কোথাও বেদম প্রহার, কোথাও উদ্দাম চুম্বন || বিয়ের এসব লোকাচার জানলে বিস্মিত হবেন
Wedding Rituals: বিশ্বজুড়ে বিয়ে নিয়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে সব বিস্ময়কর লোকাচার।
বিবাহ নিয়ে বিশ্বজুড়ে মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার সীমা নেই। তবে অনেক সময়ই দেখা যায়, মানুষ যা চায় তার সিংহভাগই প্রচলিত লোকাচারের সামনে মুখ থুবড়ে পড়ে। বিয়ে নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে, বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যেই ভিন্ন ভিন্ন মত ও লোকাচার প্রচলিত। ভারতে যেমন ভাগ্যদোষ এবং বৈধব্য-যোগ এড়াতে হবু বধূকে বিয়ে দেওয়া হয় গাছের সঙ্গে, তেমনই বিশ্বজুড়ে বিয়ে নিয়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে সব বিস্ময়কর লোকাচার।
কন্যা বিদায়ে কান্নাকাটি
বিশ্বের প্রায় সব সংস্কৃতিতেই বিয়ের সঙ্গে কন্যাবিদায়ের ব্যাপারটি জড়িত। সেই জন্যই একদিকে বিয়ে যেমন খুশি আনন্দে মেতে থাকার দিন, তেমনভাবেই অন্যদিকে আবার বিয়ের শেষে নিজের সন্তানকে অন্যের ঘরে পাঠাতে গিয়ে কান্নাকাটির জোয়ার ওঠে কনের বাড়িতে। এই দৃশ্যর সঙ্গে কমবেশি আমরা সকলেই পরিচিত। কিন্তু চিনের কিছু জায়গায় এমন এক লোকাচারের কথা শোনা যায়, যেখানে বিয়ের একমাস আগে থেকে প্রতিদিন এক ঘণ্টা রুটিন করে বিয়ের কনে এবং পরিবারের অন্যান্য সকল সদস্যদের সশব্দে কান্নাকাটি করতে হয়। দক্ষিণ-পশ্চিম চিনের সিয়াচুন প্রদেশের অনেক অঞ্চলে এই প্রথার প্রচলন ছিল অনেককাল আগে থেকেই। আগে এই প্রথার তেমন জনপ্রিয়তা না পেলেও বর্তমানে তুজিয়া সম্প্রদায়ের লোকেরা এই কান্নাকাটির লোকাচারটি নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করে থাকেন। অঞ্চলের বয়স্ক লোকেদের কথায়, বহু যুগ আগে থেকে মনে করা হয়, বিয়ের কনে যদি এই লোকাচার না মানে, তবে নাকি তাঁর ভালো ঘরে বিয়ে হয় না অথবা বিয়ের পরের জীবন সুখের হয় না, ক্রমে সে সমাজে একজন হাসিঠাট্টার উপকরণে পরিণত হয়।
ইতিহাস বলছে, ৪৭৫-২২১ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে কোনও এক যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে ঝাঁঊ রাজ্যের রাজকন্যা যখন বিয়ে করে শ্বশুরবাড়িতে পাড়ি দেওয়ার জন্য রওনা দিয়েছিলেন, তখন ঝাঁউ রাজ্যের রানি, তাঁর কন্যার পায়ে ধরে কেঁদে রাজকুমারীকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সেই স্থান ত্যাগ করতে অনুরোধ করেছিলেন। সেই থেকেই নাকি বিয়ের আগে এই হাপুস নয়নে কাঁদার লোকাচারটি প্রচলিত। পশ্চিম সিয়াচুন অঞ্চলে এই লোকাচারটি পরিচিত ‘ঝাঁউ তাং’ নামে।
