গানের অআকখ জানেন না কিশোরকুমার, কেন এমন বলেছিলেন সলিল চৌধুরী

কিশোর নিজেকে তৈরি করছিলেন ক্রমাগত। যে উচ্চতায় তিনি নিজেকে নিয়ে গিয়েছিলেন, তা খুব কম মানুষই অর্জন করতে পেরেছেন। লতা, মান্না দে, হেমন্ত, রফি— সব্বাই পছন্দ করতেন তাঁর গান। মান্না বলেছিলেন, "কিশোরকে কখনও বেসুরে গাইতে দেখি...

কিশোরকুমার কি বেসুরো ছিলেন?

আজ এই প্রশ্ন শুনে চমকে উঠবেন অনেকেই। ট্রোলড হবেন প্রশ্নকর্তা। সামাজিক মাধ্যমে মিমের বন্যা বয়ে যাবে। কিশোরকুমার গানের জগতে কিংবদন্তি, সকলে স্বীকার করেন এক বাক্যে। অন্তত শিল্পীর মৃত্যুর পর আমরা নিঃসন্দেহে তাঁকে পরিপূর্ণ গ্রহণ করে থাকি। শুধু ভারত নয়, জগৎসভার এমনটাই রীতি। ভ্যান গঘ থেকে মার্লন ব্র্যান্ডো, উত্তম থেকে কিশোর— যাঁরাই ধ্রুপদী বৃত্তের বাইরে নিজস্বতা তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিলেন, তাঁদের কারওরই চলার পথ মার্বেল-বাঁধানো ছিল না। কেউ সারা জীবন উপেক্ষিত হয়েছেন, কেউ খ্যাতির চূড়ান্তে পৌঁছেও 'কিছু না জেনেই করে খাচ্ছেন' গোছের অভিযোগ শুনেছেন বারংবার। অথচ মৃত্যু এক অদ্ভুত বিবাদহীন রাজপথ, অন্তত সমালোচনার ক্ষেত্রটিতে তো বটেই।

আজ যতই অচিন্ত্যনীয় মনে হোক না কেন, এককালে এই সন্দেহ পোষণ করতেন অনেক বড় বড় সংগীত নির্দেশকই। ৪ আগস্ট, ১৯২৯। রোগাপাতলা ছেলেটির জন্ম মধ্যপ্রদেশের খাণ্ডওয়ায়। অশোককুমার বলতেন, ছোটবেলায় একবার পায়ে ভয়ানক চোট পেয়েছিলেন কিশোর। প্রায় একমাস বিছানা ছেড়ে উঠতে পারতেন না। চিৎকার করে কাঁদতেন সারাক্ষণ। গলা তাঁর একেবারেই পরিষ্কার ছিল না, কিন্তু মাসখানেক কাঁদার চোটে গলা সাফ হয়ে যায়। কিশোর গাইতে শুরু করেন। প্রথাসিদ্ধ শিক্ষা কোনওদিনই ছিল না কিশোরের। গায়কজীবনের একেবারে প্রথমদিকে গানও খুব একটা ভালো গাইতেন না। ধীরে ধীরে নিজেকে তৈরি করেছেন কিশোর। নানা বড় মাপের সুরকারের সঙ্গে তাঁর কাজ করার সুযোগ হয়েছিল। বিশেষত শচীনকত্তার স্নেহাস্পদ ছিলেন। একরকম নিজের হাতে কিশোরকে তৈরি করেছিলেন শচীন দেববর্মন। সেই ঘটনা অনেকেরই জানা। কিন্তু জানেন কি, এককালে শচীনকত্তাও কিশোরের গান পছন্দ করতেন না বিন্দুমাত্র?

আরও পড়ুন: ‘ও তোতা পাখি রে…’ বাঙালির হাসিকান্নাকে কণ্ঠে ধরে রেখেছিলেন নির্মলা মিশ্র

কিশোর ইন্ডাস্ট্রিতে গান শুরু করেন কোরাসের দলে। কে কে সায়গল তখন তাঁর আইডল। অশোককুমার তখন স্টার। বড়দার অত্যন্ত স্নেহের পাত্র কিশোর অভিনয়জগতে সুযোগ পান সহজেই। কিন্তু অভিনয়ে তেমন আগ্রহ নেই। গান করবেন। নেপথ্যসংগীত তাঁকে টানে খুব। সেসময় কেউই তেমন পাত্তা দিতে চান না। গানের জগতে রথী-মহারথীদের আধিপত্য। পরিচয়ের সূত্রেই সুযোগ টুকটাক আসছিল। খেমচাঁদ প্রকাশ দেব আনন্দর সিনেমা 'জিদ্দি'-তে (১৯৪৮) প্রথম গাওয়ার সুযোগ করে দিলেন। 'মরনে কি দুয়ায়েঁ কিউঁ মাঙ্গু' গাইলেন কিশোর। কিন্তু গায়কীতে সায়গলের ছাপ স্পষ্ট। শচীনকত্তাও শুনেছেন সেসব গান। একেবারেই পছন্দ হয়নি। এর মধ্যে একদিন শচীন কত্তা অশোককুমারের বাড়ি গিয়েছেন, সেখানে কিশোর সায়গলকে ইচ্ছাকৃতভাবে নকল করে গান গাইছিলেন। শুনে মুগ্ধ শচীনদেব। কিশোরকে ডেকে বললেন, নিজের স্টাইল তৈরি করো। সায়গলকে নকল করে তোমার কিছু হবে না। নিজেকে ভাঙতে শুরু করলেন কিশোর।

