনেকদিন হল। তালিব- আমলে এটাই সেখানে প্রথম নওরোজ। তালিবান মানেই আতঙ্ক। তাই আফগান নাগরিকরা ভয় সঙ্গে নিয়ে উৎসবে মাতেন। 

ইরানের নওরোজ আবার অন্যরকম। ইরানি নওরোজের দিন বাবা-মা-সহ নিকট-আত্মীয় ও ঘনিষ্ঠজনদের সঙ্গে দেখা করে মানুষ। এই সময় বেশ কয়েকদিন ছুটি থাকে এবং ইরানিরা দেশের বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান সফর করেন এবং কেউ কেউ বিদেশেও যান। অনেক ইরানি নওরোজের প্রথম প্রহর বা প্রথম দিনটি পবিত্র কোনও স্থানে কাটাতে পছন্দ করেন। 
নওরোজের দিন অনেকেই পরস্পরকে উপহার বা বখশিশ দিয়ে থাকেন। ছোট শিশুরা বড়দের কাছ থেকে বখশিশ পেয়ে খুব খুশি হয়। নওরোজ ইরানি, কুর্দি, তাজিক ও আজেরি জাতিসহ আরও কয়েকটি জাতির বৃহত্তম জাতীয় উৎসব। 

বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে এই উৎসব পালিত হয়। তার মধ্যে অন্যতম ইরান ও আফগানিস্তান। নওরোজের অনেকদিন আগে থেকেই শুরু হয়ে যায় রসনা বিলাসের আয়োজন। কাবুলের রাস্তায় নানা রঙের মিষ্টির পসরা সাজিয়ে বসেন দোকানিরা। আফগান বাড়িতে পরিবারগুলো নওরোজের প্রস্তুতি নেয় অনেকদিন আগে থেকেই। এই বছরও তার ব‍্যতিক্রম হয়নি। স্টিউ করা ভেড়া, শাক-সবজির সুগন্ধি পদ কাবুলের রাস্তায় প্লাবিত হয়েছিল এ-বছরও। ছোট বাচ্চারা আফগানিস্তানের একটি জনপ্রিয় নওরোজ খাবার হাফ্ট মেওয়ার জন্য আখরোট তৈরি করে। আঠালো সর্পিল আকৃতির ভাজা মিষ্টির স্বাদ নাকি অদ্ভুত। যিনি খেয়েছেন, তিনি তা অকপটে তা স্বীকার করেন। 


পুরনো গ্লানি ভুলে নতুনের আবাহনই 'নওরোজ'। মধুরেণ সমাপয়েতের মধ্য দিয়ে রঙের উৎসব জীবনে যেন আরও রং ছড়ায়। ইতিহাসের পাতায় লেখা থাকবে দলিল, আর নওরোজ জীবনে লিখে দেবে কোনও রঙিন উপাখ্যান। এখানেই উৎসবের সার্থকতা।

More Articles