রিহার্সালে ফাঁকি দিয়ে ইস্টবেঙ্গলের ম‍্যাচে! 'মহিষাসুরমর্দিনী'-র রেকর্ডিংয়ের সেই সোনালি দিনগুলো

Mahishasuramardini: মহালয়ার সেই ভোরগুলো ছিল স্মৃতির আখড়া।

মহালয়ার ভোর। পিতৃপক্ষর অবসানে দেবীপক্ষর সূচনা। ছোট্ট বাক্সের যন্ত্রের ভেতর থেকে ভেসে আসা জলদমন্দ্র স্বরে ‘আশ্বিনের শারদপ্রাতে বেজে উঠেছে আলোকমঞ্জির’ আর মহালয়ার ভোর এখন বঙ্গজীবনে সমার্থক হয়ে গেছে। কিন্তু এক শতাব্দী আগে বাঙালির জীবনে মহালয়া দিনটি নিয়ে এমন উদ্দীপনা ছিল না। সেই সময় ধর্মবিশ্বাসী বাঙালি গঙ্গার ঘাটে ভিড় জমাতেন মহালয়ার ভোরে। পিতা-পূর্বজদের প্রতি তর্পণ অঞ্জলি করে দেবীপক্ষের সূচনা হতো বাঙালি জীবনে।

এই পরিচিত ছবিটাই ধীরে ধীরে বদলে গেল ১৯৩১ সালে। একবার আকাশবাণীর আড্ডায় এসে প্রেমাঙ্কুর আতর্থী মহালয়ার ভোরে সংস্কৃত শ্লোক ও নতুন গানের সমন্বয়ে এক অভিনব প্রভাতী অনুষ্ঠান করার প্রস্তাব দিলেন। এই প্রসঙ্গে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র স্মৃতিচারণায় লিখছেন,

আমাদের সংকট মুক্তির কাল অর্থাৎ ১৯৩১ সাল কলকাতা বেতারকেন্দ্রের ইতিহাসে বিশেষ ভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ ঐ বছরই আমরা আমাদের উত্তরকালের সবথেকে জনপ্রিয় এবং মর্যাদাসম্পন্ন ‘মহিষাসুরমর্দিনী’-র সূচনা করি। পুজোর সময়ে বাঙালি স্রোতাদের জন্য বিশেষ কিছু করা দরকার এ কথা মাথায় ঢুকতেই বাণীকুমার কাজে লেগে পড়লেন। পণ্ডিত অশোকনাথ শাস্ত্রীর সাহায্যে একটি আলেখ্য তৈরি করে বাণী তড়িঘড়ি হাজির করলেন। পঙ্কজ মল্লিকও তাতে সুর বসিয়ে গান জুড়ে অনুষ্ঠানটা তৈরি করে দিলেন। সমস্যা হল সংস্কৃত শ্লোক ও গুরুগম্ভীর বাংলা মেশানো রচনাটি পড়বে কে? আমি সাহস করে এগিয়ে গেলাম।

অনুষ্ঠান তৈরি হলেও তা নিয়ে চলেছিল বিতর্ক। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ তো ব্রাহ্মণ সন্তান নন, কায়স্থর ছেলে চণ্ডীপাঠ করলে লোকে তা ভালোভাবে মেনে না-ও নিতে পারে। পঙ্কজ মল্লিক আপত্তি উড়িয়ে দিয়েছিলেন লহমায়।

Banikumar

বাণীকুমার

বাণীকুমার গান লিখে ফেললেন। সেইসব গানে সুর দিলেন পণ্ডিত হরিশচন্দ্র বালি, রাইচাঁদ বড়াল ও পঙ্কজকুমার মল্লিক। ‘অখিল বিমানে’ এবং ‘বিমানে বিমানে আলোকের গানে’ সুর দিলেন হরিশ বালি। ‘নিখিল আজি সকল ভোলে’ গানটিতে সুর দিলেন রাইচাঁদ বড়াল। ‘মাগো তব বিনে সংগীত প্রেম ললিত’ গান-সহ বাকি গানগুলোয় সুর দিলেন পঙ্কজ মল্লিক।

প্রথমবার ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ অনুষ্ঠানে বিরাট এক অর্কেস্ট্রার আয়োজন হলো। সেকালের সবচেয়ে বড় যন্ত্রবাদকরা সঙ্গত করলেন সেই অনুষ্ঠানে। সারেঙ্গি বাজালেন মুন্সি, চেলো বাজালেন তাঁর ভাই আলি, হারমোনিয়ামে খুশি মহম্মদ, বেহালা বাজালেন তারকনাথ দে, ম্যান্ডোলিনের দায়িত্বে ছিলেন সুরেন পাল, গিটারে সুজিত নাথ, এসরাজ বাজালেন দক্ষিণমোহন ঠাকুর এবং পিয়ানোয় স্বয়ং রাইচাঁদ বড়াল। প্রথম সেই রেকর্ডিং-এর প্রধান গায়ক ছিলেন পঙ্কজকুমার মল্লিক স্বয়ং। অন্যান্য শিল্পীদের মধ্যে ছিলেন বিমলভূষণ, কৃষ্ণ ঘোষ, আভাবতী, মাণিকমালা, প্রফুল্লবালা, বীণাপাণি-সহ সেই সময়ের সব শ্রেষ্ঠ গায়ক-গায়িকারা। এরপরের অনুষ্ঠানগুলিতে ধারাবাহিকভাবে মহিষাসুরমর্দিনী-র অনুষ্ঠানে গান গেয়েছেন শচীন গুপ্ত, সত্য চট্টোপাধ্যায়, জগন্ময় মিত্র প্রমুখ।

