এক মাসে ৩২ লক্ষ বিয়ে! বাঙালির বিয়ে যেভাবে হয়ে উঠল 'ইভেন্ট'

Marriage Ceremony : বিবাহ নাকি জোরদার কোনো ইভেন্ট, প্রশ্ন উঠছে হাল আমলের বাঙালি বিয়ের রীতিকে ঘিরে

শীতের সন্ধ্যে, গোধূলি লগ্ন। বাতাসে ঘনিয়ে আসছে বিসমিল্লা… ফুল আর আতরের ম ম গন্ধে ভরপুর চারদিক। আমন্ত্রিতরা সবাই আসতে শুরু করেছে একে একে। সসজ্জিত বরের বাসর। অতঃপর ছাদনা তলায় জোড়া পানে মুখ ঢেকে হাজির হল কনে। তারপর একে একে নানা রীতি, আচার। এবং অবশেষে শ্রী শ্রী প্রজাপতয়ে নমঃ – কল্যাণীয়া ওমুকের সঙ্গে কল্যাণীয় তমুকের শুভবিবাহ সম্পন্ন হইল। ব্যাস তারপর রাত পোহালেই মেয়ে অন্য বাড়ি। বিবাহ বলতে এটুকুই ছিল চিরাচরিত বাঙালি রীতি। তবে সময় যতোই এগিয়েছে, আর সবকিছুর মতোই বাঙালি বিয়েতেও এসেছে আধুনিক অনুষঙ্গ। আর এই আসার শেষ যে ঠিক কোথায় তার হদিশ নেই। যান্ত্রিকতার অমোঘ টানে জর্জরিত একটা গোটা প্রজন্ম। আর বুঝি ফেরা সম্ভব নয়!

এবছর নভেম্বরের ১৯ তারিখ থেকে শুরু করে ডিসেম্বরের ১৫ পর্যন্ত পরপর শুধুই বিয়েবাড়ি। তারপর মাস খানেকের বিরতি, আবার শুরু বিয়ের তালিকা। নিদেনপক্ষে একখানাও নিমন্ত্রণ জোটেনি এমন বাঙালি খুঁজে পেতে গাঁ উজাড়! সমীক্ষা বলছে, এ বছর অগ্রহায়ণ মাসে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে নাকি প্রায় ৩২ লক্ষ বিবাহ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। সমীক্ষায় আরও জানা গিয়েছে, কেবল চলতি মরশুমে কলকাতা ও শহরতলি জুড়েই হতে চলেছে ৪০ হাজারেরও বেশি বিয়ে।

এই একঘেয়ে জীবনে আনন্দ করার সুযোগ এতোই কম পড়ে যে একটা উৎসবকে টেনে হিঁচড়ে দিন কয়েক বাড়িয়ে নিতে চান অনেকেই। তার ওপর তো বাঙালি বড়োই হ্যাংলা জাতি। যেখান থেকে যতটুকু দেখবে নিজের করে নিতে পারলেই হল। তাতেই হয়েছে এই দশা। বাঙালি বাড়ির বিয়ে এখন টানা সাতদিনের উৎসব। মেহেন্দি দিয়ে শুরু আর ভাংরা দিয়ে শেষ। যেন সব জাতি-ধর্মের মিলনস্থল বাঙালির এই বিয়ে বাড়ি। বিয়ে তো নয়, যেন একটা আস্ত ইভেন্ট। আর এই ইভেন্ট ঘিরেই চলছে মস্তু ব্যবসা। ডেকোরেটর, ব্যাঙ্কুয়েট হলের মালিক, ক্যাটারার থেকে শুরু করে ফটোগ্রাফার, মেকাপ আর্টিস্ট, গাড়ি সব মিলিয়ে দিন কয়েকের তোরজোড়। সবেতেই লম্বা খরচের ফিরিস্তি। জানা গিয়েছে, এবছর বিয়ের মরসুমে প্রায় ৩.৭৫ লক্ষ কোটি টাকার লেনদেন জড়িয়ে রয়েছে। একটি বিয়েকে কেন্দ্র করে টাকার হাতবদল হয় অনেকবার। আর এই বিয়ে নামক মরসুমি ব্যবসার দিকেই সারা বছর তাকিয়ে থাকেন হল মালিক, ক্যাটারের মালিক, ওয়েডিং ফটোগ্রাফার ও মেকআপ আর্টিস্ট সহ অনেকেই।

আরও পড়ুন : কনসার্ট থেকে বিয়েবাড়ি- নেই সেই আবাহন, হারিয়েই যাবে বিসমিল্লার ‘পাগলা’ সানাই?

