'বাংলা নববর্ষে হিন্দি গান গাইব না', বলেছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়
একসময়, সেই পাঁচের দশকের শেষ দিক থেকে, বাংলা নববর্ষের একটা নতুন চমক হয়ে উঠেছিল, মন্টু বসুর একটি অনুষ্ঠান। মন্টু বসু ছিলেন বসুশ্রী-র মালিক। পয়লা বৈশাখে বসুশ্রীতে বসত গানের আসর, সকাল ন’টা থেকে শুরু হয়ে যা চলত দুপুর একটা পর্যন্ত। কলকাতার হেন কোনও সংগীতশিল্পী নেই, যিনি এই অনুষ্ঠানে ডাক পেতেন না। এঁদের মধে্য কেউ কেউ ছিলেন নিয়মিত, যেমন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। সেই সময়টা ছিল বাংলা গানের স্বর্ণযুগ, বলা যেতে পারে, বাংলা গানের আসল প্রতিনিধি, গানের নিরিখে বাংলার মুখ ওই সময়টা। মনে পড়ে, বসুশ্রী-তে সেই সময় হেমন্তবাবু গাইছেন, ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য গাইছেন, সতীনাথ মুখোপাধ্যায়, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়রা গাইছেন।
হেমন্তবাবুর একটা বিশেষ স্টাইল ছিল, যা আমাদের খুব আকর্ষণ করত। হেমন্তবাবু একটা চেয়ারে বসতেন, আরেকটা চেয়ারে ওঁর হারমোনিয়ামটা রাখা হত, আর দু’দিকে ওঁর সহশিল্পীরা বসতেন। আর প্রতিবার শেষে গাইতেন উনি, কারণ ওঁর কোনও টাইম লিমিট ছিল না। সকলেই ওঁর গান শুনতে চাইতেন, সে চলচ্চিত্রের গান হোক বা বেসিক ডিস্কের গান। আর আমি যতটুকু ওঁর অনুষ্ঠান শুনেছি ওখানে, উনি কোনওদিনও দুটো জিনিস করতেন না। এক, হিন্দি গান গাইতেন না কোনওভাবেই। একবার মনে আছে, ‘না তুম হামে জানো’ গানটির অনুরোধ এসেছিল ওঁর কাছে, পরিষ্কার বলে দিয়েছিলেন, ‘আজ বাংলা নববর্ষ, কোনওভাবেই হিন্দি গান গাইব না আমি।’ আর দুই, অবধারিতভাবে, অনুষ্ঠান শুরু করতেন দুটো রবীন্দ্রসংগীত দিয়ে। এখানে একটা কথা বলা প্রয়োজন, এটা আমি পঁাচ-ছয়ের দশকের কথা বলছি। সেই সময় রবীন্দ্রসংগীত শোনার এতখানি চল সাধারণ মানুষের মধে্য ছিল না। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে আমার একবার এই প্রসঙ্গে আড্ডা হয়েছিল। বুঝেছিলাম, ওঁর আর আমার অভিজ্ঞতা এক্ষেত্রে এক। বিষয়টা হচ্ছে, সেই সময় ‘অনুরোধের আসর’-এ রবীন্দ্রনাথের গান শুরু হলে রেডিও বন্ধ করে দিত মানুষ। বস্তুত রবীন্দ্রসংগীত বাঙালি শুনতে শুরু করল যাঁদের হাত ধরে, হেমন্তবাবু তো তাঁদের মধে্য অন্যতম। এছাড়াও বলতে হয় সুচিত্রা মিত্র, কণিকা বন্দে্যাপাধ্যায় এবং অবশ্যই জর্জদার (দেবব্রত বিশ্বাস) কথা। জর্জদার গান শুনে শুনেই কিন্তু রবীন্দ্রসংগীতের কান তৈরি হল বাঙালির। যাই হোক, কিন্তু যে সময়ের কথা বলছি, সেই সময়েও রবীন্দ্রসংগীত শুনতেন না মানুষ। কিন্তু হেমন্তবাবু বসুশ্রীর নববর্ষে ওই নিয়মের ব্যত্যয় ঘটাননি কোনওদিন। এমনও হয়েছে, দর্শকাসন থেকে মানুষ উঠে গিয়ে সিগারেট খেয়ে ফিরে এসেছে, রবীন্দ্রসংগীত শুনবে না বলে।
সাতের দশকের শুরুতেও ওই অনুুষ্ঠানে আমি গিয়েছি। তখন আমি ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’-র সাংবাদিক। সন্তোষকুমার ঘোষ আমাকে বললেন, ‘ওই জলসায় গিয়ে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গান শুনে এসো, ওঁর সম্পর্কে ভাল করে লিখো।’ সেই সময় বসুশ্রী-তে ঢোকার সময় বেলফুল দেওয়া হত। সেভেন্টিটু-ই হবে হয়তো তখন, যখন আমি হেমন্তবাবুর সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। বেলফুলের গন্ধে ম ম করছে চারপাশ। আমাকে দেখে বললেন, ‘কী, সন্তোষ পাঠিয়েছে?’
