অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী, জীবন কাটিয়েছেন ভবানী মায়ের সাধনায় || ভবাপাগলা আজও মানুষের মনে

তুমি কি ভেবেছো মনে,এই ত্রিভুবনে,
তুমি যাহা করে গেলে কেহ জানে না
বারে বারে আর আসা হবেনা,
বারে বারে আর আসা হবেনা।
এমন মানব জনম আর পাবেনা
বারে বারে আর আসা হবেনা।

এই লেখা ভাবের পাগল, প্রেমোন্মাদ, ভবানীমায়ের প্রিয় সন্তান ভবাপাগলা-র। বাউল কথাটির একটি অর্থ 'পাগল'।

কেহ ধনে কেহ মনে
কেউবা পাগল ভাবের টানে
তন্ত্র মন্ত্র নাহি মানে তারা
লাগায় শুধু প্রেমের ল্যাঠা

কথাগুলি পদকর্তা মনমোহন দত্ত তাঁর নিজের ভাষায় লিখেছেন।তবে একথা সত্য যে, ভবাপাগলাকে সম্পূর্ণ রূপে বাউল বলা যায় না।কারণ তাঁর গানে ভক্তিরস থাকলেও,বাউল ধর্মের প্রভাবকে তিনি প্রকট হতে দেননি। তিনি ভবানী মায়ের চরণতলে বসে রচনা করে গেছেন অসাধারণ কিছু গান।প্রকৃত সাধক ছিলেন তিনি। হালকা-পাতলা দেহ, মাথায় ঘন ঝাঁকড়া চুল, চিবুকে একগোছা দাড়ি। অতি প্রিয় তাঁর এই চেহারা ভক্তদের মনে আঁকা হয়ে আছে।

আনুমানিক ১৯০২ খ্রিস্টাব্দে (মতান্তরে ১৮৯৭ সালে) ভবাপাগলা ঢাকার কাছে আমতা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম ছিল গজেন্দ্রমোহন রায়চৌধুরী (মতান্তরে সাহা চৌধুরী), মাতা গয়াসুন্দরী দেবী চৌধুরানী। ভবার নিজের কথায়-


পূর্ববঙ্গে ঢাকার গর্ভে
গর্বিত গ্রাম আমতা।
সেই গাঁয়ে জন্ম মোর,
পিতা গজেন্দ্র,গয়ামাতা।
বাঁচন মরণ এই দুই কূল,
সমাজ অমরধাম।
সেই সমাজের অধিকারী মুই
ভবা পাগলা মোর নাম।

তিন ভাই ও তিন বোনের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ ভবেন্দ্রমোহন (ভবাপাগলা) ও দেবেন্দ্রমোহন (যমজ ভাই)। ছোটবেলায় তিনি লেখাপড়ার থেকে মন্দিরে বেশি সময় কাটাতে পছন্দ করতেন।মাত্র পনেরো বছর বয়সে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় লেখাপড়ায় ইতি টানেন। জন্মভিটে আমতার পার্শ্ববর্তী গ্রাম পাকুটিয়া স্কুলে পড়ার সময় গড়ে তুলেছিলেন নিজের কীর্তন দল। তাঁর সুললিত কণ্ঠে গান এবং অমায়িক ব্যবহার সকলকে মুগ্ধ করত। তিরিশ বছর বয়সে মা গয়াসুন্দরী দেবী গ্রামেরই এক দশম বর্ষীয়া বালিকা শৈবালিনীর সঙ্গে তাঁর বিবাহ দিলেন। তখন তিনি রীতিমতো সাধক কবি। তাঁকে ঈশ্বররূপে পূজো করত তাঁর ভক্তবৃন্দ। একবার নন্দলাল দাস নামের এক ব্যক্তি দুরারোগ্য ব্যাধি নিয়ে ভবার ভবনে হাজির হন। তাঁর বিশ্বাস ভবাপাগলা তাঁকে ছুঁয়ে দিলেই তাঁর ব্যাধি দূর হবে। অটুট বিশ্বাস দেখে মুগ্ধ ভবা নন্দলালকে স্পর্শ করলেন। আশ্চর্যভাবে সে ব্যধিমুক্ত হলো।ভবার অলৌকিক ক্ষমতার কথা তখন ছড়িয়ে পড়েছে চতুর্দিকে।দলে দলে দর্শনপ্রার্থী তখন ভবার ভবনে আসতে শুরু করলেন।ভবাপাগলার ভক্তগণের মধ্যে মুসলমান ভক্তেরও খামতি ছিল না। তিনি জাতপাত মানতেন না। তাঁর বাণী ছিল,

মায়ের কাছে সবাই সমান,কিবা হিন্দু,কিংবা মুসলমান।

তিনি বলতেন-


যারা ছোঁয়াছুঁয়ির ধার ধারে না, তারাই ভবার গৌরসুন্দর।

 