হেমন্ত মুখোপাধ্যায় রেডিও-য় যোগ দেবার পর ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ অনুষ্ঠানের সেই বিখ্যাত গান ‘জাগো দুর্গা’ গাইতেন তিনি। পরবর্তীকালে ১৯৫০ সালে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় বম্বে চলে যাওয়ার পর আবার নতুন করে কে গান গাইবে, তা স্থির করতে বসলেন বাণীকুমার ও পঙ্কজ মল্লিক। তখন সবে আকাশবাণীতে যোগ দিয়েছেন দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়। এই প্রসঙ্গে দ্বিজেন মুখোপাধ্যায় স্মৃতিচারণে বলছেন,

একদিন আমাকে ডেকে পঙ্কজদা বললেন যে আমাকে বাণীকুমারের কাছে গিয়ে মহিষাসুরমর্দিনীর কিছু গান শোনাতে। আমি গিয়ে গান শোনালাম কিন্তু বাণীকুমারের আমার গান পছন্দ হল না। তাঁর এক্ষেত্রে বিশেষ পছন্দ ছিল শচীন গুপ্তকে। একদিন রিহার্সাল শেষে আমাকে ডেকে পাঠালেন পঙ্কজদা। তিন বার শুনলেন আমার গলায় গানটি। দিয়ে আমায় বললেন কাল সব শেষে তোমার গান রিহার্সাল হবে। তখনও আমি ভাবছি শচীন গুপ্তই এই গান গাইবেন। কিন্তু রিহার্সাল শেষে পঙ্কজদা বললেন এই গান গাইবে ইদ দ্বিজেন। উনি আমাকে ভালোবেসে ঐ নামে ডাকতেন।

Dwijen Mukhopadhyay

দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়

আবার ‘জাগো দুর্গা’ গানের এই যে প্রলম্বিত শুরু, অনেকটা দূর থেকে ভেসে আসা আজানের মতো, তার সঙ্গেও জড়িয়ে আছে এক মজার গল্প। স্তোস্ত্র পাঠ করতে করতে এক-এক সময় এতটাই বিভোর হয়ে যেতেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র যে, কোনও খেয়াল থাকত না। আর তখন, রেকর্ডিংয়ের সময় থাকত একটাই মাইক্রোফোন। ব্যাপারখানা এমন যে, বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র সরলে পরের ‘জাগো দুর্গা’ গানটি ধরবেন দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়। কিন্তু সেইবার কিছুতেই থামছেন না বীরেন্দ্রকৃষ্ণ। পঙ্কজ মল্লিক বললেন, ‘গান ধরো দ্বিজেন নইলে উনি থামবেন না।' তখন দ্বিজেন মুখোপাধ্যায় ওই প্রলম্বিত সুরে গান ধরলেন, যা শোনাল অনেকটা দূর থেকে ভেসে আসা আজানের মতো। সেই শুনে ঘোর ভাঙল বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রর।

আরও এক মজার গল্প শোনা যায় শিল্পী শিপ্রা বসুর স্মৃতিচারণে। মহালয়ার অনুষ্ঠানের মোটামুটি একমাস আগে থেকে হতো রিহার্সাল। সেই রিহার্সালে হারমোনিয়াম ধরে শিল্পীদের প্র্যাকটিস করাতেন স্বয়ং পঙ্কজকুমার মল্লিক। এরকমই একদিন রিহার্সালের দিন ইস্টবেঙ্গলের ম্যাচ। শ্যামল মিত্র ও মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় দু'জনেই অন্ধ ইস্টবেঙ্গল-ভক্ত। কিছুতেই ম্যাচ মিস করা চলবে না! আবার সরাসরি গিয়ে বলতেও পারছেন না পঙ্কজ মল্লিককে। অনেক ভেবে উপায় বের করলেন মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়। পঙ্কজবাবুকে কাঁচুমাচু মুখ করে বললেন, 'পঙ্কজদা, আমার বউয়ের খুব শরীর খারাপ। বাড়িতে একা আছে। কী যে করি! আবার রিহার্সাল তো করতেই হবে।' বউমার শরীর খারাপ শুনে একবাক্যে পঙ্কজ মল্লিক ছেড়ে দিলেন মানবেন্দ্রকে। ওদিকে শ্যামল মিত্রর তো মাথায় হাত। তিনি এবার কোন অজুহাত দেবেন? অনেক ভেবে শ্যমল মিত্র পঙ্কজ মল্লিককে বললেন, 'পঙ্কজদা, মানবের এখন মাথার ঠিক নেই। একা ছাড়া কি ঠিক হবে? যদি কোনও বিপদ হয়ে যায়।' পঙ্কজ মল্লিক ও ভালমানুষের মতো বললেন, 'না না, মানবকে একা ছাড়া ঠিক হবে না। যাও তুমিও ওর সঙ্গে চলে যাও।' এই করে সেদিন শ্যামল মিত্র ও মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় রিহার্সাল ফাঁকি দিয়ে ইস্টবেঙ্গল ম্যাচ দেখতে গিয়েছিলেন।