আমি বললাম, ‘হ্যাঁ!’
আরও পড়ুন: পাড়ার সেইসব নববর্ষের সন্ধে ছিল ইন্দ্রজালের মতো
আমাকে বললেন, ‘শুনলে অনুষ্ঠান? কেমন লাগল?’
আমি বললাম, ‘দারুণ লাগল! বিশেষত, এটা ভাল লাগল যে, রবীন্দ্রসংগীত দিয়ে শুরু করে আপনি ঐতিহ্যটা ধরে রেখেছেন।’
তখন হেমন্তবাবু বললেন, ‘বাংলা গান হবে, সেখানে রবিঠাকুরের গান হবে না?’
সেই সময় বসুশ্রী-র বাইরে একটা বিপুল ভিড় হত। যাঁরা ভেতরে জায়গা পেতেন না, তাঁরা বাইরে দাঁড়িয়ে দেখতেন, কোন কোন শিল্পী ভেতরে ঢুকছেন বা বেরচ্ছেন। সব শিল্পীই মিষ্টির বাক্স হাতে বেরতেন।
হাতে গিলে করা ধুুতি-পাঞ্জাবি পরে আসতেন উত্তমকুমার। হেমন্তবাবু, শ্যামল মিত্র, মানবেন্দ্র– এঁদের পরিচয় করিয়ে দিতেন। পরে, হেমন্তবাবুর সঙ্গে ওঁর মনোমালিন্য হয়। তখন হেমন্তবাবু বাদে বাকি শিল্পীদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতেন তিনি। মনে আছে, উত্তমকুমার এলেই একটা সাময়িক নৈরাজ্য তৈরি হত ওখানে। ওঁকে দেখতে একটা বিপুল ভিড় জমত!
এছাড়াও পয়লা বৈশাখ বললেই কত কিছু যে মনে পড়ে! পয়লা বৈশাখের ক’দিন পরেই স্কুলে গ্রীষ্মের ছুটি পড়ত। আর ওই দিনে স্কুলে ঘোল আর সন্দেশ খাওয়া হত, মনে পড়ে। সেই মিষ্টি আমরা আনাতাম চার আনা, আট আনা দিয়ে। আর অরেঞ্জ স্কোয়াশ দইয়ে ঢেলে ঘোল বানাতাম। সব শিক্ষকরা ক্লাসে ক্লাসে গিয়ে সেই ঘোল আর মিষ্টি খেতেন। তখন তো এমন সুগারের প্রাবল্য ছিল না, ফলে মিষ্টিতে না ছিল না কারওরই। তবে তারপরেই বাড়ি ফেরার একটা তাড়া থাকত, তার কারণ আর কিছুই নয়, বাড়িতে পাঁঠার মাংস রান্না হত, তাঁর লোভ ছিল অন্যরকম!
