শারদীয় আবহে অসুরের পুজো! বাংলাতেই রয়েছে এই প্রথা

আশ্বিনের উষালগ্নে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের 'মহিষাসুরমর্দিনী' পাঠের মধ্য দিয়েই আপামর বাঙালি মেতে ওঠে দুর্গাপুজোয়। ঘরের মেয়ে স্বামীর বাড়ি ছেড়ে নিজের বাড়িতে পা রাখলে আনন্দ হয় বইকি! আর এ তো শুধু মা দুর্গার ঘরে ফেরা নয়, তার সঙ্গে সঙ্গে পিতৃপক্ষের সমাপ্তি এবং মাতৃপক্ষের সূচনালগ্নও বটে। আর বছরের এই একটা সময় বাংলার আকাশ-বাতাস যে আনন্দে হিল্লোলিত হবে সে তো জানা কথাই।

তবে শুধুমাত্র উৎসব নয়, দুর্গাপুজোর এই চারটে দিনে অশ্রুসজল হয়ে ওঠে বাংলার অনেক মানুষের চোখ। উত্তরবঙ্গের চা বাগান থেকে পুরুলিয়ার প্রত্যন্ত অঞ্চলের অধিবাসীরা দুর্গাপুজোর এই চারটে দিনে বাংলা ও বাঙালির থেকে যেন বিচ্ছিন্ন হয়ে যান এক লহমায়। কিন্তু এর কারণ কী? কেন এমন আনন্দ উৎসবে শামিল হতে পারেন না তারা? 

উত্তরবঙ্গের একটি চা বাগান। পুঁজিবাদী মালিক আর নিষ্পেষিত শ্রমিক শ্রেণির ভেতরের পার্থক্য ভীষণ প্রকট এইসব অঞ্চলে।রোজ ভোর হওয়ার আগেই শুরু হয় এইসব চা শ্রমিকের সংসার-সীমান্তের লড়াই। চা পাতা তোলা থেকে তাকে বাণিজ্যের উপযুক্ত করে তোলা, সব কাজেই মালিক শ্রেণি প্রচণ্ডভাবে নির্ভরশীল এই সব শ্রমিকদের ওপরেই। কিন্তু এইসব শ্রমিকদের দুর্দশার সাতকাহন কোনওদিনই হয়তো পৌঁছয় না মালিক শ্রেণির কানে।ফলে দিনবদলের স্বপ্ন এদের কাছে বিলাসিতার নামান্তর।

আরও পড়ুন: অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী, জীবন কাটিয়েছেন ভবানী মায়ের সাধনায় || ভবাপাগলা আজও মানুষের মনে

দুর্গাপুজো যতই কাছে এগিয়ে আসে, ততই মন ভারী হয়ে আসে আলিপুরদুয়ারের চা বাগানের এইসব শ্রমিকদের। প্রকৃতপক্ষে এই চা বাগানের শ্রমিকদের পদবি 'অসুর'। এরা অনার্য গোষ্ঠীর মানুষ। ইতিহাস বলে, আর্যরা অনার্যদের আক্রমণ করলে সেই আক্রমণকে বারংবার প্রতিরোধ করেছে এদের পূর্বপুরুষরা। কিন্তু আর্য সংস্কৃতি ধীরে ধীরে রক্তে মিশে যায় এসব মানুষের। এই কারণেই মহিষাসুর তাদের কাছে কখনওই অশুভের বা পিতৃতান্ত্রিক সমাজের প্রতিভূ হয়ে ওঠেননি, বরং সর্বদাই তিনি পেয়েছেন শহিদের মর্যাদা। নৃতাত্বিক গবেষণায় উঠে আসে বেশ কিছু চমকপ্রদ তথ্য। এই 'অসুর' পদবির মানুষেরা আসলে অস্ট্রিক গোষ্ঠীভুক্ত। এমনকী, ১৯৯১ সালের জনগণনা থেকে জানা যায়, এদের সংখ্যা প্রায় ৪৮৬৪ জন। দুর্গা এদের কাছে কোনও দেবী নয়, দুর্গা এখানে পরিচিত তাদের পূর্বপুরুষের হত্যাকারী রূপে। ফলে দুর্গাপুজোর চারটে দিন এখানকার মানুষের পরনে ওঠে সাদা থান, শোকপালনের অঙ্গ হিসেবে অনেকের বাড়িতে অনুষ্ঠিত হয় অরন্ধন, অনেকে নিজের বাড়ি ঢেকে রাখেন কালো কাপড়ে।

তবে শুধুমাত্র উত্তরবঙ্গের চা বাগান নয়। অসুরের আরাধনা করেন বর্ধমানের আউশগ্রামের বাসিন্দারাও। তাছাড়া শালবনির কুরমি সম্প্রদায়ভুক্ত অধিবাসীদের মধ্যেও প্রচলিত আছে অসুর আরাধনা।

কিছু বছর আগে খাস কলকাতার বুকেও আয়োজন করা হয়েছিল অসুরপুজোর। গড়িয়ার প্রকৃতি সেবাশ্রম সংঘ-এর কর্মকর্তারা ছিলেন এর মূল উদ্যোক্তা। তাঁদের অনেকেই আগ্রহী অনার্য সভ্যতা নিয়ে। ফলে তাঁরাও মনে করেন, অসুর কোনও অশুভ শক্তি নয়, তিনি শহিদ, অন্যদিকে দুর্গা তাঁদের কাছেও পরিচিত একজন হত্যাকারী হিসেবে। তবে আশ্চর্যের কথা, অসুর আরাধনা হলেও শহরবাসীর কাছে ব্রাত্য হয়ে যায়নি এই পুজো, বরং নতুনত্বের স্বাদ পেয়ে তাকে সাদরে অভ্যর্থনা জানায় কল্লোলিনী তিলোত্তমা।

তবে, বাংলা ও বাঙালি যখন থাকে ব্যস্ত মাতৃপক্ষের আরাধনায় তখনই নিঃশব্দে নিজেদের গুটিয়ে নেন আলিপুরদুয়ারের চা বাগানের শ্রমিক অথবা পুরুলিয়ার আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষরা। হ্যাঁ, দুর্গা আজও তাদের কাছে ব্রাত্য। 

মায়ের আগমন থেকে অষ্টমীর সন্ধিপুজো- সমগ্র বাংলা যখন ঘরের মেয়ের ঘরে ফেরার অনাবিল আনন্দ উদযাপনে ব্যস্ত, ঠিক সেই সময় উত্তরবঙ্গ অথবা পুরুলিয়ার মানুষগুলোর চোখ ভিজে ওঠে নিঃশব্দে। বারো মাসে তেরো পার্বণ হয়তো বাঙালির রক্তে, কিন্তু দুর্গাপুজোর দিনগুলোতেই ব্যতিক্রমী ভূমিকা পালন করে পুরুলিয়া, বর্ধমান অথবা উত্তরবঙ্গের মাটি। কেউ মেতে ওঠেন পূর্বপুরুষ অসুরের আরাধনায়, কেউ বা ব্যস্ত হয়ে পড়েন পূর্বপুরুষের মৃত্যুর, শহিদের মৃত্যুর শোকপালনে।

More Articles