রীতির ঐতিহ্য থেকে বিসর্জন, কোথায় আলাদা বাংলাদেশ আর পশ্চিমবাংলার পুজো?
Bangladesh Durgapuja 2022: দুই বাংলার মানুষই নিজ নিজ নৌকায় দুর্গা প্রতিমা নিয়ে আন্তর্জাতিক সীমানা বরাবর ইছামতী নদীর মাঝখানে সেই নৌকা নিয়ে ভেসে পড়েন। একই জলে বিসর্জিত হয় দুই বাংলার উৎসব।
দুর্গাপুজো মানেই যে শুধু পশ্চিমবঙ্গের বাঙালির শারদোৎসব, তা কিন্তু একেবারেই না। সেই আনন্দে ভাগ রয়েছে পড়শি বাংলাদেশেরও। করোনার চোখ রাঙানি পেরিয়ে যেভাবে পশ্চিমবাংলার মানুষ অপেক্ষা করছেন পুজোর আনন্দে সামিল হওয়ার, প্রতিবেশী দেশেও দুর্গাপুজোর সমস্ত তোড়জোড় শুরু হয়ে গিয়েছে। শুধুই নাড়ির টান নয়, বাংলাদেশের সঙ্গে এই বঙ্গের রয়েছে উৎসবের টানও। অনেকের কাছেই অজানা, বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার নামকরণই করা হয়েছে দেবী ঢাকেশ্বরীর (দেবী দুর্গার এক নাম) নাম থেকে। ঢাকেশ্বরী মন্দির বাংলাদেশের জাতীয় এবং বৃহত্তম হিন্দু মন্দির। এই মন্দির বাংলাদেশের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যেরও অবিচ্ছেদ্য অংশ।
বাংলাদেশে প্রতি বছরই হাজার হাজার দুর্গাপুজো হয়। আর বাংলাদেশে সবথেকে বেশি দুর্গাপুজো হয় চট্টগ্রামে। ২২৪৫ পুজো মণ্ডপ রয়েছে শুধু চট্টগ্রামেই। বাকি সারা দেশ জুড়ে রয়েছে মোট ৩১,৯৩২ টি পুজো মণ্ডপ যার সংখ্যা বাড়ছে প্রতি বছর। সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী রাজধানী ঢাকায় রয়েছে মোট ৯৩৯ টি দুর্গাপুজো।
কেমন হয় ঢাকার পুজো?
এক কথায় বলতে গেলে, ঢাকার পুজো ঐতিহ্যের পুজো। পুরোনো ঢাকার গলিগুলোতে ছোট মণ্ডপের আশেপাশে বাড়ির মতো পরিবেশে নির্মিত ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্যের প্রতিমা এখানে নজর কাড়ে। শুধুই প্রতিমা নয়, আশেপাশের মানুষের সীমাহীন আবেগের প্রতিচ্ছবিই ধরা পড়ে ঢাকার পুজোয়।
বাংলাদেশের প্রাচীন পুজোগুলোতে শুধুমাত্র প্রতিমা নয়, মণ্ডপ বা আলোকসজ্জাও নজর কাড়ে। রাস্তা এবং আশপাশের এলাকা রঙিন মূর্তি, ব্যানার এবং নিয়ন লাইট দিয়ে সাজানো হয়। মন্দিরের চারপাশে ছোট ছোট খাবারের স্টল, বিভিন্ন ধরনের মিষ্টির আয়োজন। বাঙালিয়ানার নির্যাস এখানে ভরপুর।
মণ্ডপের ভিতরে ছেলেমেয়ে সহ উমা। দুর্গার বিশাল মূর্তি ঢাকার গরিমা বলা যায়। শুধু প্রতিমা আর পুজো নয়, দুর্গোৎসবের সঙ্গে দুই বঙ্গেই নিবিড়ভাবে জড়িয়ে সাংস্কৃতিক চর্চা। মণ্ডপে মণ্ডপে তাই পুজোর অনুষ্ঠান এখানের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। গানের আসর, নাচ এবং অন্যান্য অনুষ্ঠানও পুজোর আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। ঢাকার বেশ কিছু ঐতিহ্যশালী সার্বজনীন (বারোয়ারি) দুর্গাপুজোর মধ্যে রয়েছে ঢাকেশ্বরী মন্দিরের পুজো, শাঁখারিবাজারের দুর্গাপুজো, ঢাকার রামকৃষ্ণ আশ্রমের পুজো, শিকদারবাড়ির দুর্গাপুজো এবং এমন আরও বহু।
আরও পড়ুন- শুভ মহালয়া বলা কি ভুল? দিনটির তাৎপর্য জানলে চমকে যাবেন
