বাংলার ঢাকের বাদ‍্যে দেশজয় মেয়েদের! যে অসাধ‍্যসাধন করলেন ঢাকি গোকুল দাস

Durgapuja 2022: কলকাতা ছাড়িয়ে সানাতনী বাজনাকে গোকুল পৌঁছে দিয়েছেন বিভুঁইয়ে। তাঁর হাত ধরে বিদেশের মাটিতে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে ঢাকবাদ্য।

ড্রাম বিট দুর্গাপুজোর একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। দুর্গাপুজোয় ঢাকের পাগলা বিট ছাড়া উৎসবের আমেজ ধরে না, পুরুষরা তাঁদের কাঁধে তুলে নেন ঢাক। হাতে কাঠি। ঢাকির বাদ্যিতে মুখরিত হয় পুজো প্যান্ডেল।

'দ্য স্টেটসম্যান' এভাবেই একবার পুজোর অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ হিসেবে ঢাকের কথা তুলে ধরেছিল। সোনারোদে ঝলমলে মেঘ খিলখিল হেসে যায় নীল আকাশের বুকে। শিউলি ফুলের অপ্রতিরোধ্য আবেদন সিক্ত বাতাসে ভরে দেয় শরতের গন্ধ। দোলা লাগে কাশবনে। ত্রিনয়নীর দৃপ্ত আগমন-বার্তায় প্রকৃতি নীরব স্পন্দনে এঁকে নেয় রঙিন পৃথিবী। কবে থেকে সেই মাঠে মাঠে বাঁশের স্তূপ। এখন হইহই রব। জোরকদমে চলছে মা দুগ্গার ঘর বাঁধার কাজ। ছেলেবেলার ছেলেখেলার আনন্দধাম যেন এই প্যান্ডেলগুলো। কত দূর মূর্তি গড়া হলো- দেখতে স্কুলপালানো দুপুরে এ এক উন্মাদনা। এসবের মধ্যে ঢাকিপাড়া তৈরি হচ্ছে ঢাকের বোল তুলতে।

এমনই এক প্রতিষ্ঠানের নাম মছলন্দপুর মতিলাল ঢাকি ডট কম। যাঁর হাত ধরে এই প্রতিষ্ঠানের প্রমীলাবাহিনী প্রতি বছর বিদেশে পাড়ি দেয়, তিনি ঢাকি সম্রাট গোকুলচন্দ্র দাস। এবার তাঁর পুরুষ ও মহিলা ব্রিগেড ঢাক কার্নিভালে লখনউ, অসম, ঝাড়খণ্ড মাতাতে তৈরি হচ্ছে। রাজ্যের মধ্যে তাঁরা যাবেন বালুরঘাটে। প্রতিবার এই শহরের বুকে ঢাকের বোল তোলে গোকুলের প্রমীলাবাহিনী। এবারও তার ব্যতিক্রম হচ্ছে না। এবার তাঁরা থাকছেন নিউটাউন সার্বজনীন দুর্গোৎসব কমিটিতে। এমনটাই জানালেন ঢাকি-সম্রাট গোকুলচন্দ্র দাস।

আরও পড়ুন: রীতির ঐতিহ্য থেকে বিসর্জন, কোথায় আলাদা বাংলাদেশ আর পশ্চিমবাংলার পুজো? 

মছলন্দপুর থেকে সঙ্গীতা দাস, পূজা বিশ্বাস, উমা দাসরা আগে বিভিন্ন সময়ে পুজোয় উড়ে গেছেন লন্ডন বা তানজানিয়া। এবারও ঢাকের চামড়ায় টান পড়েছে। বায়নাও এসেছে। কাঁধে ঢাক নিয়ে ভিন রাজ্যে যাওয়ার জন্য তৈরি গোকুলবাহিনী। কেন এবার তাঁরা বিদেশে যাচ্ছেন না? কী বললেন গোকুল?

