কোভিড খেয়েছে পেটের ভাত, তবু আশার নাম হালখাতা

তখন ছিল কাগজ-কলমের যুগ। আজকের মতো ডিজিটাইজড দুনিয়ার বাসিন্দা ছিল না মানুষ। চড়ক পার্বণের কিছু আগে থেকেই  তোরজোড় শুরু হত। রঙ-বেরঙের খামে ভরা হালখাতার নানান আমন্ত্রণপত্র পৌঁছে যেত মধ্যবিত্ত বাঙালির বাড়িতে। তারপর বচ্ছরকার দিনে কুলুঙ্গির লক্ষ্মী-গণেশ কে তেল সিঁদুরে সাজিয়ে খোলা হত নতুন খেরোর খাতা। যুগ যুগ ধরে এমন নিয়মই চলে আসছে বাংলায়। কালক্রমে হালখাতার চরিত্র পালটালো। আজকাল ১ লা বৈশাখ উপলক্ষে ‘শ্রী দুর্গা সহায়’ লেখা আমন্ত্রণপত্র আর প্রায় আসে না বললেই চলে। নিমন্ত্রণ জানানোর কাজটা ইদানিং ওয়াটস অ্যাপেই মাধ্যমেই সারেন বহু দোকানী। এমন পরিবর্তন সত্ত্বেও গাজন উৎসবের ঠিক পরেই নানান সাজে সেজে ওঠে কলকাতার দোকানগুলো। অতিথিদের হাতে তুলে দেওয়া হয় নতুন ক্যালেন্ডার আর মিষ্টির বাক্স। কয়েক শতাব্দী পেরিয়ে হালখাতার জৌলুস কমেছে, কিন্তু তার ঐতিহ্য আজও অমলিন। বাংলার ব্যবসায়ীদের হাত ধরে একবিংশ শতাব্দীতেও এই প্রাচীন রীতি বেঁচে আছে।  

শুভ্রাংশু পোদ্দারের কথাই ধরা যাক। আজ থেকে প্রায় বিশ বছর আগে ঢাকুরিয়া রেল গেটের কাছে তাঁর বাবা একটা গেঞ্জি কারখানা তৈরি করেন। কারখানার নাম দেন ‘এস এস উদ্যোগ’। নব্বইয়ের দশকে আসানসোল এবং  ঝড়িয়া অঞ্চলে একচেটিয়া ব্যবসা করেছেন তিনি। তারপর কারখানার দায়িত্ব এসে পড়ে শুভ্রাংশুর হাতে। বাজারের হাল-হকিকত বুঝে নিতে বেশিদিন সময় লাগেনি তাঁর। আসানসোল এবং ঝড়িয়া অঞ্চলের কয়লা শ্রমিকরাই ছিলেন তাঁদের গেঞ্জির নিয়মিত খরিদ্দার। সারাদিন কয়লা খনিতে কাজ করাবার ফলে সপ্তাহের শেষে তাঁদের গেঞ্জিগুলো আর পরবার মতো অবস্থায় থাকত না, ফলত প্রতি সপ্তাহেই এক জোড়া নতুন গেঞ্জি কিনতেন তাঁরা। তুলনামূলকভাবে সস্তা হওয়ার ফলে ‘এস এস উদ্যোগে’র গেঞ্জিই ছিল তাঁদের প্রথম পছন্দ। এর ফলে দীর্ঘ সময় জুড়ে আসানসোল বা ঝড়িয়ার শ্রমিক অঞ্চলে প্রায় বিনা প্রতিদ্বন্দিতায় ব্যবসা করেছেন শুভ্রাংশু, কিন্তু বিপত্তি ঘটলো কোভিডের ফলে। দু-দুটো লকডাউনের পর কয়লা খনির বহু শ্রমিকই কর্মহীন হয়ে পড়লেন। শ্রমিকদের হাতে টাকা না থাকায় প্রতি সপ্তাহে নতুন গেঞ্জি কেনা তাঁদের পক্ষে অসম্ভব হয়ে উঠল।  এ ছাড়াও গেঞ্জি তৈরির সুতো আর থান কাপড়ের দাম এক ধাক্কায় বেশ কিছুটা বৃদ্ধি পেল, ফলত শুভ্রাংশুদের ব্যবসায় টান পড়ল।