আমাদের পাড়ায় একটা ব্যাপার ছিল। আমাদের বাড়ির পাশেই একটা রোয়াক ছিল, বেনেবাড়ির রোয়াক। সেই রোয়াকে বসে আমরা আড্ডা মারতাম। লালু বলে আমাদের এক বন্ধু ছিল, যার কথা আমার আত্মজীবনীতে লিখেছি। তাকে আমরা সবসময়ই সঙ্গে রাখতাম। লালু খুব ভাল শ্যামাসংগীত গাইত। আরেক বন্ধু শোনাত আধুনিক। তার প্রিয় ছিল মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের ‘আমি এত যে তোমায় ভালবেসেছি’ আর ‘বারে বারে কে যেন ডাকে’। সেই রোয়াকের আসর আমাদের আরও জমত পয়লা বৈশাখে, আর সন্ধে নামলেই মাচা বেঁধে হত বাংলা গানের আসর। আমার মনে আছে, একবার ‘ন্যাশনাল হোমিও ল্যাবরেটরি’-র মালিক, তাঁর তখন ষাটের ওপর বয়স, এসে রবীন্দ্রনাথের কবিতা পড়লেন আমাদের সেই আসরে, একেবারে নাটকীয়ভাবে।
পয়লা বৈশাখ মানেই আগে ছিল কলেজ স্ট্রিট যাওয়া। আমার মনে পড়ে, অমিয়দা ছিলেন আমার প্রাইভেট টিউটর। তাঁকে একবার কাকা টাকা দিলেন, আমাকে কলেজ স্ট্রিটে নিয়ে গিয়ে কিছু বই কিনে দেওয়ার জন্য। সেদিন আমরা কলেজ স্ট্রিট চষে বেড়ালাম, এখন তো গায়ে রোদ লাগে, তখন অতটা লাগত না। সেদিন দুটো ঘটনা ঘটে গেল। তার কিছুদিন আগে তপন সিংহ-র ‘লৌহকপাট’ দেখে খুব ভাল লেগেছে। যে উপন্যাসের ওপর ভিত্তি করে সেই সিনেমা নির্মিত, সেই উপন্যাসের বইটা কিনতে গেছি অমিয়দার সঙ্গে। বইটা কিনছি, দেখি একজন বয়স্ক লোক দাঁড়িয়ে মিটমিট করে হাসছেন। বোঝার চেষ্টা করছি তিনি কে, এগিয়ে এসে বললেন, ‘খোকা, তুমি কি এই বইটা পড়বে?’ আমি ‘হ্যাঁ’ বলতেই তিনি বললেন, ‘তাহলে আমি একটা সই করে দিই?’ আমি তো হতচকিত! বুঝলাম, ইনিই স্বয়ং সেই বইয়ের লেখক– জরাসন্ধ। লিখে দিলেন, ‘আমার নবীন পাঠককে আশীর্বাদ!’
আরেকটা ঘটনাও চমকপ্রদ! আমরা ফিরছি যখন, হ্যারিসন রোডের মোড়ে চোখে পড়ল একটি ফোটোগ্রাফিক স্টুডিও, তার সামনে কাচের শো কেস করে রাখা এক স্যুট পরা ভদ্রলোকের ছবি। অমিয়দাকে বললাম, ‘এই ভদ্রলোককে চিনতে পারছ?’ অমিয়দা বললেন, ‘না তো!’ আমি বললাম, ‘ইনি শ্যামল মিত্র।’ অমিয়দা তো হেসে কুটিপাটি! ‘শ্যামল মিত্র কখনও স্যুট পরেন না’– এই ছিল অমিয়দার যুক্তি। বাজি ধরলাম চার আনার। দোকানে এক বয়স্ক চশমাপরা ভদ্রলোক বসে, তাঁকে জিজ্ঞেস করতে তিনি বললেন, ‘ইনি তো শ্যামল মিত্র!’ ব্যস, আমি জিতে গেলাম বাজি! সেই বাজি জেতার টাকায় আমাকে খাইয়েছিলেন অমিয়দা।
এইসব স্নিগ্ধতা এখন হারিয়ে গেছে কোথায়!