আরও পড়ুন: দেবতার যৌনতাকে বস্ত্রে ঢেকেছে মানুষ, শ্লীল অশ্লীলের বেড়া ভেঙেছেন রহস্যময়ী লজ্জা গৌরী
চমৎকার চুম্বন
‘You may kiss the bride’– খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের বিয়েতে এই লোকাচারটি না হলে বিয়ে একেবারে অসম্পূর্ণ বলা চলে। কিন্তু সুইডেনে এই চুম্বনকে ঘিরেই রয়েছে অন্য এক ধরনের লোকপ্রথা। এই প্রথা অনুযায়ী বিয়ের সম্পন্ন হওয়ার ঠিক পরেই কনের আশেপাশে আর বরের টিকিটিও দেখা যাবে না। সদ্য বিয়ে করা বউকে ছেড়ে বরকে চলে যেতে হবে অন্য ঘরে আর সেই সময় পাত্রীকে চুম্বন করবে অবিবাহিত তরুণ সব ছেলেরা। অন্যদিকে আবার একইভাবে পাত্রীর বান্ধবীরা বরের সঙ্গেও একই কাজ করার সুযোগ পেয়ে থাকে।
হাসতে মানা
‘রাম গরুড়ের ছানা, হাসতে তাদের মানা/ হাসির কথা শুনলে বলে, হাসবো না না না না’- সুকুমার রায়ের লেখা এই বিখ্যাত ছড়ার সঙ্গে আমরা সবাই পরিচিত। কিন্তু একবার ভাবুন তো, এই কঠিন আইন যদি আপনার বিয়ের দিন প্রয়োগ করা হয়, তবে আপনার কী অবস্থা হবে! বর্তমানে গোটা বিশ্বে, বিশেষ করে ভারতীয়রা প্রি-ওয়েডিং থেকে শুরু করে পোস্ট ওয়েডিং ফটোশুটের জন্য যেখানে লক্ষ লক্ষ টাকা উড়িয়ে দেয়,।আপনাকে যদি বলা হয় এই একটি ছবিতেও আপনি হাসতে পারবেন না, তবে কিন্তু লক্ষ টাকা প্রায় ব্যর্থই হলো বলা চলে। কিন্তু আফ্রিকার কঙ্গোতে প্রচলিত রয়েছে এমনই একটি লোকাচার, যেখানে বিয়ের বিষয়টিকে গাম্ভীর্য প্রদানের জন্য, বিয়ের দিন বর-কনে চাইলেও একটিবারের জন্যও হাসতে পারবে না, এমনকী, প্রি-ওয়েডিং ফটোশুটের সময়ও তাদের হাসতে মানা। কঙ্গোর এই অঞ্চলের বসবাসকারীরা মনে করেন, যদি বর অথবা কনে বিয়ের দিন হাসাহাসি করে, তবে তারা আসলে বিয়ের ধারণাটাকেই কোথায় যেন ব্যঙ্গ করছে, বিয়ে মানে যে এক দায়িত্ব পালনের আশ্বাস- সেই বিষয়টিকেও তারা বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে না। যদিও এই অচলাবস্থা এখন খানিকটা দূর হয়েছে।
প্লেট ভাঙচুর
গ্রিস দেশে বিয়ের শেষে আবার খাবার-প্লেট ভাঙার একটি প্রথা প্রচলিত রয়েছে। গ্রিসে কোনওকিছুর শুরুতে এবং কোনওকিছুর সমাপ্তিতে এই প্লেট ভাঙার প্রথাটি প্রচলিত। মৃত্যুতে যেহেতু মানুষের জীবনযাত্রার সমাপ্তি ঘটে, তাই মৃত্যুর দিনেও পরিবারের সদস্যরা প্লেট ভেঙে থাকেন। আবার অন্যদিকে বিয়ের মাধ্যমে যেহেতু একটি নতুন জীবনের পথ চলা শুরু হয়ে থাকে, তাই এই দিনেও নবদম্পতি-সহ পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা দুষ্ট আত্মার প্রকোপ থেকে নিস্তার পাওয়ার উদ্দেশ্যে অসংখ্য খাবার প্লেট ভেঙে থাকেন। অন্যান্য জায়গায় আবার দুষ্টু আত্মার প্রকোপ থেকে নয়, বরং নবদম্পতির সম্পর্ক মজবুত করার স্বার্থে বিয়ের পর তাদের বাসগৃহে গিয়ে অতিথিরা নিজের ইচ্ছেমতো প্লেট ভাঙে, যা দম্পতিদের একসঙ্গে পরিষ্কার করতে হয়। তবে গ্রিসের বিভিন্ন জায়গায় এই প্লেট ভাঙা এক জনপ্রিয় ট্রেন্ডে পরিণত হয়েছে। বিভিন্ন হোটেল কিংবা রেস্তোরাঁগুলিতেও এখন এর ব্যবস্থা করা হয়। তবে বর্জ্যবস্তু এবং সুরক্ষার কথা মাথায় রেখে মাটির প্লেট তৈরি করা হয়ে থাকে, যা পরবর্তীকালে পুনর্ব্যবহারযোগ্য।
উত্তমমধ্যম
দক্ষিণ কোরিয়ায় আবার বিয়ে নিয়ে খানিক নিষ্ঠুর লোকাচার প্রচলিত রয়েছে। এখানে বিয়ে সম্পন্ন হওয়ার পর, নিজের বউকে নিজের সঙ্গে নিয়ে যেতে গেলেই পাত্রকে প্রস্তুত থাকতে হয় প্রহার সহ্য করার জন্য। হ্যাঁ, বরের পায়ে প্রহার করা হয় মরা মাছ কিংবা লাঠির সাহায্যে। এই লোকাচারের মাধ্যমে নাকি পাত্রের সহনশীলতার পরীক্ষা নেওয়া হয়ে থাকে। আবার প্রহার করার সময়েই তাকে সম্মুখীন হতে হয় অসংখ্য প্রশ্নর, যার দ্বারা আবার তার চারিত্রিক স্বচ্ছতা যাচাই করা হয়ে থাকে।
চুনকালি
বর্তমান সময়ে বিয়ের আগে সাধারণত হবু বধূদের বেশিরভাগ সময় কাটে বিউটি সেলুনে। কিন্তু একবার ভাবুন তো, হাজার হাজার টাকার ফেসিয়াল কিংবা স্পা করানোর পর যদি আপনার বন্ধুবান্ধবরা আপনার সারা দেহে কালো রং লেপে দেয়, তাহলে আপনার কেমন লাগবে! স্কটল্যান্ড এবং উত্তর আয়ারল্যান্ডে কিন্তু এরকম অদ্ভুত একটি লোকাচার প্রচলিত রয়েছে, যেখানে বিয়ের কিছুদিন আগে কিংবা ঠিক আগের দিনই হবু দম্পতিকে তাদের বন্ধুবান্ধবরা প্রায় তুলে নিয়ে গিয়ে সারা দেহে লেপে দেয় কালো রং। মনে করা হয়, কালো রঙের মাধ্যমে অশুভ শক্তির বিনাশ সাধন সম্ভব হবে এবং দম্পতির আগামী জীবন হবে সুখের।
বাথরুমে যাওয়া নিষেধ
মালয়েশিয়া এবং ইন্দোনেশিয়ায় টেডং জাতির মানুষদের মধ্যে বিয়ের পরে নব-বিবাহিতদের জন্য প্রচলিত রয়েছে এক শাস্তিমূলক প্রথা। টেডং গোষ্ঠীর মানুষদের মধ্যে বিয়ের পর তিনদিন বাথরুম যেতে না পারার লোকাচারের প্রচলন রয়েছে। বিয়ের পর এই তিনদিন তারা যাতে অল্প খাবার গ্রহণ করে, তাই তাদের ওপরে পাহারার ব্যবস্থাও করা হয়ে থাকে। এটি নাকি নবদম্পতির সৌভাগ্য প্রাপ্তির উদ্দেশ্যে করা হয়ে থাকে। টেডং জাতির লোকেরা বিশ্বাস করেন, এই লোকাচারের মাধ্যমে বিবাহ-বিচ্ছেদ কিংবা সন্তানের মৃত্যু প্রতিরোধ করা সম্ভব।