মুসলমানের বাজনায় মহালয়ার ভোর! সম্প্রীতির অনন্য নজির 'মহিষাসুরমর্দিনী'

Mahisashuramardini: মুন্সী-আলিদের বাজনা, কায়েতের স্তোত্রপাঠ! মিলনের 'মহিষাসুরমর্দিনী'।

মোরা একই বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু-মুসলমান,
মুসলিম তার নয়ন-মণি, হিন্দু তাহার প্রাণ।

-কাজি নজরুল ইসলাম।

আমরা দুই ধর্মের বিভেদের বাণী নির্মূল হতে দেখেছি বারবার। আমরা প্রত্যেক মুহূর্তেই সমাজের দর্পণ, সাহিত্যের মাধ্যমে অনুভব করেছি, মানুষ হিসেবে বাঁচার তাগিদ। লালন থেকে রবীন্দ্রনাথ; প্রত্যেকদিন বশবর্তী হয়েছি ধর্মহীন অথবা সকলে মিলে থাকার পথে। 'আয় আরও বেঁধে বেঁধে থাকা'-র মন্ত্রে দীক্ষিত হয়েছি বারবার। কিন্তু সাহিত্য আর রাজনৈতিক পথসভা অথবা বিজ্ঞাপনের মতো দেওয়ালজুড়ে এই বার্তা-আবহের বিকাশ ঘটলেও আসলে তা কার্যকর হয়েছে কি? নাহ্, বরং প্রতিটি দিন সমস্ত কিছুর মধ্যেই সৃষ্টি হয়েছে এক একটি গোধরা, আখলাক, মিঠুন ঠাকুর, ধুলাগড়, বসিরহাট... তালিকা লম্বা হয়েছে ক্রমশ। আমরাও ব্যতিব্যস্ত হয়ে বলে উঠেছি ধর্মের মিলনের কথা, সর্বধর্মসমন্বয়ের কথা। কিন্তু মঞ্চের আড়ালে আসলে তৈরি হয়নি হিন্দু-মুসলমান-খ্রিস্টান-জৈন ছাড়িয়ে মানবিকতার কথা, মানবতার কথা! মসজিদে মহিলার প্রবেশে না, মন্দিরে ঋতুমতী মহিলায় না-র অন্ধকার অতলে মহাপ্রভু চৈতন্যের যবন হরিদাস আবহ ভুলিয়ে দেওয়ার আবহে আসলে রয়েছে যে ভ্রম, তার চেয়ে ক্ষতিকারক আর কী!

আসলে এই আবহের ছত্রে ছত্রেই আবর্তিত হয়েছে এক অজানার ফাঁদ। প্রতি মুহূর্তে বিবর্তিত হয়েছে অজ্ঞান আর অচ্ছুৎ আবহ। নিরন্তর নিজের স্থান শক্ত করেছে এক অন্ধকার, অবিবেচক সত্যি। যা বিভেদ ঘটিয়েছে শুধু। শুনতে খানিকটা কাব্যের মতো হলেও সমসাময়িক প্রেক্ষাপট আর অত্যাধুনিক সমাজব্যবস্থায় দাঁড়িয়ে এ-ও সত্য আজও! কিন্তু যে কারণে এই বিচ্ছেদ, যে কারণে এই বিভেদ, যে আচার পালনের জন্য আজ এই পরিস্থিতি- যদি সেই পালনের একাধিক ক্ষেত্রই চমকে দেয় বারবার! সমস্ত ভূমিকা ওলটপালট করে, যার জন্য এই বিচ্ছেদ, সেই-ই বারবার যদি দেখিয়ে দেয়, আসলে সব এক, তখন?

দেশীয় প্রেক্ষাপট, ধর্মীয় আচার এবং সর্বধর্মসমন্বয়ের ভূরি ভূরি উদাহরণ আছে। শুধুমাত্র বঙ্গ এবং তার দুর্গা-উৎসবের দিকে তাকালেই এর নজির মেলে। আর এই উৎসব-আবহের অন্যতম অংশ মহালয়া। যা অনন্য, যা আজও মৌলিক 'মহিষাসুরমর্দিনী'-কে ঘিরে। এই অনুষ্ঠান সর্বজনবিদিত, বিতর্কিত, আলোচিত। আর এই আবহেই এখনও জনপ্রিয় 'মহিষাসুরমর্দিনী' দেখিয়েছে ভিন্ন ধারার ছবি। তৎকালীন সময়ে দাঁড়িয়ে যা কঠিন। ইংরেজ শাসনাধীন জাতপাতের, ধর্মীয় বিভেদের ভারতের আবহে সম্পূর্ণ ভিন্ন।

মহালয়া নিয়ে বহু মতবাদ প্রতিষ্ঠিত। পুরাণ অনুযায়ী দাবি করা হয়, মহাভারতের অন্যতম চরিত্র কর্ণ যখন মারা যায়, তখন তার আগমন ঘটে স্বর্গে। সেখানে দেখা যায়, কর্ণকে খাবার হিসেবে সোনা দেওয়া হচ্ছে। কর্ণ এই খাবারের কারণ জানতে চাইলে, তাকে বলা হয়, জীবিতাবস্থায় পিতৃপুরুষদের শুধু সোনা দান করেছে সে। অন্ন বা জল দেয়নি। সেই পাপ খণ্ডন করে কর্ণ। ভাদ্রমাসের কৃষ্ণপক্ষর প্রায় ১৬ দিন যাবৎ এই কাজ করে। পিতৃপক্ষর অবসান হয়। মাতৃপক্ষর সূচনা ঘটে।আবার বলা হয়, মাতৃপক্ষর সূচনায় মায়ের গৃহপ্রবেশ। এক আলোকিত উত্তরণ। আবার ত্রেতাযুগে রামচন্দ্রের দুর্গার অকালবোধন। সীতা উদ্ধারের প্রার্থনা এবং সনাতন রীতি অনুযায়ী শুভ কাজ শুরুর আগে পিতৃপুরুষদের প্রতি প্রার্থনার রীতি, মহালয়ার ক্ষেত্রে অন্যতম বলেও মনে করা হয়। দাবি করা হয়, পিতৃপক্ষর শেষে, অমাবস্যা পেরিয়ে দেবীপক্ষর আগমনের আবহে দেবীই হচ্ছেন মহান আশ্রয়, তাই তাঁর উত্তরণের লগ্নটির নামই মহালয়া। একটি অর্থ অনুসারে আবার মহান আলয়টি হচ্ছে পিতৃলোক। এই দিনটি হচ্ছে পিতৃপূজা এবং মাতৃপূজার সন্ধিলগ্ন। আবার পুরাণ মতে বলা হয়; মহালয়ার দিনে, দেবী দুর্গা মহিষাসুর বধের দায়িত্ব পান।

মহালয়া নিয়ে একাধিক পুরাণ-অনুষঙ্গের কথা থাকলেও 'মহিষাসুরমর্দিনী'-র ঘটনাক্রম ভিন্ন। তার উত্থাপনের ইতিহাস বলে ভিন্ন কথা। ১৯২৮ সাল। আকাশবাণী-র কর্তা নৃপেন্দ্রনাথ মজুমদার। তখন পরাধীন ভারত এবং টেলিভিশনহীন সময়। সংগীত-বিষয়ক বেতার অনুষ্ঠান বেশ জনপ্রিয়। এমন সময়ে দাঁড়িয়ে আলোচনার মাধ্যমেই হঠাৎ নৃপেন্দ্রনাথের মাথায় আসে দুর্গা বিষয়ক কিছু একটা করার কথা। ১৯২৮-এরই ২৬ অগাস্ট একটি নাটক সম্প্রচারিত হয়, যেখানে অভিনয় করেন যাঁরা, তাঁদের মস্তিষ্কপ্রসূত এই অনুষ্ঠান। ঠিক এই সময়েই রেলের চাকরি ছেড়ে রেডিওয় ঢুকলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র। ১৯৩০ সাল নাগাদ সরকারি হলো বেতার। নাম বদলে হয় 'ইন্ডিয়ান স্টেট ব্রডকাস্টিং সার্ভিস।

১৯৩২ সাল। মার্চ মাস। বাণীকুমার মার্কন্ডেয় চণ্ডী অনুসারে লিখলেন একটি 'চম্পু'। যার নাম দেওয়া হলো 'বসন্তশ্বেরী'। হরিশ্চন্দ্র বালি, পঙ্কজকুমার মল্লিক সুর দিলেন ওই অনুষ্ঠানে। রাইচাঁদ বড়ালের স‌ংগীত পরিচালনা। ভাষ্যপাঠে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র এবং বাণীকুমার। অষ্টমীর দিন চলে ওই অনুষ্ঠান। পরে মহিষাসুরবধের ঘটনাকে কেন্দ্র করে একটি গীতি-আলেখ্য অনুষ্ঠিত হয়। ‘বিশেষ প্রত্যুষ অনুষ্ঠান’ নামে প্রচার হয় তা।