সলিল চৌধুরীর মতো সংগীত পরিচালকও একসময় বলেছিলেন, কিশোর আবার গায়ক নাকি! সেও এক গল্প। বিমল রায় তাঁর 'নৌকরি' ছবির নায়ক হিসেবে কিশোরকে নির্বাচিত করেছেন। তাঁর ইচ্ছে নায়কের লিপে কিশোরই গানগুলো করুন। কিন্তু সংগীত পরিচালক সলিল চৌধুরী বেঁকে বসলেন। নেপথ্য গায়ক হিসেবে হেমন্তকে ভেবে রেখেছেন সলিল। হেমন্ত তখন গানের জগতে রীতিমতো প্রতিষ্ঠিত। তা না, কোথাকার কে কিশোর! নায়ক মানেই তাকে গাইতে দিতে হবে নাকি! মুষড়ে পড়লেন বিমল রায়। কিশোর এতটুকুও অপ্রতিভ না হয়ে সোজা চলে গেলেন আন্ধেরি, মোহন স্টুডিওয় সলিল চৌধুরীর কামরাটিতে। কেন তাঁকে নিতে চাইছেন না সলিল, জানতে চান। সলিল জানান, "আরে, আমি তো আপনার গান শুনিইনি কখনও!" এই ব্যাপার! সেখানেই গান ধরলেন কিশোর। "আরে দাঁড়ান দাঁড়ান"— তাঁকে থামালেন সলিল। বললেন, "আপনি তো মশাই গানের অআকখ জানেন না!" হাল ছাড়লেন না কিশোর। পরের দিন ফের নিজের দু'খানি রেকর্ড নিয়ে হাজির কিশোর সলিলদার কামরায়। একখানি 'জিদ্দি'-র সেই গান, অপরটি 'রিমঝিম'-এর (১৯৪৯) 'জগমগ জগমগ করতা নিকলা'। একটাও পছন্দ হলো না সলিলের। কিশোরের তৎকালীন গায়কী মেকি বলে মনে হয়েছিল তাঁর। মনে রাখা দরকার, এই পর্যায়ে শচীনকত্তাও কিশোরকে নিজস্ব গায়কী তৈরি করতে বলেছেন। কাজেই সলিলের মূল্যায়ন খুব একটা ভুল ছিল না। অবশেষে অশোককুমার-সহ বহু মানুষ ধরাধরি করাতে নিমরাজি হয়ে গাওয়ালেন কিশোরকে দিয়ে। 'ছোটা সা ঘর হোগা বাদলোঁ কি ছাঁও মে' নিজের লিপে নিজের কণ্ঠ। গানটির একটি স্যাড ভার্সনও রেকর্ড করান হেমন্তের গলায়। সেটি অবশ্য ছবিতে কারও লিপেই ব্যবহার করেননি। তবে নেপথ্যে ব্যবহৃত হয়েছিল। সতেরো বছর পরে, 'মেরে আপনে' ছবিতে গান করার জন্য নিজেই বেছে নেন কিশোরকে। বলেন, "কিশোর কত বড় শিল্পী তা আমি ঠিক বুঝতে পারিনি।" স্বাভাবিক, সতেরো বছর আগে এবং পরে কিশোরের গায়কীও অনেক অনেকখানি বদলে গিয়েছিল।

