নববর্ষ শুধু বাঙালির নয়, বিশ্বজুড়ে যেভাবে চলে বৈশাখী আবাহন

শুভ বৈশাখ পাঠায়েছে ডাক
মেলিয়াছে ফুলসাজি
নব অনুরাগ প্রীতির সোহাগ
জানাই তোমায় আজি।


নববর্ষ, নতুন বছর এবং নতুন সালের শুভারম্ভের দিন। পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এই দিনটি পালিত হয়। কিন্তু এইদিন শুধু মাত্র বঙ্গাব্দের সূচনা বা বাঙালির বর্ষবরণ নয়। এইদিন মায়ানমার, থাইল্যান্ড, লাওস ও কম্বোডিয়া, শ্রীলঙ্কা, তামিলনাড়ু, কেরল, পাঞ্জাব, আসাম, উড়িষ্যা, নেপাল, বিহার, ঝাড়খণ্ড... এই সব দেশের নববর্ষ বরণের দিন।

পশ্চিমবঙ্গ

পয়লা বৈশাখ আপামর বাঙালির অতি প্রিয় একটি দিন।বঙ্গাব্দের এই প্রথম দিনটিতে উৎসাহ ও উদ্দীপনার সঙ্গে বর্ষবরণ অনুষ্ঠান পালিত হয় নানা স্থানে। সকাল বেলা স্নান করে বাড়িতে পূজার্চনা ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান গুলি গনেশপুজোর মধ্য দিয়ে দিন শুরু করেন।এই দিন থেকে ব্যবসায়ীরা তাঁদের ব্যবসার হিসেবের নতুন খাতার উদ্বোধন করেন, অনেকেই একে 'হালখাতা' বলে থাকেন। এই দিনে বাড়িতে বাড়িতে এবং ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে মিষ্টিমুখ করানো হয়।এই দিন বাঙালি তার ঐতিহ্যবাহী পোশাকে (ধুতি, পাঞ্জাবি ও শাড়ি) সেজে ওঠে।

আরও পড়ুন: গাজন থেকে বেসমা পুজো, গ্রাম থেকে শহরে – বৈশাখ যে ভাবে আসে

পাঞ্জাব
পাঞ্জাবে নববর্ষকে বৈশাখী বলা হয়। সাধারণভাবে ১৩ এপ্রিল বা ১৪ এপ্রিল দিনগুলোকে হিন্দু ও শিখ সম্প্রদায়ের মানুষ সৌর নববর্ষ হিসেবে পালন করেন। শিখ সম্প্রদায়ের মানুষ এই দিনে নগরকীর্তন করেন, বিভিন্ন সামাজিকতা ও উৎসবের মধ্য দিয়ে এই পার্বণ পালিত হয়। পাঞ্জাব অঞ্চলে ঘটে যাওয়া ইতিহাস-প্রসিদ্ধ ঘটনাগুলোও পালন করা হয় এই সময়। যেমন, ১৮০১ সালের ১২ এপ্রিল রঞ্জিত সিং শিখ সাম্রাজ্যের মহারাজা ঘোষিত হন, এই বৈশাখেই ঘটে কুখ্যাত জালিয়ানওয়ালাবাগের ঘটনা, এই এপ্রিলেই দশম গুরু 'গুরুগোবিন্দ সিং' (১৬৯৯) 'খালসা' জন্মকে চিহ্নিত করেন। 'বৈশাখী' প্রধানত একটি শিখ উৎসব। অনেকেই এইদিন ঝিলম, কাবেরী ও গঙ্গা নদীতে স্নান করে পবিত্র হন।


কেরল ও কর্নাটক

কেরল ও কর্নাটকে বৈশাখ মাসের প্রথম দিনটি নববর্ষ হিসেবে পালন করা হয়। এখানে এই উৎসবটিকে বলা হয়, 'ভিষু'। এই দিনে স্থানীয় মানুষ বিভিন্ন ধরনের আনন্দ ও উৎসবের আয়োজন করেন। কেরল ও কর্নাটকে এই উৎসব পালনের রীতির মধ্যে প্রচুর মিল খুঁজে পাওয়া যায়। যদিও কেরলের জাতীয় উৎসব 'ওনাম', কিন্তু ভিষু উৎসবেও উৎসবের জোয়ারে ভাসে সকলে।