১৯৩৩ সাল। ১৯ সেপ্টেম্বর। মহালয়ার দিন সকালে প্রথম 'মহিষাসুরমর্দিনী' নামে অনুষ্ঠান সম্প্রচারিত হয়। সংগীত পরিচালক পঙ্কজকুমার মল্লিক হলেও ‘আলোকের গানে’-র মতো গানে সুর দেন হরিশ্চন্দ্র বালি। দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়, সত্য চৌধুরীদের উদাত্ত কণ্ঠ আর বাণী-পঙ্কজ-বীরেন্দ্র জুটি এই অনুষ্ঠানকে করে তোলেন মাইলস্টোন। যেন দুর্গাপুজো মানেই মহিষাসুরমর্দিনী, যা ছাড়া পুজো সম্ভবই নয়। এই ভাবনাই উনিশ শতকের চারের দশকে তৈরি করে দিয়েছিলেন ওঁরা। যা ১৯৩৫-'৩৬ নাগাদ ষষ্ঠীর দিনে সম্প্রচারিত হলেও ১৯৩৭ থেকে ফের মহালয়ার ভোরে শুরু হয়। শুধু এই ধারণা নয়, সমকালীন ভারতীয় ধার্মিক প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে নির্দিষ্ট এই গোষ্ঠী বদলে দিয়েছিলেন জাত-ধর্ম নিয়ে ভাবনার সংজ্ঞাও। যার সূচনা হয়েছিল বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রকে ঘিরে। চণ্ডীপাঠ করবেন কায়স্থ বীরেন্দ্র! এই নিয়ে গোঁড়া ব্রাহ্মনরা প্রশ্ন তুললে, নৃপেন্দ্রনাথ মজুমদার বলেন (বীরেন্দ্রকৃষ্ণের বয়ানে জানা যায়),
আমরা কি হিন্দুর মন্দিরে গিয়ে পুজো করছি নাকি। আমরা অনুষ্ঠান করছি। সেখানে কায়েত আর ব্রাহ্মণ দিয়ে কী হবে! তাহলে আমাদের মুন্সী, আলিদের দিয়ে বাজানো যাবে না, বাজাতে ব্রাহ্মণ ডাকতে হবে!

এই প্রেক্ষাপটে তৈরি হয় 'মহিষাসুরমর্দিনী'। যেখানে বিরচিত হয় ধর্মের বিভেদ মুছে দেওয়া এক ভিন্ন চিত্র। যেখানে সমগ্র পর্বে বাদ্যযন্ত্র বাজাতেন একাধিক মুসলমান শিল্পী। সারেঙ্গি বাজাতেন মুন্সী, চেলো বাজাতেন তাঁর ভাই আলি, হারমোনিয়ামে ছিলেন খুশি মহম্মদ। এছাড়াও আকাশবাণী-র আরও কয়েকজন নিয়মিত মুসলমান বাদক মহিষাসুরমর্দিনী-র আবহে সঙ্গত দিতেন। অর্থাৎ তথাকথিত হিন্দুর অনুষ্ঠান, ধর্মীয় আচার স্পর্শ করল মুসলমান। পরোক্ষে এই ভাবনার প্রথম বিচ্ছুরণ ঘটিয়েছিল বাণীকুমারের এই অনুষ্ঠান।

শুধুমাত্র মুসলমান বাদকের আবহে নয়। এই অনুষ্ঠানটির বিবর্তনে জড়িয়ে যায় আর এক কণ্ঠশিল্পী নাজির আহমেদের নামও। তিনি নাকি বেশ কয়েক বছর এই অনুষ্ঠানে স্তোত্রপাঠ করেছেন। অর্থাৎ হিন্দুর গ্রন্থ পাঠ করেছেন মুসলিম! এই আলোচনার মধ্যেই একাধিক সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় বাংলাদেশের কবি শামসুর রাহমানের নাজির আহমেদ প্রসঙ্গ। যেখানে বলা হয়,