ছোটবেলা থেকেই ভবা ছিলেন কালীভক্ত,এটা কিছুটা পারিবারিক কারণেই হয়েছিল। তাঁর পরিবারের সকলেই ছিলেন কালীভক্ত। ধামরাইয়ে নিজের বাড়িতে মাত্র পনেরো বছর বয়সে একটি কালী মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি সেই কষ্টিপাথরে তৈরি মূর্তিটিকে সঙ্গে নিয়ে ঘুরতেন। যেখানেই যেতেন সঙ্গে নিয়ে যেতেন মা ভবানীর সেই মূর্তি। পরবর্তীতে এই কালী মূর্তি 'ভবার ভবানী' নামে খ্যাত হয়। দুই বাংলায় তিনি মোট ৭টি মন্দির স্থাপন করেন।লালন ফকির ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো ভবার গানেও মিশে থাকে বিষাদ-অভিমান, আনন্দ-ভালবাসা। পুঁথিগত বিদ্যায় অষ্টম শ্রেণির চৌকাঠ না পেরনো মানুষটা জীবনে প্রায় দশ হাজার (মতান্তরে ছিয়াশি হাজার) গান রচনা করে গেছেন।ভক্তিভাব ও সকলের প্রতি ভালবাসা এবং মার্জিত ও কোমল ব্যবহার ছিল ভবার পরিচয়। তিনি বলতেন, মনের শুচিতাই আসল শুচি। নিত্য 'প্রসবিনী মা' আমাদের, প্রতিটি মুহূর্ত আমাদের জন্ম দিয়ে চলেছেন তিনি। কখনও কোনও সন্তানকে বলবেন না যে, ওরে স্নান করে শুচি হয়ে আয়... তিনি তো মা, সদা-সর্বদা বুকে টেনে নেবেন আমাদের। তাই তিনি অক্লেশে লিখেছেন, 'দূর করে দে মনের ময়লা'।

১৯৪৭ সালে, ভারত স্বাধীন হওয়ার সময় দেশভাগ হল। ভবা বুঝতে পারলেন, এবারে বাংলাদেশে আর থাকা যাবে না। তিনি পুত্র-সহ পরিবারকে কলকাতায় দাদা গিরীন্দ্রমোহনের কাছে পাঠিয়ে দিলেন। এরপর একমাস পরে বাংলা সনের ১৩৫৭-য়, আষাঢ় মাসের একদিন তিনি নিজ বাসভবন ছেড়ে পাড়ি দিলেন ভারতে। সঙ্গে ছিল তাঁর অতি প্রিয় ও ঘনিষ্ঠ ১৫ জন সঙ্গী এবং তাঁর কষ্টিপাথরের ভবানী মা। অনেক ঘুরে ঘুরেও কোথাও জায়গা পছন্দ হয় না তাঁর। অবশেষে ভাগীরথীর তীরে কালনার জাপট-এ পুরনো হাসপাতাল পাড়ায়, স্বত্বাধিকারী নিমাই সাহার কাছ থেকে ১৭০ টাকায় ১ বিঘা জমি কিনে নেন।এখানেই তাঁর মনের মতো করে মাতৃ আরাধনা আরম্ভ করেন। প্রথমে খড়ের ছাউনির আটচালা বেঁধে সেখানেই সাধনা শুরু করেন। এরপর
ভক্তদের দানে ১৯৫১ সালে তৈরি হয় মাতৃমন্দির।

বাইবেল কোরান নয়রে প্রভেদ,
শোন রে হিন্দু শোন মুসলমান
ছেড়ে দে তোর ভিন্ন ভেদ
দেখনা শাস্ত্র দেখনা বেদ

এই ছিল তাঁর প্রাণের কথা, মনের আলাপ। সংগীতের সাধনা এবং মাতৃ আরাধনায় জীবন উৎসর্গ করে গেলেন এই মহাপুরুষ।তিনি ছিলেন আসলে এক ক্ষণজন্মা পুরুষ, একাধারে গীতিকার, সুরকার এবং গায়ক। অসাধারণ বেহালা বাজাতেন, হারমোনিয়াম তাঁর হাতে যেন কথা বলত। সৃষ্টি করে গেছেন শ্যামাসংগীত, বাউল গান, গুরুতত্ত্বের গান, দেহতত্ত্বের গান, সৃষ্টিতত্ত্বের গান, রাধাকৃষ্ণের সহজিয়া বৈষ্ণবতত্ত্বের গান আবার সুফি মারফতি দর্শনের গান। ধর্মবিশ্বাসের নিরিখে তাঁকে কোনও একটি নির্দিষ্ট ধারায় ফেলা অসম্ভব।

জনশ্রুতি শোনা যায় গভীর রাতে ভবার ভবনী 'মা',তাঁর সাথে কথা বলতেন। মন্দিরের গর্ভগৃহের ভিতরে নূপুরের মিষ্টি ধ্বনী শোনা যেত।আমার ছোট বয়সে এই সঙ্গীত পাগল মানুষটিকে খুব কাছের থেকে দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছিলো। ঘটনাটি হলো, আমার সঙ্গে আশ্রমের কিছু মেয়ে পড়াশোনা করতো। তাদের সঙ্গে কিছু বন্ধু মিলে ছুটির পরে প্রায়ঃশই আশ্রমে চলে যেতাম। ওনার কোলে বসে একটি গান শেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল।

ভবাপাগলার পরনে লাল ধুতি ও নীল উত্তরীয় দেখে মনে হত, ঠিক যেন অবধূত সন্ন্যাসী। ভবা সংসারের মায়ার বাঁধনে থেকেই লীলা করেছেন কিন্তু চেতন থেকেছেন। তাঁর কালী মাতা 'ভবার ভবানী' নামে খ্যাত, মন্দিরটিকে বলা হয় 'হরবোলা'।

১৯৮৪ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি ভবা তাঁর ভবানী মায়ের রাঙা চরণে আশ্রয় গ্রহণ করেন।২৭ তারিখ তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়। তাঁর সমাধিস্থলে লেখা আছে- 'মহাযোগে মহাযোগী'।



মাগো মা ছুটি দেবে কবে
তুমি যা বলেছ তাই করেছি
আমায় বাড়ী যেতে হবে

More Articles