ভারতের প্রথম মহিলা মিউজিক ডিরেক্টর সরস্বতী দেবীর গান চুরি করার অভিযোগও ছিল তাঁর ওপর। 'ঝুমরু'-র সেই বিখ্যাত গান, 'কোই হামদম না রহা' সরস্বতী দেবীর সুরে অশোককুমারের গলায় বহুদিন আগেই জনপ্রিয় হয়েছিল। তবে কিশোর নিজেকে তৈরি করছিলেন ক্রমাগত। যে উচ্চতায় তিনি নিজেকে নিয়ে গিয়েছিলেন, তা খুব কম মানুষই অর্জন করতে পেরেছেন। লতা, মান্না দে, হেমন্ত, রফি— সব্বাই পছন্দ করতেন তাঁর গান। মান্না বলেছিলেন, "কিশোরকে কখনও বেসুরে গাইতে দেখিনি।" হেমন্ত তাঁর বিখ্যাত কম্পোজিশন 'ও সাম কুছ অজিব থি' গাওয়ালেন 'খামোশি"-তে (১৯৭০)। ইতিহাস রচিত হলো। সাতের দশকে আর ডি বর্মনের সঙ্গে জুটি করে ভারতীয় নেপথ্য সংগীতজগতের একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করেছিলেন কিশোর। সঙ্গে রাজেশ খান্না, পরের দিকে বচ্চন সাহেবের লিপ। কী করুণ রস, কী হাস্যরস, কী প্রেমের গান- কিশোরের 'স্ট্রেট' গায়কীর মায়ায় ভুবন ভুলেছে। রিকশাওয়ালা বাবার চরিত্রে মেহমুদ, তাঁর লিপে 'কুয়াঁরা বাপ'-এ গান 'আ রে আ যা, নিন্দিয়া তু লে চল কহিঁ', ঘুমিয়ে পড়ছে সন্তান… ফিল্মের পর্দা ছেড়ে বাস্তবের মাটিতে কত শিশু, কিশোর ঘুমিয়ে পড়েছে। একের পর এক হিট। সাতের দশকের শুরুতে রফি গান পেতেন না বেশ কিছুদিন। ফের পঞ্চমের সুরেই 'কেয়া হুয়া তেরা ওয়াদা'-তে ফিরলেন রঙ্গমঞ্চে। কিন্তু শ্রদ্ধা ছিল পারস্পরিক। যেটা নওশাদের ছিল না।

নওশাদ ভারতীয় সিনেমার সংগীতজগতে এক অবিস্মরণীয় নাম। তাঁর অবদান অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে কিশোরকে আক্ষরিক অর্থেই ঘৃণা করতেন। নিজের কোনও গান কিশোরকে দিয়ে গাওয়াননি। এ অবশ্য তাঁর ব্যক্তিগত পছন্দের ব্যাপার। এতে তেমন কিছু বলার থাকে না। কিন্তু তিনি একাধিকবার কিশোরের সঙ্গে এমন ব্যবহার করেছেন, যা বিশুদ্ধ ঘৃণার প্রকাশ ছাড়া আর কিছুই বলা চলে না। ১৯৭৫ নাগাদ, 'সুনেহরা সংসার' মুক্তি পেয়েছিল। রাজেন্দ্র কুমার-হেমা মালিনীর ছবি। নওশাদ সংগীত পরিচালক। সেসময় কিশোর খ্যাতির মধ্যগগনে। কী মনে হলো, কিশোরকে একটি গানের জন্য ডাকলেন নওশাদ। আশা এবং কিশোরের গলায় রেকর্ড হলো, 'হেলো, ক্যায়া হাল হ্যায়'। কিন্তু গানটি ছবির পরিচালক হাতেই পেলেন না। বলা হলো, রেকর্ডিং ভালো হয়নি। ছবির ক্রেডিটে কিশোর বা আশা— কারওরই নাম থাকল না। অথচ পয়সা দিয়ে রেকর্ড করিয়েছে এইচএমভি, তারা ছাড়বে কেন! তারা ছবিটির গানের যে এলপি রেকর্ড বের করল, তাতে এই গানটি রেখে দিল। বেঁচে গেল গানটি। আজ শুনলে বোঝা যায়, রেকর্ডিং মোটেও খারাপ হয়নি। ইচ্ছাকৃতভাবে গানটিকে ছবি থেকে বাদ দিয়েছিলেন নওশাদ। আরেকবার মধ্যপ্রদেশ সরকার একটি বিশেষ সাংস্কৃতিক পুরস্কার দেওয়ার কথা ভাবছিল। জার্নালিস্ট প্রীতীশ নন্দী, বিখ্যাত গায়ক কুমার গন্ধর্ব, পরিচালক মণি কউল ইত্যাদি নানা নামীদামি ব্যক্তিদের নিয়ে পুরস্কারের জুরি বোর্ড গঠন করা হয়। নওশাদও ছিলেন সেই বোর্ডে। ১৯৮৫ কি ১৯৮৬ সাল। বোর্ডের কয়েক জনের বক্তব্য, কিশোরকেই দেওয়া হোক। তাছাড়া কিশোর মধ্যপ্রদেশেরই ছেলে। নামটি প্রস্তাবিত হওয়ামাত্র প্রচণ্ড রাগে সব সভা ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন নওশাদ। এ ঘটনা লিখে গিয়েছেন প্রীতীশ নন্দী স্বয়ং।

বহু ঘৃণা, সমালোচনা, সন্দেহ তাঁর পথ আটকাতে চেয়েছে, পারেনি। হিন্দি গান হোক কি বাংলা, কিশোরকুমার একজনই। সিনেমার সংগীতজগতে তিনি কিংবদন্তি।

 

 

 

More Articles