মহালয়ার দিন সকালে আকাশবাণী কলকাতার অনুষ্ঠানের সূচনা হত স্তোত্রপাঠ দিয়ে। সেই স্তোত্রের অবধারিত পাঠক ছিলেন বীরেন ভদ্র। অন্য কেউ তাঁর মতো স্তোত্র আবৃত্তি করতে পারতেন না। এক বার মহালয়ার স্তোত্রপাঠের নির্ধারিত সময়ে তিনি বেতারকেন্দ্রে আসতে পারেননি। রেডিওর অনুষ্ঠান নির্ধারিত সময়ে প্রচার করা ছাড়া গত্যন্তর নেই। নাজির আহমদ জানালেন, যদি কর্তৃপক্ষ অনুমতি দেন তা হলে তিনি স্তোত্রপাঠ করতে পারেন। অনুমতি পাওয়া গেল। ঠিক সময়মাফিক মাইক্রোফোনের সামনে গিয়ে স্তোত্র আবৃত্তি করতে লাগলেন তাঁর আবেগময় কণ্ঠস্বরে।ইতিমধ্যে বীরেন ভদ্র এসে হাজির। তিনি দাঁড়িয়ে নাজির আহমদের স্তোত্রপাঠ শুনলেন নিবিষ্ট চিত্তে। কেউ কেউ নাজির আহমদকে থামানোর প্রস্তাব করেছিলেন, কিন্তু বীরেন ভদ্র বারণ করলেন।... যাঁরা আকাশবাণী কলকাতার আরেকটি বিশেষ অনুষ্ঠান শুনেছিলেন বহু বছর আগে তাঁরা আজও স্মরণ করেন, কচ ও দেবযানী-র কথা।

শুধু বাদক বা নাজির নন, বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র নিজে একবার ‘বেতার জগৎ’ পত্রিকায় মহিষাসুরমর্দিনী প্রসঙ্গে লিখেছিলেন,

এ যেন স্বয়ং মহামায়া এসে হিন্দু-মসুলমান শিল্পীদের প্রচেষ্টায় সুরবৈচিত্র্যের এক সঙ্গম স্থাপন করে দিয়ে গিয়েছিলেন আড়াল থেকে।

যদিও নাজির আহমেদের স্তোত্রপাঠ নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। এই প্রসঙ্গে তথ্য জানতে ইনস্ক্রিপ্ট যোগাযোগ করেছিল, প্রায় ৫০ বছর রেডিও, টেলিভিশনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা বাংলার প্রখ্যাত ব্যক্তিত্ব, আধিকারিক-কবি পঙ্কজ সাহার সঙ্গে। তিনি ইনস্ক্রিপ্ট-কে বলেন,

আমার বন্ধু ছিলেন নাজির আহমেদ। লন্ডনে বিবিসি-তে আমার কাজের সময় ওই শহরেই থাকতেন তিনি। বিদগ্ধ পণ্ডিত, সুদর্শন, অসাধারণ ব্যক্তিত্ব, শিক্ষিত, মার্জিত, তাঁর গুণের কোনও অভাব ছিল না। তিনি দারুণ বাংলা, উর্দু, সংস্কৃত বলতে পারতেন। তাই, এটা অস্বাভাবিক কিছু নয় যে উনি সংস্কৃত ভাষায় চণ্ডীপাঠ করতে পারবেন না। তবে, বীরেনদার (বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র) আসতে দেরি হওয়ায় নাজির আহমেদ পাঠ করলেন, এটা আমিও শুনেছি। যদিও সেই শোনাটা লন্ডন থেকে ফিরে। তাই, নাজির আহমেদকে জিজ্ঞাসা করা হয়নি কোনও দিন। এই কারণে এর সত্যটা জানা নেই।

Pankaj Saha

পঙ্কজ সাহা

এর সঙ্গেই তিনি বলেন,

আগে রেডিওয় সকালের ঘোষকরা রাতে স্টুডিওর মধ্যেই থেকে যেতেন। তাঁরা বাড়ি ফিরতেন একেবারে সকালের কাজের পরে। নাজির আহমেদ ঘোষক ছিলেন। শুনেছি এমন একদিন উত্তর কলকাতার বাড়ি থেকে আসতে দেরি করেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র। সেই সময় অনুষ্ঠান সঠিক সময়ে শুরুর জন্য নাজির আহমেদ পাঠ করেন। একবার এমন ঘটনা ঘটেছিল বলে শোনা আমার। কিন্তু এর সত্যতা ঠিক কতটা জানি না।