উড়িষ্যা

নববর্ষ দিনটি উড়িষ্যাবাসীর কাছে, 'পান সংক্রান্তি' নামে খ্যাত। নতুন বস্ত্রে সজ্জিত হয়ে উৎকলবাসী বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এই দিনটি পালন করে থাকেন।

আসাম

নববর্ষকে আসামে বলা হয়, 'বেহাগ বিহু'। আসামের নানান স্থানে মেলা বসে এবং পশ্চিমবঙ্গের মতোই ব্যবসায়ীরা হালখাতা, পূজার্চনা,ও কুশল বিনিময় করে থাকেন।মিষ্টিমুখের মাধ্যমে শুভেচ্ছা বিনিময় হয়।

তামিলনাড়ু
তামিলনাড়ুতে নববর্ষকে বলা হয় 'পুথান্দু বা পুঠান্ডু'। শ্রীলঙ্কার সঙ্গে এদের অনুষ্ঠানের প্রচুর সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়।এখানে ১৪ এপ্রিল নতুন বছর পালন হয়। নানারকম পিঠা, পায়েস, মিষ্টি, পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে বিনিময় করেন। বিনোদন হিসেবে এখানে বিভিন্ন খেলাধুলো ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়। খেলাধুলোর মধ্যে গরুর দৌড় ও কাদা ছোড়াছুড়ি খেলা উল্লেখযোগ্য।

বাংলাদেশ
গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জি অনুসারে বাংলাদেশে প্রতি বছর ১৪ এপ্রিল নববর্ষ উদযাপন করা হয়।বাংলা একাডেমি কর্তৃক নির্ধারিত আধুনিক বাংলা পঞ্জিকা অনুসারে এই দিনটি নির্ধারিত করা হয়েছে। এইদিন বাংলাদেশে হালখাতা অনুষ্ঠিত হয়। এই দিন বাংলাদেশের একটি ঐতিহ্য হলো, পান্তাভাত খাওয়া। পশ্চিমবঙ্গের মতোই শুভেচ্ছা বিনিময় হয় 'শুভ নববর্ষ' বলে।প্রতি বছর এই দিন বাংলাদেশে 'মঙ্গল শোভাযাত্রা'-র আয়োজন করা হয়। ২০১৬ সালে ইউনেস্কো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক আয়োজিত এই শোভাযাত্রাকে, 'মানবতার অমূল্য সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য' হিসেবে ঘোষণা করেছে। ১৯৬৭ সাল থেকে 'ছায়ানট' নামের এক বিখ্যাত গানের দল প্রতি বছর বর্ষবরণ করে আসছে রমনা বটমূলে।

মায়ানমার
মায়ানমারের নববর্ষকে স্থানীয়ভাবে 'থিংইয়ান' নামে ডাকা হয়ে থাকে। বার্মিজ ভাষায় এর অর্থ 'পরিবর্তন' বা 'এক স্থান থেকে অন্যত্র স্থানান্তর'। নববর্ষের দিনটি সৌর এবং চন্দ্রপঞ্জিকার গণনা অনুসারে স্থির করা হয়। থিংইয়ানের দিন মায়ানমারজুড়ে জল-উৎসব (পানি উৎসব) হয়। এটি পৃথিবীর সবচেয়ে পুরনো ও পবিত্র জল-উৎসব (পানি উৎসব)। ৫০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে পালন হচ্ছে এই উৎসব। দেশের মানুষের বিশ্বাস, যত বেশি জলের ধারা শরীর স্পর্শ করবে,তত বেশি দুঃখকষ্ট দূর হবে এবং শান্তি আসবে জীবনে।