বর্তমানে সোশ্যাল মিডিয়ার সৌজন্যে বলিউডের বিগ ফ্যাট ওয়েডিং এখন মুঠো ফোনে। অনুষ্কা শর্মার লেহঙ্গা, প্যাস্টেলরঙা ফুলের সাজ, বরমালা... ভাবী বাঙালি কনেদের মধ্যে অনেকেরই উইশলিস্টে এখন এইসবও। আর এর সঙ্গেই আর্থিক সঙ্গতির প্রশ্নটি গভীর ভাবে জড়িয়ে। শহরের একাধিক ওয়েডিং প্ল্যানারদের মতে, মেহেন্দি-সঙ্গীতের মতো অনুষ্ঠানেই এখন বেশি খরচ করার প্রবণতা বাঙালি পরিবারের। এই বিষয়ে একটি সমীক্ষা চালিয়েছে সিএআইটি রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেড ডেভেলপমেন্ট সোসাইটি। এই মাসে বাজারে মোট ৩.৭৫ লক্ষ টাকার লেনদেন হতে পারে বলে জানিয়েছে এই সোসাইটি।

এই সময় একটা মোটা অঙ্কের ব্যবসা হয় ঘরবাড়ি মেরামতির কাজে। এছাড়াও গয়না, শাড়ি, লেহেঙ্গা, আসবাবপত্র, রেডিমেড জামাকাপড়, জামা, জুতো, বিয়ের কার্ড, শুকনো ফল, মিষ্টি, ফল, পুজোর জিনিস, মুদিখানা, খাদ্যশস্য, সাজানোর জিনিসপত্র, ইলেক্ট্রিক্য়াল জিনিসপত্র, ইলেক্ট্রনিক্স ও অন্যান্য উপহার সামগ্রীর চাহিদাও থাকে খুব বেশি। আর আছে ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট সংস্থা। দায়িত্ব এড়াতে ওরাই এখন ভরসা। সবদিক সামলাতে তাই ডাক পড়ছে ওদের।

বাঙালির বিবাহকে আর নিছক অনুষ্ঠান বলা চলে না। দেশ বিদেশের যতরকম বিয়ে, তার সবকিছুই আছে এতে। বরং নিজেদের রীতিটুকুই হারাতে বসেছে। গায়ে হলুদ এখন ‘হলদি’, কন্যাবিদায় বলে না আর কেউই, তার জায়গায় এসেছে হিন্দি চালের ‘বিদায়ী’ অনুষ্ঠান। হিন্দি ‘কিউ কি’ যেভাবে বাংলায় ‘কেন কি’ শব্দবন্ধটির জায়গা পাকা করেছে হলদি, সঙ্গীত, মেহেন্দি কিংবা বিদায়ীও এসেছে ঠিক সেভাবেই। আর প্রাক বিবাহ পর্বের আয়োজনে এসেছে ব্যাচেলার্স পার্টির চল। যেন বলিউডি বিয়ের একটা ছোট সংস্করণ। আর বাঙালি বর-কনে যেন এক রাতের বাদশা-বেগম। এছাড়াও গত কয়েক বছরে পড়াশোনা বা চাকরি সুবাদে পঞ্জাবি, মারোয়াড়ি, বিহারি, তেলুগু, বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হচ্ছেন বাঙালিরা। ফলে সেই বিয়েতে দু’পক্ষেরই আবদার মেটাতে তৈরি হচ্ছে নয়া মিশেল। তাই খাদ্য তালিকাতেও জায়গা পাচ্ছে ফিউশন এখন খাঁটি বাঙালি পদ গায়েব। খাবারেও রয়েছে 'ভিনদেশি' ছোঁয়াচ। সাদা ধোঁয়া ওঠা ভাতের জায়গা নিয়েছে চিকেন বা মাটন বিরিয়ানি। আর লুচি-ছোলার ডালের জায়গায় নান-তরকা! মেনুতেও জায়গা হারাচ্ছে বাঙালিয়ানা।