আর সম্প্রীতির মহিষাসুরমর্দিনী নিয়ে পঙ্কজবাবুর বক্তব্য,

মুসলমান বাদক ছিলেন। কিন্তু ভীষণ পবিত্রতা বজায় রাখা হত এই অনুষ্ঠানে। বীরেনদা (বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র) স্নান করে কাচা কাপড় পরে আসতেন। ১৯৭৪ সালে শেষবার তিনি রেকর্ড করেন। সেই সময় আমিও ছিলাম। উনি আমাকে স্নান করে কাচা পোশাক পরে আসতে বলেন। স্টুডিওয় ধূপ জ্বালানো বারণ থাকলেও ওইদিন জ্বালানো হত। সমস্ত কলাকুশলীরা আরতির মতো করতেন। টানা রেকর্ড হত। তাই, ধর্মের একটা অনুষঙ্গ থাকলেও তার মধ্যে একটা পবিত্রতা কিন্তু ছিল।

সামগ্রিক এই বিষয়ে জানতে ইনস্ক্রিপ্ট যোগাযোগ করেছিল প্রবীণ স‌ংগীতশিল্পী হৈমন্তী শুক্লার সঙ্গে, যিনি মহিষাসুরমর্দিনী-পর্বে একটা সময় গানও গান। তিনি বলেন,

আজও ভাল লাগে এটা ভেবে যে এখানে সর্বধর্মসমন্বয় ঘটেছে। আসলে এটা ধর্মীয় আচারের সঙ্গেই একটা উৎসব। সেখানে দাঁড়িয়ে এই উদ্যোগ খুব ভাল ছিল। আর গান-বাজনার ক্ষেত্রে কে হিন্দু, কে মুসলমান; এটা দেখার তুলনায় তাঁর সৃষ্টি প্রতিফলিত হয় বারবার, সেটাই তো আসলে প্রয়োজন।

Haimanti Sukla

হৈমন্তী শুক্লা

এই প্রসঙ্গে ইনস্ক্রিপ্ট-কে জনপ্রিয় বাচিকশিল্পী এবং রেডিওর সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত জগন্নাথ বসু জানান,

মহিষাসুরমর্দিনী হাওয়ার তাজমহলের মতো। এর কদর বিশ্বজুড়ে। এটি একটি অনন্য নজির। এখানে জাত-ধর্মের কোনও বিষয়ই নেই। আজও সেই পরম্পরা চলে। আসলে হিন্দু-মুসলমানের ব্যাপার এখানে নয়, এখানে শিল্প আর শিল্পী আগে।

জগন্নাথ বসু

যদিও নাজির প্রসঙ্গে মতভেদ থাকলেও আমরা উল্লেখ করতে পারি, এই অনুষ্ঠানের সম্প্রীতি এবং তা নিয়ে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের পরিবারের সদস্যদের বক্তব্য। ২০১৮ সাল। ওই বছর অক্টোবর মাসে এই প্রতিবেদককে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রর কন্যা সুজাতা ভদ্র জানান,

বাবা বরাবর নাস্তিক ছিলেন। তবে এই দিন ছিল ভিন্ন। রাত থাকতে স্নান করে পরিষ্কার কাপড় পরে যেতেন অনুষ্ঠানে। এসে বলতেন বাদকদের কথা। মজার ইতিহাস জানতাম আমরাও। কোনও দিন ধর্মীয় বিভেদ বিশ্বাস করতেন না বাবা এবং ওই অনুষ্ঠানে থাকা বাকিরাও।

জানা যায়, বাণীকুমারের নির্দেশ এবং সংস্কৃত, বাংলা পাঠে বাদ্যযন্ত্র বাজানোর নিয়ম বলা হলেও ভাষা না বোঝায় পুরো সময় বাজতে থাকে যন্ত্র। যা তৈরি করে এক নতুন ইতিহাস। এভাবেই একটি ধর্মীয় আচার-আবহ কঠিন ভিত্তি তৈরি করেছিল সম্প্রদায়গত বার্তায়। ওই একই সাক্ষাৎকারে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রর এক কন্যার ঘরের দৌহিত্র (প্রয়াত হয়েছেন সম্প্রতি) শোভনগোপাল দত্ত আমাকে জানিয়েছিলেন,

দাদু, ঠাকুর-দেবতা নিয়ে থাকতেন না। কিন্তু এই দিন অন্যরকম ছিল। আর ধর্ম নিয়ে, জাত নিয়ে এইসব ছুঁৎমার্গ পছন্দ করতেন না!