"করোনার সময় থেকে আমাদের বিদেশে যাওয়া বন্ধ। করোনার রেশ কেটেছে। তবে পরিস্থিতি এখনও স্বাভাবিক হয়নি। তাই এবারও বিদেশে অনুষ্ঠানের ডাক পাইনি।‘’

মছলন্দপুরের বিধানপল্লি। অধিকাংশই নিম্নবিত্ত পরিবারের বাস। স্বামীর সঙ্গে সংসারের হাল ধরতে পরিবারের মহিলারা রাজমিস্ত্রির জোগাড়ের কাজ করতেন। কেউ চালাতেন টোটো, কেউবা দিন মজুর। সেই মহিলারাই এখন ঢাকের বোলে চমকে দিচ্ছেন। সৌজন্যে ঢাকি সম্রাট। মছলন্দপুরের গোকুলচন্দ্র দাসের প্রশিক্ষণে বিধানপল্লির মহিলা ঢাকিরা আজ ক্ষুরধার। গোকুলের হাতে গড়া এই মছলন্দপুর মতিলাল ঢাকি ডট কম। যখন সবাই মিলে কাঠি হাতে নেন, শরতের আকাশ তা তা থৈ থৈ নেচে ওঠে। মাথা দোলায় কাশবন। ঢাকের তালে খুশির বোল জানান দিচ্ছে, পুজো আর দেরি নেই।

বিধানপল্লির বাসিন্দা গোকুলচন্দ্র দাস। ২০০৪ সালে কলকাতার আহিরিটোলায় বসেছিল ঢাক বাজানোর প্রতিযোগিতার আসর। কলকাতার বিশিষ্ট শিল্পীদের বিচারে মছলন্দপুরের অজপাড়াগাঁর গোকুলের মাথাতেই উঠেছিল ঢাকিসম্রাটের মুকুট। সেই সূত্রেই বিশিষ্ট তালবাদক তন্ময় বসু, পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তীদের মতো গুণী মানুষের সান্নিধ্যে আসেন গোকুল। ঢাক বাজাতে বিদেশেও পাড়ি দেন ২০১০ সালে। গোকুল গিয়েছিলেন সানফ্রান্সিসকো। সেখানে একটি মিউজিক্যাল ইনস্ট্রুমেন্ট কিনতে গিয়ে তাঁর নজরে পড়ে এক বিদেশিনী বিভিন্ন বাজনা বাজিয়ে ক্রেতাদের সাহায্য করছেন। তাঁকে দেখে গোকুল ভেবে নিয়েছিলেন, দেশে ফিরে মহিলাদের নিয়ে গড়ে তুলবেন ঢাকের দল। করলেনও তাই। তৈরি হলো মছলন্দপুর মতিলাল ঢাকি ডট কম। গোকুলের গুরুকুল।

পুজোর সময় অনেক উদ্যোক্তাই ঢাকির খোঁজে কিছুটা সমস্যায় পড়েন। ঠিকঠাক ঢাকি না হলে যে পুজো জমে না। ভালো ঢাকির সন্ধান করলেও পুরনো কিছু মুখই তাদের ভরসা। এই ফাঁকা জায়গাটাই ধরেছিলেন গোকুলচন্দ্র দাস। যিনি এ-রাজ্যের প্রথম সারির ঢাকিদের একজন। ২০০৪ সালে তিনি ঢাকি সম্রাট উপাধি পেয়েছিলেন। উত্তর ২৪ পরগনার মছলন্দপুর বিধানপল্লির এই বাসিন্দা ঠিক করেন, ভালো ঢাকি তৈরি করলে বাজার নিয়ে ভাবতে হবে না। কৃষিপ্রধান এলাকা মছলন্দপুরের মানুষকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন, ঢাক অনেক কিছুই দিতে পারে। মেয়েরা এর তালিম নিলে ভালো বাজিয়ে হয়ে উঠবে। কেউ ফোন করছে কলকাতার কোনও নামী মণ্ডপ থেকে, কারও ফোন দিল্লি বা মুম্বই থেকে। সব্বাই চাইছেন, গোকুল দাসের ছাত্র-ছাত্রীদের। এর মধ্যেই ৬ জন মহিলা ও কয়েকজন ছেলেকে নিয়ে শুরু হয় তাঁর মিশন। মাসতিনেকে ওই ছেলে-মেয়েদের গড়েপিঠে তোলার পর শুভানুধ্যায়ীদের কাছ থেকে স্রোতের মতো আসতে থাকে কাজের সুযোগ। এখন ওই এলাকার অভিভাবকরা চাইছেন, মেয়েরা ঢাক বাজাক। আরও বেশি করে এই পেশায় আসুক। এই মহিলা ঢাকিদের নিয়ে এখন বিস্তর কৌতূহল পুজোকর্তাদের। প্রতিদ্বন্দ্বীদের টেক্কা দিতে তাঁদের বাজি মহিলা ঢাকিরাই। ঢাক বাজাতে পুরুষদের রমরমা থাকলেও সেভাবে মেয়েদের দেখা যায় না। মছলন্দপুর, গোবরডাঙা, হাবড়া-র মেয়েরা সংসার সামলে ঢাক বাজানো শিখেছেন। তাঁরা বুঝেছেন, এর থেকে অনেক কিছু পাওয়ার আছে। কী করে নিজে পেশায় এলেন ঢাকি সম্রাট?