শাঁখারিবাজারে মোট ৯ টি পুজো আয়োজিত হয় এবং প্রতিটি পুজোই অন্তত ৪০-৫০ বছরের পুরোনো। রামকৃষ্ণ মিশনের পুজোর অন্যতম প্রধান আকর্ষণ কুমারীপুজো। পশ্চিমবাংলার বেলুড় মঠের মতোই, মহাষ্টমীতে সেখানে কুমারীপুজো দেখতে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থান থেকে মানুষ ভিড় জমান। এছাড়াও রয়েছে বনানী পুজোমণ্ডপ, খামার বাড়ি মণ্ডপ, উত্তরা পুজোমণ্ডপ, শ্রীশ্রী সিদ্ধেশ্বরী কালী মন্দির এবং আরও অনেক মন্দির যা লিখে শেষ করা যায় না।
সারা দেশে মণ্ডপগুলিতে মহাষষ্ঠী পুজোর মধ্য দিয়ে শুরু হয় দুর্গাপুজো উদযাপন। সকালে মন্দিরে কল্পারম্ভে দুর্গা প্রতিমা উন্মোচনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় দিন। সপ্তমীর আগমনে ‘কলাবউ’ বা ‘নবপত্রিকা’ পুজো হয়। পুজোর সব দিনই দেবীর ভোগ প্রসাদ হয় সম্পূর্ণভাবে নিরামিষ। নবমীর সন্ধ্যায় ধুনুচি নাচে মাতেন মানুষ। মাটির পাত্রে জ্বলন্ত কাঠকয়লা ভরে তা হাতে নিয়ে ঢাকের তালে নাচ, দুই বাংলাকে মিলিয়ে দেয়। পাঁচ দিনব্যাপী উদযাপন বিজয়া দশমীতে সিঁদুর খেলা এবং প্রতিমার বিসর্জনে শেষ হয়।
বাংলাদেশে দুর্গাপুজোর ইতিবৃত্ত
ঐতিহাসিকভাবে পঞ্চদশ শতাব্দীর একেবারে শেষের দিকে রাজা কংসনারায়ণ বাংলাদেশের রাজশাহীর তাহেরপুরে একটি বৃহৎ আকারে দুর্গাপুজো শুরু করেন। বেলুড় মঠে প্রথম দুর্গাপুজো ১৯০১ সালে স্বামী বিবেকানন্দ নিজেই করেছিলেন।
ধর্মীয় রীতিনীতিগুলি সীমান্তের দুই পাশে অনেকাংশে একই, যদিও বছরের পর বছর ধরে স্থানীয় সামাজিক-সাংস্কৃতিক অনুশীলনের ফলে কিছু পার্থক্য দেখা যায়। কিন্তু আজও বাংলাদেশের গ্রামে দুর্গাপুজো পশ্চিমবঙ্গের তুলনায় বেশি ভাবগাম্ভীর্যের সঙ্গে পালিত হয়। ধর্মীয় আচারগুলি আরও কঠোরভাবে অনুসরণ করা হয় বাংলাদেশে।
আরও পড়ুন- সারা কালনা অন্ধকারে ডুবিয়ে নিরঞ্জন হয় প্রতিমার! অবাক করবে মহিষমর্দিনীর ঐতিহ্য
পশ্চিমবঙ্গের দুর্গামূর্তিগুলি যুবতী সর্বানী দত্তকে যামিনী রায়ের আঁকা মহিলাদের প্রতিকৃতির কথা মনে করিয়ে দিয়েছিল। অন্যদিকে বাংলাদেশের দেবদেবীরা আকৃতিতে বেশি আদিবাসী।
দেবীর বিসর্জনের দিন সীমান্তে এসে মেলে দুই বাংলা। পশ্চিমবঙ্গে টাকির বাসিন্দারা যখন বিসর্জনের জন্য প্রস্তুত হন তখন বাংলাদেশের সীমান্তের সাতক্ষীরা জেলাতেও একই রকম দৃশ্য দেখা যায়। দুই বাংলার মানুষই নিজ নিজ নৌকায় দুর্গা প্রতিমা নিয়ে আন্তর্জাতিক সীমানা বরাবর ইছামতী নদীর মাঝখানে সেই নৌকা নিয়ে ভেসে পড়েন। একই জলে বিসর্জিত হয় দুই বাংলার উৎসব।
বেশ কয়েক মিটারের দূরত্ব থাকা সত্ত্বেও প্রতিবেশী দুই দেশই একে অপরের দিকে হাত নাড়িয়ে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন এবং “আসছে বছর আবার হবে” রব ওঠে দুই পাড় থেকেই। ভূ-রাজনীতি দ্বারা বিভক্ত দুই দেশের নাগরিকরা এক দিনের জন্য যৌথ ঐতিহ্য উদযাপন করতে একত্রিত হন– এই পরম্পরা আজও সগৌরবে বহমান।
ঢাকার জাঁকজমকপূর্ণ দুর্গাপুজোর উৎসবে বরাবরই বাঙালি মুসলিমরা মেতে ওঠেন। উৎসবের আমেজেই মণ্ডপ দর্শন করেন, উৎসবে সামিল হয়ে মুসলিম প্রতিবেশী ও বন্ধুরা হিন্দু বন্ধুদের বাড়িতে গিয়ে হাজির হন প্রসাদ খেতে। গল্প, আড্ডা আর অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণও উল্লেখের দাবি রাখে। দুর্গার বিসর্জনের যাত্রাতেও শরিক হন সকলেই। কোভিডের কারণে হুল্লোড় কিছুটা স্তিমিতই ছিল গত দু’বছর। তবে এবার দুই বাংলাই এই উৎসবকে স্বাগত জানাতে একেবারে প্রস্তুত।