যদিও মেহেন্দি বা সঙ্গীতের সঙ্গে সাবেকি বাঙালি বিয়ের সম্পর্ক নেই। আলতাকে ফুৎকারে সরিয়ে মেহেন্দি এখন জাঁকিয়ে বসেছে বাংলার বিয়েতে। গত কয়েক বছরে বিয়ে ঘিরে এই যে জাঁকজমক, তা নজর কাড়ছে সকলেরই। তবে এলাহি এই বিয়ে বাড়িগুলির মধ্যেই আবার কোথাও কোথাও চলছে ছক ভাঙার প্রয়াসও। সমাজের পুরনো রীতি ভেঙে মহিলা পুরোহিতদের পাকাপাকি জায়গা করে দিচ্ছে অনেকেই। সংস্কৃত মন্ত্র আর রবীন্দ্র সঙ্গীতের আবহে সারা হচ্ছে বিয়ে। সিঁদুর দান ঘিরেও এখন দু তরফের সমান ভূমিকা উঠে আসছে। একে অপরকে পরিয়ে দিচ্ছে সিঁদুর, কিন্তু এর ইতিহাস ঘেঁটে দেখছে কজন? এই যে সিঁদুর, শাঁখা কিংবা মল পরানোর অতীতে যে জড়িয়ে রয়েছে পিতৃতন্ত্রের ইতিহাস তা অস্বীকার করার জো নেই।

আরও পড়ুন : কোথাও বেদম প্রহার, কোথাও উদ্দাম চুম্বন || বিয়ের এসব লোকাচার জানলে বিস্মিত হবেন

বিয়ের এই ছবি তোলার শুরুটা হয়ে যায় প্রি-ওয়েডিং দিয়ে, চলে পোস্ট-ওয়েডিং পর্যন্ত। নানারকম নতুনত্ব দিয়ে আস্ত একটা প্যাকেজ সাজিয়ে তোলেন তাঁরা। কোথাও কোথাও আবার গল্প তৈরির প্রবণতাও লক্ষ্য করা যায় এই শিল্পকে ঘিরে। বিয়েতে এদের ভূমিকা মারাত্মক। প্রতিটা অনুষ্ঠানকে সাজিয়ে গুছিয়ে তুলে রাখছেন আগামীর স্মৃতি হিসেবে। বিয়ের ফটো সংস্কৃতিকে ঘিরেও তাই একটা বড় অঙ্কের ব্যবসা চলে।

রেজিস্ট্রার জেনারেল অফ ম্যারেজের কাছে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, এই মাসে শহর ও শহরতলিতে ইতিমধ্যেই প্রায় ২ হাজার বিয়ে সম্পন্ন হয়েছে৷ গোটা রাজ্যে এই সংখ্যা ৫ হাজারের কাছাকাছি। বিয়ের সংখ্যা বৃদ্ধির একটি বড় কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে দুই বছর পর করোনা বিধি নিষেধ উঠে যাওয়াকেই। কিন্তু এর পাশাপাশি যে দিকটা উঠে আসছে তা হল এতো কিছুর পরও বিবাহ বিচ্ছেদের ধুম। বিয়ের পাশাপাশি সেই সংখ্যাটাও রীতিমত ভাবাচ্ছে সকলকেই।

কিন্তু তার জন্য আনন্দে ফাঁকি দিলে চলবে কেন! পড়ে পাওয়া জীবনে ওটুকুই তো চোদ্দ আনা, থুড়ি ষোলো আনাই। অবাঙালি জাঁকজমককে আপন করতে গিয়ে কি বাঙালির নিজস্ব অনুষ্ঠান ফিকে হচ্ছে ঠিকই কিন্তু শিকড়ের টান এখনও পা চেপে ধরছে। তাই হয়তো পান পাতায় মুখ ঢেকেই কনে আসছে মণ্ডপে। মা ঠাকুমারা নিয়ত সতর্ক করে দিচ্ছেন পুরনো নিয়মগুলোকেও। তাই যতই বাঙালি বিয়ের মূল মন্ত্র হোক ‘মিলায়ে ও মিলিবে’, তবুও অবাঙালি উন্মাদনার সঙ্গে চেনা বাঙালিয়ানার ভারসাম্য থাকতেই হবে, কাম্য তো সেটাই।

More Articles