"আমার বাবা-ঠাকুরদা ঢাক বাজাতেন। বংশানুক্রমে আমিও ঢাক বাজাই। বাবার থেকে ঢাক বাজানো শেখা। কৃষিপ্রধান এলাকা হলেও আমরা কোনও দিন চাষবাস করিনি। পরিবারের অনুপ্রেরণায় ঢাকের কাঠি হাতে তুলে নিয়েছিলাম।‘’

গোকুল দাসের গুরুকুল-এর শিল্পীরা বিশ্বের দরবারে পৌঁছে দিচ্ছেন ভারতীয় সংস্কৃতির সনাতনী বাজনাকে। বিগত কয়েক বছর ধরে আমেরিকা, ফ্রান্স, লন্ডন, নরওয়ে এবং ইন্দোনেশিয়ায় থাকা প্রবাসী বাঙালীদের দুর্গাপুজোয় ঢাক বাজিয়ে মন জয় করেছেন মছলন্দপুরের অনেক বাজিয়ে। এ-বছর কলকাতার নিউটাউনে ঢাক, ঢোল ও কাঁসরের তালে মণ্ডপ মাতাতে তৈরি গোকুলবাহিনী। লখনউ, ঝাড়খণ্ড ও অসমে যাচ্ছেন পুরুষ ও মহিলা ঢাকিরা। কলকাতার পাশাপাশি ভিনরাজ্য মুখরিত হবে ঢাকের বোলে।

পণ্ডিত রবিশঙ্কর এবং তাঁর মেয়ে অনুষ্কাশঙ্কর ও ওস্তাদ জাকির হোসেনের সঙ্গে ইউরোপ, আমেরিকায় প্রায় অর্ধশতাধিক শো করেছেন গোকুলবাবু। শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ বা ইন্দোনেশিয়াতেও একাধিকবার ঢাক বাজিয়ে দর্শকদের মন জয় করেছেন তিনি। এক আলাপচারিতায় এমনটাই জানালেন তিনি। গোকুলবাবুর বাবা মতিলাল দাসও পেশায় ঢাকি ছিলেন। গোকুলবাবু এবং তাঁর দুই ছেলে সেই ধারাটিকেই বজায় রেখে শিল্পের ভিতটাকে আরও মজবুত করার চেষ্টা করে চলেছেন।

কলকাতা ছাড়িয়ে সানাতনী বাজনাকে গোকুল পৌঁছে দিয়েছেন বিভুঁইয়ে। তাঁর হাত ধরে বিদেশের মাটিতে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে ঢাকবাদ্য। যাঁর অনুপ্রেরণায় সোশ্যাল ট্যাবু ঝেড়ে ফেলে মহিলারা ঢাক কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন, প্রমাণ করেছেন ঢাকবাদ্যের মর্যাদা, সেই রূপকার গোকুলচন্দ্র দাস। পুজো এসে গেলে ঢাকের বাদ্য যেমন বুকে অনুরণন তোলে, তেমনই মনের মধ্যে জেগে থাকে এক আশ্চর্য গোকুল-কথা।

More Articles