থাইল্যান্ড

থাইল্যান্ডের 'সংক্রান' উৎসবটি বহু প্রাচীন। সংক্রান শব্দটি এসেছে সংস্কৃত ভাষা সংক্রান্তি থেকে। এই সময় দেশে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়। থাইল্যান্ড এবং মালয়েশিয়ান সিয়ামিজ গোত্রের মানুষই সাধারণত ধর্মীয় রীতি মেনে এই উৎসব পালন করেন। এই উৎসবের প্রধান আকর্ষণ পানি উৎসব।

শ্রীলঙ্কা
সিংহল বা শ্রীলঙ্কায় নববর্ষকে 'আলুথ আবুরুদ্ধা' বলা হয়। এই দিন সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয়। ১৪ এপ্রিল নববর্ষ উদযাপন করা হয়, কিন্তু উৎসব চলে এক সপ্তাহ ধরে। সৌর পঞ্জিকা অনুসারে উৎসব পালিত হয়, কিন্তু নতুন চাঁদের হিসেবে দিন নির্ধারিত হয়। উৎসবে নানা রকম মিষ্টি, পিঠে, পায়েস, ক্ষীর ইত্যাদি বানানো হয়। বিভিন্ন খেলাধুলা ও প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো, গরুর দৌড়, ডিম ছুড়ে দেওয়া খেলা (হাওয়ায় ডিম ছুঁয়ে দিয়ে লুফে নিতে হয়), এছাড়া ফসলি মাঠে কাদা মাখামাখি খেলা।


কম্বোডিয়া
কম্বোডিয়াতে ১৪ এপ্রিল নতুন বছরকে বরণ করা হয়। স্থানীয় ভাষায় এর নাম 'খেমার'।এই দিনে স্থানীয় ভাষায় কম্বোডিয়ানরা বলেন 'চউল সানাম থামাই', অর্থাৎ নতুন বছরে প্রবেশ করা। উৎসবের শুরু হয় বৌদ্ধবিহারে সকালবেলায় ধর্মীয় আচার পালনের মধ্য দিয়ে। এরপর প্যাগোডা বা বৌদ্ধমন্দির চত্বরে ঐতিহ্যবাহী নৃত্যের মাধ্যমে নতুন বছরকে স্বাগত জানায় অধিবাসীরা। গেমার নববর্ষে নানা ধরনের খেলা ও প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। এদের একটি বিশেষ খেলা, 'দড়ি টানাটানি'। বাচ্চা, বুড়ো, নারী, পুরুষ নির্বিশেষে সকলেই অংশগ্রহণ করেন এবং আনন্দময় হয়ে ওঠে পরিবেশ।

নেপাল
নেপালে ১৪ এপ্রিল আনুষ্ঠানিক বর্ষ পঞ্জিকা 'বিক্রম সাম্বাত'-এর প্রথম দিন। প্রাচীন হিন্দু রীতি অনুসারে সৌর পঞ্জিকার ভিত্তিতে ১৪ এপ্রিল সাধারণত এই উৎসব পালিত হয়। এটি নেপালের একটি সার্বজনীন উৎসব। সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয় এদিন।পারিবারিক শুভেচ্ছা বিনিময় ও নানা অনুষ্ঠান, ভাল-মন্দ খাওয়াদাওয়া, নানা ধরনের ক্রীড়ার মধ্য দিয়ে নেপালের মানুষ এই দিনটি পালন করেন।

লাওস
লাওসের সৌরপঞ্জিকা অনুসারে বৈশাখের প্রথম দিনটি, অর্থাৎ ১ বৈশাখ নতুন বছরের প্রথম দিন হিসেবে পালন করা হয়। স্থানীয় ভাবে এর নাম 'সংক্রান' বা 'পি-মেই'। এর অর্থ হলো, নতুন সংক্রান্তি বা নতুন বছর। এই দিনটির স্মরণে সারা দেশে তিনদিন ধরে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পালিত হয় নববর্ষবরণ।

ভারতের তথা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সময়ে নতুন বছর উদযাপন হয়।নিজস্ব ঘরানা ও সাংস্কৃতি বজায় রেখে রে তার উৎসব পালন করে। নতুন বছরে পৃথিবী সুস্থ ও সুন্দর থাকুক এই কামনা।

 

তথ্যসূত্র: বিবিসি

More Articles