ব্যবসার অবস্থা যেমনই থাকুক না কেন, প্রতি বছর নিয়ম করে হালখাতা পালন করেন শুভ্রাংশুরা। এদিন সকাল থেকেই তাঁদের বাড়িতে তোরজোড় শুরু হয়। প্রথমে গৃহদেবতার পায়ে তেল, হলুদ এবং সিঁদুর দিয়ে পুজো দেওয়া হয়। তারপর তা ছোঁয়ানো হয় কারখানার মেশিনে। প্রতি বছর ১ লা বৈশাখের দিন কুলুঙ্গির লক্ষ্মী-গণেশের মূর্তি বিসর্জন দেন শুভ্রাংশুরা। পুরনোর পরিবর্তে কুলুঙ্গিতে আসে নতুন মূর্তি। হালখাতার দিন প্রথমে তাদের কালীঘাটে নিয়ে গিয়ে পুজো দেওয়ানো হয়, তারপর ফুল-মালা সহযোগে সিংহাসনে স্থাপন করা হয়। সব শেষে আসে খেরোর খাতা বা ‘লেজার বুকে’র প্রথম পৃষ্ঠায় কলমের আঁচর কাটবার পালা। কোভিড পরবর্তী সময়ে অর্থনৈতিক কারণেই উদযাপনের ধুম-ধাম খানিক কমিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন শুভ্রাংশুরা। তিনি বলছিলেন, ‘আগে ১ লা বৈশাখের দিন কারখানার শ্রমিকদের পাত পেড়ে খাওয়ানো হত, মেনুতে মাছ, মাংস সবই থাকত। এখন আর সেসব কিছুই করে উঠতে পারি না। গত দু বছর ধরে শ্রমিকদের হাতে অল্প কিছু টাকা আর মিষ্টির বাক্স ধরিয়ে দেওয়া হয়।’

আরও পড়ুন-‘বাংলা নববর্ষে হিন্দি গান গাইব না’, বলেছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়

বেহালার সুমন সরকারের গল্পও একইরকম। অল্পবয়সে বাবা-মাকে হারানোর পর বেহালার বকুলতলায় কাঠের ব্যবসা শুরু করেন সুমন। দোকানের নাম রাখেন ‘স্টার প্লাইউড’। ২০১২-১৩ সাল থেকে নানান অর্থনৈতিক ঝড়-ঝঞ্ঝা পেরিয়ে আজও কোনোরকমে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। তাঁর দোকান যে খুব ভালো চলে তা নয়, তার উপর লকডাউনের ফলেও সমস্যা দেখা দিয়েছে। প্রতি হালখাতাতেই নিজেদের ধরা-বাধা কয়েকজন খরিদ্দারকে দোকানে নিমন্ত্রণ করেন সুমন। তাঁদের হাতে তুলে দেন নতুন বছরের বাংলা ক্যালেন্ডার আর খাবারের প্যাকেট। ‘স্টার প্লাইউডে’র অধিকাংশ খরিদ্দারই ‘বাকি’তে জিনিস কেনেন। ফলত হালখাতার দিন প্রত্যেকেই নিজেদের সামর্থ্য মতো কিছু কিছু করে টাকা-পয়সা দেওয়ার চেষ্টা করেন। লক্ষ্মী-গণেশকে ফুল মালা দিয়ে পুজো করবার পর সেই টাকার হিসেব তারপর তুলে দেওয়া হয় নতুন খেরোর খাতায়। সুমন বললেন, ‘২০২০ তো লকডাউনের উপর দিয়েই গেল। সে বছর আর  হালখাতা  করতে পারিনি। পরের বছর কষ্ট করে করেছিলাম, কিন্তু বাজার থেকে সেভাবে টাকা ওঠেনি। আশা করছি এ বছর লাভের অঙ্কটা কিছুটা হলেও বেশি হবে।’

শুভ্রাংশু এবং সুমন একইসঙ্গে নতুন প্রজন্মের ব্যবসাদার এবং ক্ষুদ্র পুঁজির মালিক। অতিমারির ফলে দুজনের ব্যবসাই ব্যপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবু কষ্ট করে হলেও প্রতি বছর হালখাতা পালন করেন তাঁরা।

শুভ্রাংশু বলছিলেন, ‘ব্যবসাটা কতদিন ধরে রাখতে পারব জানি না। যা অবস্থা, কয়েকদিন পর কারখানা হয়ত উঠেই যাবে। তবে, যদি ব্যবসা থাকে, হালখাতাও থাকবে। যেমনভাবেই হোক না কেন, প্রতি বছর হালখাতা পালন করব।’ হালখাতার ইতিহাস বহু প্রাচীন। কালে কালে তার ধরন বদলেছে। শুভ্রাংশু এবং সুমনের কথাবার্তায় অনুমান করে নেওয়া যায় কেবল পূর্ববর্তী প্রজন্ম নয়,  একবিংশ শতাব্দীর নতুন প্রজন্মও তাঁদের ঐতিহ্য সম্বন্ধে অবগত এবং তাকে বাঁচিয়ে রাখবার ক্ষেত্রে যথাযথ ভূমিকা নিচ্ছে। তাদের এই উদ্যোগ সত্যিই প্রশংসনীয়।

More Articles