নাজির আহমেদ প্রসঙ্গে, বেশ কিছুদিন আগে একটি বেসরকারি বাংলা সংবাদমাধ্যমের অনলাইনে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে, ১৯৭৫ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত ভারতীয় রেডিও-য় কাজ করা তুহিনশুভ্র ভট্টাচার্য দাবি করেন,

সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি সম্পূর্ণ ভ্রান্ত, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত খবর ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে যে, ১৯৪২ থেকে ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত শ্রদ্ধেয় বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের জায়গায় জনৈক নাজির আহমেদ স্তোত্রপাঠ করেছিলেন। এটি সম্পূর্ণ ভুল।

ওই একই প্রতিবেদনে আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্রর অন্যতম আধিকারিক সুব্রত মজুমদার জানিয়েছিলেন,

রাত আড়াইটে-তিনটের মধ্যে শিল্পীরা ঢুকে যেতেন স্টুডিওয়। তারপর চারটে থেকে অনুষ্ঠান শুরু হত। এমনটা নয় যে চারটের সময় অনুষ্ঠান, আর শিল্পী দৌড়তে দৌড়তে চারটের সময় স্টুডিওয় ঢুকলেন। আমার ব্যক্তিগত ধারণা, ওই যে মাসখানেক ধরে রিহার্সাল হত, সেই রিহার্সালের কোনও একটি দিন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র হয়ত দেরি করে এসেছিলেন, বা দেরি হয়েছিল। অনেক সময়ে নাটকে যেমন প্রক্সি দেওয়া হয়, তেমন দেওয়া হয়েছিল হয়ত। সেটি অপভ্রংশ হয়ে এমন গল্পে দাঁড়িয়েছে।

এই প্রসঙ্গে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রর ভাবশিষ্য, নয়ের দশকের মহিষাসুরমর্দিনী-পর্বে (১৯৯৮-'৯৯), রামকুমার চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে যাঁর গলা শোনা যেত, সেই দেবাশিস চক্রবর্তী ইনস্ক্রিপ্ট-কে বললেন,

নাজির আহমেদ এটা করেছেন, এমন বিষয়ে জানি না। তবে হিন্দুধর্মের উদারতা আর সমসাময়িক সমাজে দাঁড়িয়ে এই উদ্যোগ অভিনব ছিল। বাদ্যযন্ত্রে অন্য ধর্মের আনাগোনা, সেই ইঙ্গিতই দেয়। যদিও আজও এই ঘটনা ঘটে। আমার সঙ্গেও এক বাদক ছিলেন মুসলমান। এসব নিয়ে চর্চা হয় না আসলে। আর তর্পণ করার যে মন্ত্র, সেখানেও তো এক সর্বজনীনতা রয়েছে। আব্রহ্মস্তন্তপর্য্যন্তং জগত্তৃপ্যতু, এখানে কি কোনও বিশেষ কারওর কথা বলা হচ্ছে! এই মহালয়া, এই অনুষ্ঠান সবটাই যেন তারই প্রতীক, উদার ধর্ম, এবং তার উদারতার প্রতিভূ।

প্রতি মুহূর্তে আকাশ ঘিরে থাকে কালো মেঘ। আলোর পরেই ঢাকতে থাকে সব। শত আলোকের ঝলকানিতে মাঝে মাঝেই ঢাকা পড়ে যায় এই অজানা-অখ্যাত সব খামতির কথা। যা অচিরেই ডুবিয়ে দেয় নিজের বেঁচে থাকাকে। কষ্টের অতলেই বারবার কড়া নাড়ে ধর্মীয় দুর্নীতি। যা প্রত্যেক মুহূর্তে আজও যেন বর্তমান। প্রত্যেক মুহূর্তে যা প্রভাবিত করতে চায় সব। কিন্তু চাইলেই খুব একটা পারা যায় না অনেক ক্ষেত্রেই। যেমন 'মহিষাসুরমর্দিনী'! যেখানেই যেন প্রতিফলিত হয় হিন্দু-ঘরে বিসমিল্লাহ-র সানাইয়ের সুর। যেখানে আবদুলের হাতের সবজি রান্না হয় গোপালের ভোগে।

More Articles