Movie scene

শ‍্যামল মিত্র, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় ও দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়

১৯৬৭ সালের আগে অবধি প্রত্যেকবারই আলাদা করে লাইভ সম্প্রচার হতো 'মহিষাসুরমর্দিনী'। বর্তমানে যে রেকর্ডিংটা সম্প্রচার করা হয়, তা ১৯৬৭ সালে রেকর্ডিং করা। সেই অনুষ্ঠানে 'বাজল তোমার আলোর বেণু' গেয়েছিলেন সুপ্রীতি ঘোষ। 'জাগো দুর্গা' গেয়েছিলেন দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়। 'ওগো আমার আগমনী আলো' ও 'তব অচিন্ত্য রূপচরিত মহিমা'-য় কণ্ঠ দিয়েছিলেন শিপ্রা বসু ও মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়। 'শুভ্রশঙ্খ রবে' কোরাসে গেয়েছিলেন শ্যামল মিত্র, অসীমা মুখোপাধ্যায়, আরতি মুখোপাধ্যায় ও আরও অনেকে। 'নমো চণ্ডী নমো চণ্ডী' গেয়েছিলেন গায়ক বিমলভূষণ। পঙ্কজ মল্লিকের সুর করা 'মাগো তব বিনে সংগীত প্রেম ললিত' গেয়েছিলেন সুমিত্রা সেন। 'বিমানে বিমানে আলোকের গানে' গেয়েছিলেন গীতশ্রী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। 'হে চিন্ময়ী'-তে নেপথ্য কণ্ঠ দিয়েছিলেন তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়। 'অমল কিরণে' গানটি গেয়েছিলেন প্রতিমা বন্দ‍্যোপাধ্যায়। 'জয়ন্তী মঙ্গলা কালী' ও 'শান্তি দিলে ভরি' গান দু'টি গেয়েছিলেন পঙ্কজ মল্লিক ও উৎপলা সেন।

Mahalaya recording

'মহিষাসুরমর্দিনী'-র একটি রেকর্ডিং চলাকালীন

১৯৭৬ সাল। জারি হয়েছে জরুরি অবস্থা। দিল্লি থেকে আকাশবাণীর কর্তারা ঠিক করলেন, এবার আর মহিষাসুরমর্দিনী নয়। স্টার ভয়েস দিয়ে করতে হবে অনুষ্ঠান। অসীমা মুখোপাধ্যায় কোনও রকমে রাজি করালেন উত্তমকুমারকে। তখন বাঙালির কাছে উত্তরকুমারের থেকে বড় আর কোনও স্টার নেই। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় সংগীত আয়োজনের দায়িত্ব পেলেন। অনুষ্ঠানের নাম দেওয়া হলো, 'দেবী দুর্গতিহারিণী'। সেইমতো ফলাও করে বিজ্ঞাপন দেওয়া হলো। ১৯৭৬-এর ভোরে বাঙালির ঘুম ভাঙল মহানায়কের কণ্ঠে। অনুষ্ঠান সম্প্রচারিত হওয়ামাত্রই চারদিকে প্রতিবাদের ঝড় উঠল। আকাশবাণীর গেটে বিক্ষোভ দেখালেন বহু মানুষ। বাধ‍্যত দ্বিতীয়বার সম্প্রচার করা হলো বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র-পঙ্কজকুমার মল্লিক ও বাণীকুমারের 'মহিষাসুরমর্দিনী'।

যে বীরেন্দ্রকৃষ্ণর কণ্ঠ বাঙালির দুর্গাপুজোর কার্টেন রেজার, তার বদলে অন্য কোনও কণ্ঠ সেদিন গ্রহণ করতে পারেনি বাঙালি। দিল্লিতে বসে বাঙালির সেই আবেগ ধরতে পারেননি দিল্লির কর্তারা।

বছর যত গড়িয়েছে, সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে মহিষাসুরমর্দিনী-র জনপ্রিয়তা। এখনও মহালয়ার ভোরে বীরেন্দ্রকৃষ্ণের উদাত্ত কণ্ঠে চণ্ডীপাঠ শুনে দুর্গাপুজোর লগ্ন শুরু হয় বাঙালির।

More Articles